এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অনন্যা নারী

    Sayanti Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ মে ২০২২ | ৮৪৮ বার পঠিত
  • পর্ব ৬

    অর্ণব বেড়িয়ে যাবার পর জয়িতা একটু অবসর পায়। কিছু জিনিস শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর বেড়তে ইচ্ছে নেই জয়িতার। বাইরে যেরকম বরফ পড়ছে। মনটাও কেমন যেন গুম মেরে আছে। আগে হলে অর্ণবের বেড়িয়ে যাবার পর পরই জয়িতা রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ত। যে স্টোরে জয়িতা কাজ নিয়ে ছিলো সেটা তাদের বাসা থেকে একটু দূরে। জয়িতা ট্রাম ধরে নিত। এদেশের ডিপারটমেন্টাল স্টোর গুলো বেশ বড় । কত যে জিনিস সেখানে পাওয়া যায় তার শেষ নেই। জয়িতা বুদ্ধিমতী, অল্প দিনেই কাজের খুঁটিনাটি শিখে গেছিল। শেষ দিকে সেকশন হেড হয়েছিল। সংসারের নেইনেই হালটা অনেকটা কেটে গেছিল। জয়িতারও সময় কেটে যেত। নিজে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। নিজেই সব সামলাত। সংসার, বাইরের কাজ। তবে মাঝে মাঝে একটা অজানা দুঃখ তাকে ঘিরে ধরত। বিষণ্ণ বোধ করত এই ভেবে যে এভাবেই কি তার বাকি জীবনটা কাটবে?

    তুতলকে ঘুম থেকে তুলতে হবে। তারপর খাওয়ানো আছে। মেয়ের এই কদিনেই বায়নাক্কা অনেক হয়েছে। না ঘোরালে খাবে না। তুতুল দেখতে ডল পুতুলের মতো হলে কি হবে, কথায় কথায় মেয়ের গাল ফুলে যায়। অর্ণব জয়িতার প্রথম সন্তান তুতুল। হটাত করেই তুতুলের আগমনবার্তা এসেছিল। অর্ণব তো খুব খুশি । জয়িতা বুঝতে পারছিল না খুশি হবে কিনা। কারন একসাথে অনেক চিন্তা, ভয় তাকে ঘিরেছিল। অর্ণবকে সব সে খুলে বলতেও পারত না। স্টোরের কাজ, বাড়ির কাজ, তারসাথে অনাগতের চিন্তা একটা সময় জয়িতা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ডেলিভারির মাস খানেক আগে মা এসেছিল কলকাতা থেকে। তখন একটু জয়িতার নিশ্চিন্ত মনে হয়েছিল। ততদিনে কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। তুতুল যেদিন জন্মাল সেটা বর্ষার এক দিন। বাইরের বৃষ্টির সাথে তাল রেখে মেয়ে জন্মে জন্মেই কান্না ধরেছিল বেশ কিছুক্ষণ। মা আরও কিছুকাল ছিলো বোস্টনে। তাখন মেয়ের সব কিছু মা ই সামলাত। জয়িতা রেস্ট করত। মা যেমন করে তুতুলকে সামলাত জয়িতা এত দিনেও পারল না। তুতুলও মা কে বেশ সমীহ করত। সে তুলনায় নিজের মা কে মেয়ে মনে হয় তেমন গুরুত্ব দেয় না। 

    কিচেনে এসে জয়িতা আগে মেয়ের জন্য দুধ গরম করলো। খাবে কম ফেলবে বেশি। মেয়ে প্রায় ছয় মাসে পড়ল। কলকাতাতে থাকলে এবার অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থা করতে হতো। বোস্টনে কিছু করা হবে বলে মনে হয় না। অর্ণবের কোর্স প্রায় শেষের দিকে। আর মাস দুয়েক আছে। ব্যস্ততা খুব। অর্ণব এখনই অনেক জায়গায় চাকরির জন্য দরখাস্ত করে ফেলেছে। অর্ণবের ইচ্ছে কোন একটা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারারের জব। চাকরিটা এবার খুব দারকার। জয়িতা আর কাজে জয়েন করে নি। মা দিব্যি করিয়ে নিয়েছিল। মাসের ঠিক সময়ে কলকাতা থেকে টাকা ঢুকে যায় জয়িতার অ্যাকাউ েন্ট। থাক মার সাথে আর ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয়নি জয়িতার। শরীরও পারমিট করত না। তবে অর্ণব জব পেলেই জয়িতা মানি রিটার্ন করবে।

    দুধের বোতল নিয়ে জয়িতা বেডরুমে এলো। তুতল একটা ছোট্ট পুতুলের মতো ঘুমোচ্ছে। গোলাপি ঠোঁটের কোন দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়েছে। জয়িতা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে। তুতুল কে দেখলে জয়িতার মনের বিষণ্ণতা কমে যায়।  মা কলকাতায় ফিরে যাবার পর সেই অচেনা বিষণ্ণতা জয়িতা কে মাঝে মাঝে গ্রাস করত। যখন অর্ণব বেড়িয়ে যেত। দুপুরে তুতুল ঘুমত তখন। তুতুলের সব কাজ করেও জয়িতার অনেক সময় থেকে যেত। কি করবে সেটা জয়িতা বুঝে পেত না। গাঢ় হতো মনের বিষণ্ণতা।

    আজ আর রোদ উঠবে না। এখানে এই এক, কোনকোনদিন সারাদিন শুধু নিঃশব্দে বরফ পড়ে যায়। আশেপাশের সব বরফে সাদা হয়ে থাকে। নেহাত দারকার না থাকলে এই দিনগুলোতে কেউ বিশেষ বাইরে বেড়য় না। জয়িতা মেয়েকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিল। দুপুরের লাঞ্চ করা আছে, তুতুলের আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত জয়িতার আর বিশেষ কাজ নেই। জয়িতা মেয়ের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। তুতুল কি বোঝে সেই জানে। শুধু মাঝে মাঝে ফোকলা মুখে হাসে। কখনও মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তার ধারে জানালায় দাঁড়ায়।
     
    কখনো একটা দুটো গাড়ি যায়। এখানে লোকজন পায়ে হেঁটে কমই যাতায়াত করে। সবারই প্রায় গাড়ি আছে। অর্ণবও একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে। জয়িতা চালানো শিখেছে কিছুটা। তবে সাহস হয় না চালাতে। দুপুর গড়াতে তুতুল আবার খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে গেল। জয়িতা ঘরের টুকটাক কাজ সেরে লাঞ্চ করে নেয়। এখন অফুরন্ত সময়। জয়িতা কয়েকটা চিঠি লেখে। জয়ের চিঠি এসেছিল গতসপ্তাহে। জয় নিয়ম করে চিঠি লেখে। তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে। অর্ণবের কিছূ লেখার কোন সময় হয় না। অগত্যা জয়িতাকেই এসব দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এমন কি শান্তিনিকেতন  থেকে অর্ণবের মা চিঠি পাঠালেও তার উত্তর দেয় জয়িতাই। মা বিষয়টা বুঝে এখন জয়িতাকেই সরাসরি চিঠি লেখে। মা র মধ্যে লেখার যে একটা সুন্দর ক্ষমতা আছে সেটা তার চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। অর্ণবের মা র সাথে চিঠির মধ্যমেই যেন নতুন করে পরিচয় হয় জয়িতার। জয়িতার কাছে এক একটা চিঠি যেন জীবনের এক একটা গল্প। যত্ন করে সেগুল রেখে দিয়েছে জয়িতা।

    জয়ের চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি। কলকাতার অনেক খবর জয় পাঠায়। কলেজের সবার খবর যে জয় কমবেশি রাখে সেটা ওর চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। তনিমার খবরও পাঠায় মাঝে মাঝে। তনিমার বিয়ের খবর পেয়েছিল এরকম এক চিঠিতে। জয়কে শুধু চিঠির উত্তর দিলেই হবে না। একটা কিছু লিখে পাঠাতে হবে। জয়িতা একসময় কবিতা লিখত। কলেজের ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল। জয় উৎসাহ নিয়ে এসব করত। সেই থেকে সে জয়িতাকে থেকে থেকে খুঁচিয়ে যায়। ওদের একটা লিটল ম্যাগাজিন আছে, তাতে ছাপবে। মাঝে একটা কপিও পাঠিয়েছিল। কিন্তু কি লেখে জয়িতা। শেষে মনের ভাবটা কবিতা হয়ে কাগজে ফুটে ওঠে। আর একটা চিঠি ও এসেছে। জয়িতা সেটা আগ্রহ নিয়ে পড়ল। খুশিতে মনটা ভরে গেছে আজ। অর্ণব এলেই বলতে হবে এটা।

    অর্ণব ফিরল সন্ধ্যে হবার পর। তুতুল অনেক ঘুমিয়ে  একটু আগে উঠেছে। বাবা মেয়ে এখন খেলায় ব্যস্ত। আর জয়িতা রান্নাঘর ডিনারের আয়োজনে। অর্ণব মেয়ের সাথে যতটা প্রান খুলে হাসে, কথা বলে… আর কিছুতে তেমন নয়। অর্ণব এমনিতে গম্ভীর  প্রকিতির। একমাত্র এই সময় তার সব ছেলেমানুষি বেড়িয়ে আসে। ডিনার রেডি করে জয়িতা হাক দিল। তুতুল আজ জেগেই আছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে অর্ণব খেতে বসে
    - ও কে আমাকে দিয়ে তুমি খেয়ে নাও।
    - কেন? আমরা একসাথে খাব আজ। তুতুল কি বোঝে কে জানে। ফোকলা হাসে।
    - তাহলে আর খাওয়া হয়েছে। খেলাই হবে।
    - হোক। আজ আমরা শুধু খেলব। আজা আমাদের খেলার দিন। অর্ণব মেয়ের সাথে বকে যায়।
    জয়িতা তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। অর্ণব আবার বলে
    - আজ একটা বিশেষ দিন। তুতুল আবার হাসে। জয়িতা বুঝতে পারে না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অর্ণবের দিকে।
    - আজ বাবার চাকরি হয়েছে যে। তুতুল হেসে লুটিয়ে যায়।
    - ও মা সে কি তুমি বল নি। জয়িতা খুশি হয়।
    - আজই লেটার এসেছে।

    জয়িতা অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল বলবে বলে। নিজেকে সামলে নিল। থাক কাল পরশু বলা যাবে । মেয়েকে অর্ণবের কাছ থেকে নিয়ে বলল, ”তুমি খেয়ে নাও এবার”।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন