এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিরিয়ানীর আলু 

    Suparna Sanyal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ এপ্রিল ২০২২ | ৬৬১ বার পঠিত
  • - সে কি...... আ...লু  নে...ই??? 
     
    বনমালী বাবুর আর্তনাদে দুর্গাপুরের পুরনো রেল কোয়ার্টার কেঁপে উঠল। মনে হল কেউ যেন ওনার পাঁজরার একটা হাড় খুলে নিয়েছে।
    সবেমাত্র বদলি হয়ে বনমালী বাবু আজ দুর্গাপুর পৌঁছেছেন। স্নান শেষ করে সবে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বসেছেন, অধস্তন দীপক এসে সুখবরটা দিল যে নতুন সাহেবের আসা উপলক্ষে বাবুর্চি রামশরণ বিরিয়ানী দমে বসিয়েছে। পাঁঠা সে নিজে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে নিয়ে এসেছে। পুলকিত মনে বনমালী বাবু জিজ্ঞেস করলেন যে আলু আছে তো। দীপক তাতে কিঞ্চিত মাথা চুলকে বলেছে যে সেটা সে ঠিক জানে না। তাতেই সেই আর্তচিৎকার।
     
    - আলু বিনা বিরিয়ানী যেন মণি হারা ফনী! কিমবা ওয়াটসন ছাড়া শারলক হোমস! 
     
    দীপকের পৈত্রিক বাড়ী কসবা হলেও যে বড় হয়েছে হায়দ্রাবাদে। বিরিয়ানী বলতে সে বোঝে প্যারাডাইসের ঝাল ঝাল মাখা মাখা বিরিয়ানী। তাতে আলু তো কস্মিন কালেও থাকে না। তার কাছে বিরিয়ানীর মাংসটাই আসল। সেই মাংস ফেলে আলু কি করে যে পঞ্ছায়েত প্রধানের জায়গা পায় সেটা তার ঠিক বোধগম্য হোল না। মাথা চুলকে সেই কথাটা বলে ফেলতেই বিস্ফোরণ হোল। বনমালী বাবু গর্জন করে উঠলেন – বিরিয়ানীর তুমি কি বুঝবে হে দুদিনের ছোকরা! আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী কি বিরিয়ানী হোল? আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ, ও তো মাংস মাখা ভাত! বিরিয়ানী খেতে হলে ঢুকতে হবে কলকাতার অন্দরমহলে, যেখানে তেলচুকচুকে মাংসর পাশে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত গোটা একটা আলু। আহা, সে আলু কি আর যেমন তেমন আলু! মুখে দিলে মাখনের মতো মিলিয়ে যাবে। কখন শুরু আর কখন শেষ তা টেরও পাবে না! বনমালী বাবু মুহ্যমান হয়ে পড়লেন।

    কলকাতার বাঙালিদের বিরিয়ানী প্রীতির কথা ভেবে নতুন বস কে খুশী করবে বলে দীপক রামশরণকে বিরিয়ানী রাঁধতে বলেছিল। তা সে প্ল্যান যে এমন বুমেরাং হয়ে ফেরত আসবে সেটা তার কল্পনারও অতীত। সামনের শুক্কুরবারে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার ছুটি চাইবে বলে ভেবে রেখেছিল। এখন সেসব গুড়ে বালি দেখে সে বিরস বদনে উঠবার উপক্রম করল। সবে সে উঠতে যাবে এমন সময় অগতির গতির মতো রামশরণ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। খানা রেডি!

    ব্লাড প্রেসারের অসুধটা গিলে ফেলেই বনমালী বাবু  দীপকের পেছন পেছন খাবার ঘরের দিকে রওনা দিলেন।  রামশরণের বিরিয়ানীর গন্ধে গোটা কোয়ার্টার ম ম করছে। খাবার টেবিলে আয়োজন বলতে একটি বড় গামলা আর সঙ্গে একটা ছোট কাঁচের বোল। হাত ধুয়ে বনমালী বাবু চেয়ারে বসতেই রামশরণ গামলার ঢাকনা খুলে একটা ডাবু হাতা দিয়ে সাদা কাঁচের থালায় বিরিয়ানী তুলে দিল। আর দিতেই – ’আহা কি হেরিলাম’! হালকা হলুদ সুগন্ধের পালকের মতো বিরিয়ানীর ভাতের মধ্যে বিরাট একটা মাংসের টুকরোর পাশে বিরাজমান একটা জলজ্যান্ত আলু। যেন কৃষ্ণর পাশে রাধা! যেন অমাবস্যার অন্ধকারের পাশে জ্যোৎস্নার আলো! অবাক বিস্ময়ে বনমালী বাবু মুখ তুলে তাকাতেই রামশরণ বলল যে সে সাত বছর কলকাতার গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে বাবুর্চির কাজ করেছে। কলকাতা থেকে বাবু আসছে শুনে বিরিয়ানিতে আলু না দেওয়ার মতো ভুল সে করে? তোবা তোবা! রামশরণের প্রতি কৃতজ্ঞতার আলোয় দীপকের মুখ চকচক করে উঠল।

    শসা আর পেঁয়াজের রায়তা দিয়ে কলকাতা স্টাইল বিরিয়ানী খেয়ে বনমালী বাবুর প্রথম অনুভুতি হোল যে দুর্গাপুর দিব্বি থাকার মতো জায়গা আর বাড়িও বিশেষ দূরে নয়। দীপক ভরসা করে সবে খেতে শুরু করেছে, তাকে তাগাদা দিয়ে বললেন যে আগে আলুটা খাও। ওটা ছাড়া বিরিয়ানী অসম্পূর্ণ। তাছাড়া এই আলুর সঙ্গে ইতিহাসের যে কি গভীর সংযোগ আছে তা কি জানো? দীপক অবাক চোখে তাকাল।
     
    বনমালী বাবু এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন,
    – তখন ১৮৫৬ সাল, সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হচ্ছে ভারতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আউধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্‌ কে সিংহাসনচ্যুত করে  বাংলায় নির্বাসনে পাঠাল। উনি পরিবার আর প্রচুর লোক লস্কর নিয়ে লখ্নউ  থেকে এসে আস্তানা গাড়লেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। কিন্তু পরাজিত নবাবের  আর্থিক সঙ্গতি তখন তলানীর দিকে। ফলে অত লোকজনকে নবাবী কায়দায় খাওয়া দাওয়া জোটানো মুশকিল হোল। তখন মুশকিল আসান হোল নবারের খাস বাবুর্চি। পর্তুগীজদের কল্যাণে তখন সদ্য সদ্য আলুর আমদানী হয়েছে ভারতবর্ষে। ওয়াজিদ আলি শাহ্‌র বাবুর্চি‍ মাংসের খরচ বাঁচাতে বিরিয়ানীতে আলু সংযোগ করে নতুন এক ডেলিকেসীর জন্ম দিলেন। ভারতের খাদ্য ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন হল। অবশ্য কলকাতার বিরিয়ানীতে ডিমের সংযোগ কে করেছিলেন সেটা সঠিক জানা যায় না।       
        
    দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ। বনমালী বাবু পকেট থেকে ২০০ টাকার নোট বার করে রামশরণের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। রামশরণ তো এই বদান্যতায় ধন্য হয়ে গেল।  আর দীপক আগামীকালই ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার ছুটির দরখাস্ত করবে বলে মনে মনে ঠিক করল।
     
    আহা - বেঁচে থাক কলকাতার বিরিয়ানীর আলু। বাঙালির গর্ব! রাজার মুকুটে মুক্ত! যে একবার সঠিক জায়গায় সঠিক ভাবে রান্না কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানী খেয়েছে সে ইহজীবনে কোনদিনও ভুলবে না!     
     
    Disclaimer: উপরোক্ত কাহিনীটির স্থান, কাল, পাত্র সবই কল্পিত। কোন উক্তি বা ঘটনা কারুর মতামত, দর্শন বা বিশ্বাসের পরিপন্থী হলে তা একেবারেই উদ্দেশ্যমূলক নয়।  স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে আজ আমাদের সুইডেনের বাড়িতে পাঁঠার মাংসের বদলে মুরগী ব্যাবহার করা হয়েছে। তাতে অবশ্য আলুর  কোন মানহানী হয়নি।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন