রোববার সকাল বেলা ফেসবুকটা খুলেই মাথাটা গরম হয়ে গেল উজ্জয়িণীর। ’মা’-পোস্টে একেবারে ছেয়ে গেছে। ক্যানোরে বাবা! মা মা করে এত আদিখ্যেতা না করলেই নয়? মাদারস ডে বলে কি একেবারে মাথা কিনে নিয়েছে? বছরে আর ৩৬৪ দিন এত মাতৃভক্তি থাকে কোথায়? যত্তোসব! বিরক্তির সঙ্গে মোবাইলটা বন্ধ করে সোফায় ছুঁড়ে রাখতে যাবে এমন সময় নীচ থেকে ভেসে আসে শাশুড়ির উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর –
”কি ভালো মাছটা পেয়েছিস রে সমর, একেবারে টাটকা আর পরিস্কার!”
উজ্জয়িণী বুঝতে পারে যে তার ভাসুর সমর বাজার নিয়ে ফিরেছে। আর মা সংক্রান্ত কিছু হলেই এবাড়িতে বাঁধা মেনু – কুচো মাছের বাটিচচ্চড়ি! সে শাশুড়ির জন্মদিনই হোক বা বিবাহবার্ষিকী! বাটিচচ্চড়ি হবেই হবে। কখনো মৌরলা মাছের তো কখনো কাচকি, কখনো এই কড়ে আঙ্গুলের চেয়েও ছোট ট্যাঙরা মাছের বাটিচচ্চড়ি। রাগে বিরক্তিতে পেটটা গুলিয়ে এলো উজ্জয়িণীর। আচ্ছা, এরা কি আর কোন খাবার খেতে জানে না? উজ্জয়িণীর বাপের বাড়িতে এরকম গেঁয়ো খাবার কস্মিন কালেও হয় না। কোন উৎসব, অনুষ্ঠানে তো নয়ই। তার মার জন্মদিনে হয় সেজুয়ান চিলি চিকেন বা ওহ ক্যালকাটা থেকে অর্ডার দিয়ে আনা গন্ধরাজ ভেটকি! আর অন্যসব অনুষ্ঠানে তো বিরিয়ানী মোঘলাই বা বিজলী গ্রিলের পোলাও কষা মাংস! সে তুলনায় উজ্জয়িণীর শশুরবাড়িতে খাওয়া দাওয়াটা বেশ সেকেলে। রাগের চোটে সে ঠিক করলে যে আজ ভাত খাওয়ার আগে নীচে নামবেই না। তার বর তনয় সিঙ্গাপুর গেছে কনফারেন্সে। সে থাকলে ওই মার প্রিয় বাটিচচ্চড়ি নিয়ে তারও আদিখ্যেতা কিছু কম হোতো না!
তনয়ের সঙ্গে উজ্জয়িণীর বিয়েটা কিন্তু প্রেম করেই। এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ নয়। তনয়কে চিনত বন্ধুর বন্ধু হিসেবে। তারপর MBA পড়তে পড়তে প্রেম। উজ্জয়িণী কেরিয়ারের জন্যে বাচ্চা চায় না – এতে তনয় এক কথায় রাজী হয়ে যাওয়াতেই বিয়েটা হয়ে যায়। আর এই দু বছরে শ্বশুর বাড়ির কেউই তাকে কখনো বাচ্চা-কাচ্চার জন্যে চাপ দেয় নি। এমনকি জিনস টপেই যে সে বেশী স্বচ্ছন্দ সে নিয়েও কারুর কোন বক্তব্য নেই। এখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবেই থাকে। কিন্তু খাওয়া দাওয়া নিয়ে এই সেকেলেপনাটা তার একেবারে হজম হয় না। নেহাত রান্নাটা একেবারেই আসে না, তাই সহ্য করে নেয়।
দরজার পর্দাটা সরিয়ে মুখ বাড়ায় বড় জা অনন্যা। সে স্নান সেরে জামা শুকোত দিতে ছাদে এসেছে। ”কি রে, শরীর ঠিক নেই নাকি? খাবি না?” কোন কথা না বলে উজ্জয়িণী খোলা ল্যাপটপের দিকে আঙ্গুল দেখায়। অনন্যা বলে যে – ”উফ তোদের রোববারেও কাজ! আচ্ছা আমি ব্রেকফাস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি”। কিছুক্ষণ পরেই দুটো ব্রেড টোস্ট, একটা ডিমের পোচ আর কফি দিয়ে যায় উজ্জয়িণীর শাশুড়ির ২৪ ঘন্টার কাজের মেয়ে শিউলি। এবাড়ির সব রকম ফাই ফরমাস সেই খাটে। টোস্টে কামড় দিতে দিতে উজ্জয়িণী এলোমেলো ভাবে সময় কাটাতে থাকে। একবার ভাবল যে বন্ধু অর্পিতাকে ফোন করে। পরের মুহূর্তেই মনে হোল যে সেও নিশ্চয়ই মাতৃ দিবস উদযাপনে ব্যাস্ত! হার্বাল তেল মেখে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। শেষে সাড়ে বারোটা বাজতে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল।
নীচে এসে দেখল যে অনন্যা রান্নাঘর থেকে খাবার এনে টেবিলে রাখছে। সমর এক পাশে বসে কাগজ পড়ছে আর ওর শাশুড়ি রান্না শেষ করে হাত মুখ ধুতে কলে গেছেন। উজ্জয়িণী জিজ্ঞেস করল অনন্যাকে – ”তুমি খাবার আনছো? শিউলি কোথায় গেল”? অনন্যা কিছু বলার আগেই আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে ওর শাশুড়ি বলে উঠলেন যে তিন্নি মানে সমর–অনন্যার মেয়ে আঁকার ক্লাসে গেছে। সমরের শরীরটা ঠিক না থাকায় শিউলিই তাকে আনতে গেছে। তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন - ”তোমরা খাওয়া শুরু কর। শিউলি আর তিন্নি এসে গেলেই আমি বসে পড়ব”। অনন্যা বাধা দিয়ে বলল যে ”না মা, সমর আর উজ্জয়িণীকে দিয়ে দিন। ওরা এলে আপনি আর আমি এক সঙ্গেই বসব। আজকের দিনে আপনি একলা খাবেন”!
এসব ছেঁদো আলোচনা থেকে দূরে থাকতে উজ্জয়িণী হাতের মোবাইলে মন দিল। অনন্যা থালা গ্লাস গুছিয়ে দিচ্ছে এমন সময় দরজায় আওয়াজ। ওই এসে গেছে- বলতে না বলতে নাচতে নাচতে তিন্নি বাড়ী ঢুকল। হাতে সাদা কাগজে আঁকা একটা ছবি। তিন্নি একটানা কথা বললে চড়াই পাখির কিচির মিচিরের মতোই লাগে। সে হাতের ছবিটা দোলাতে দোলাতে বলল – ”আজকে না আমি এইটা এঁকে ফার্স্ট হয়েছি”। সমর খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলল – ”তাই নাকি? কি এঁকেছিস দেখি”? অনন্যা একটা তোয়ালে দিয়ে তিন্নির হাত পা মোছাচ্ছিল, তিন্নি তার মধ্যেই ছবিটা তুলে ধরল। উজ্জয়িণী দেখল যে তিন্নি নিজেকেই এঁকেছে – সুন্দর ফুল কাটা ফ্রক পরা, তার একপাশে হাত ধরে শাড়ি পরা ওর মা অনন্যা আর অন্য দিকে হাত ধরে প্যান্ট – টিশার্ট পরা -, ওর বাবাই হবে নিশ্চয়ই। আর ওদের পেছনে একটা বড় গাছ, তাতে একটা বুড়ির মুখ।
”পোকাহন্টাস এর Grand mother Willow এঁকেছিস না কি রে”? – উজ্জয়িণী জিজ্ঞেস করে।
”কি যে বল কাম্মা, ঠিক করে দেখো” – ছবিটা নিয়ে তিন্নি সোজা বাবা আর কাম্মার কাছে চলে আসে।
উজ্জয়িণী এবার কাছ থেকে ছবিটা দেখে। কিন্তু ছবি দেখবে কি? এক লহমায় দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যে। ছবিতে তিন্নির এক হাত ধরে ওর মা আর অন্য হাতটা ধরে প্যান্ট – টিশার্ট পরা মানুষটা ওর বাবা নয় - ওর কাম্মা মানে উজ্জয়িণী। আর ওদের পেছনে Grand mother Willo যে বটবৃক্ষ, দু হাত দিয়ে ওদের আগলে রেখেছে, সেটা আর কেউ নয়, তিন্নির ঠাম্মা মানে অনন্যা - উজ্জয়িণীর শাশুড়ি। কপালে ধেবড়ে যাওয়া টিপটা আর চওড়া হাসিটা দেখলেই বেশ চেনা যায়। আর ছবির তলায় আঁকা বাঁকা অক্ষরে তিন্নি লিখেছে যে – Everyday is a happy mothers’ day!
একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় উজ্জয়িণীর বুক ভরে যায়, কি করে যে চোখের জল লুকোয় তা সে বুঝতে পারে না। ভাগ্যিস সমর তখন মেয়েকে নিয়ে খুনসুটিতে ব্যাস্ত! মুখ নিচু করে মোবাইল দেখার ভান করতে থাকে। সম্বিত ভাঙে তার শাশুড়ির কথায় – ”থালাটা একটু এগিয়ে নাও তো, খেতে শুরু করো”!
ধবধবে কাচের থালায় জুঁই ফুলের মতো সুন্দর ভাত, পাশে আলু ভাতে মাখা আর বেগুন ভাজা। একফালি পাতিলেবু আর একটুখানি নুন। আজ নিশ্চয়ই মুগ ডাল হয়েছে। তার ঘি ফোড়নের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। উজ্জয়িণীর শাশুড়ি একটা বাটি এগিয়ে দ্যান। উজ্জয়িণী দেখে যে সেই বিখ্যাত বাটিচচ্চড়ি, তবে একি? কোন কুঁচো মাছের নয়তো, তার অতি প্রিয় ছোট চিংড়ি – পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর পাতলা করে কাটা আলুর ফালির সঙ্গে সোনালি তেলে ঝালে স্নান করছে। কি তার রূপ, কি তার সুগন্ধ! অবাক হয়ে মুখ তুলতেই সমর বলে ওঠে যে তুমি তো কাঁটা মাছ খেতে পারো না। তাই মার অর্ডারে আজ থেকে কুঁচো মাছ আউট! এখন থেকে এবাড়িতে ছোট চিংড়ির বাটিচচ্চড়িই সাব্যস্ত। তাই তো মা? উজ্জয়িণীর শাশুড়ি বলে ওঠেন – ”তুই থাম তো, মেয়েটাকে খেতে দে”। উজ্জয়িণী ভাতে মেখে একগাল বাটিচচ্চড়ি মুখে দেয় আর দিতেই যেন স্বাদের ফুলঝুরি ফুটতে থাকে। তার মনে হল – পিওর অমৃত! এমন ভালো সে কোনদিন কিছু আগে খায় নি, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না। এর কাছে কোথায় লাগে সেজুয়ান চিকেন আর ল্যাম্ব রোস্ট! সে কিছু বলার আগেই অনন্যা বলে ওঠে - ”মা উজ্জয়িণীকে আর একটু দিন, ওর খুব ভালো লেগেছে”। উজ্জয়িণীর শাশুড়ি বলেন - ”আমি তো ভাবলাম ওর ঝাল লাগবে”।
কোথায় ঝাল! গিলে নেওয়া চোখের জলে মিশে বাটিচচ্চড়ির ঝাল তখন গলে জল, গঙ্গা যমুনা পেরিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছে। সেখানে তখন সূর্যোদয় হচ্ছে আর মাঝিরা নৌকো বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শান্ত জল ঠেলে। কোথায় যেন ফুলের হাট হয়! সেখানে মেয়েরা উবু হয়ে বসে মালা গাঁথে আর হেসে হেসে এ ওর ওপর ঢলে পড়ে। হঠাত সম্বিত ভাঙে ফোনের আওয়াজে।
স্পিকার ফোনে ওপার থেকে ভেসে আসে তনয়ের গলা – ”সে কি ওকেও বাটিচচ্চড়ি ধরিয়ে দিয়েছো? যাহ্, আমার ভাগ তাহলে কমে গেলো”!
ভালোলাগায়, ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে আছে উজ্জয়িণী। বেঁচে থাক বাঙালির বাটিচচ্চড়ি, সার্থক মাতৃদিবস!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।