হেমন্তের হিমহিম হাওয়া কেমন একটা ঝিমধরা আলসেমি মাখিয়ে রাখে সকালগুলোতে। ধুলো আর কুয়াশা হাত ধরাধরি করে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে সূর্যকে। এমন ম্লান দিনগুলোয় বেজায় মনখারাপ হয়ে থাকে নীরার। ডা: নির্ঝরিণী মুখার্জী। শহরের প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন মনোবিদ। কফির কড়া ধোঁয়ায় মেজাজটাকে সেঁকে নিতে নিতে সে চোখ বুলিয়ে নিলো সাক্ষাৎপ্রার্থী তালিকায়। নাতিদীর্ঘ তালিকায় পাঁচটি মাত্র নাম।ধীরেসুস্থে তাদের মানসিক আর শারীরিক ওষুধপথ্যের নিদান দিলো। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে যাবার আগে অর্ক একটা চিরকুট হাতে ঢুকল। অর্ক হলো দিনের শিফ্টের রিসেপশনিস্ট। খুবই দক্ষ আপ্যায়ণকারী, ঝকঝকে তরুণ। সুপ্রভাতের পর্ব মিটিয়ে জানালো
- ম্যাডাম, মিস্টার জনাথন এসেছিলেন আজ। গতসপ্তাহে আপনার কাছে কাউন্সেলিং সেশন ছিল। দেখা করতে চাইলেননা, শুধু এই চিঠিখানি রেখে গেছেন।
- মিস্টার জনাথন। হুম।
খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করলো নীরা। মনে পড়লো। এসেছিলো বটে জনাথন দিন কয়েক আগে। হ্যালুসিনেশনের ঘটনা। সে নাকি ভবিষ্যতের মানুষ। সমান্তরাল ভুবন থেকে টাইম ট্রাভেল করতে করতে এসে পড়েছে। গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্সের মতো কূট তত্ত্বের কচকচি শুনেছিলো নীরা পেশাদারি ধৈর্যের সঙ্গে। মৃদু হেসে নীরা অর্ককে বললো
- আচ্ছা, রেখে যান। দেখে নেবো।
হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নিলো নীরা। মাথা নেড়ে চলে গেলো অর্ক।
জনাথনের ঘটনাটা আরো একটা কারনে নাড়িয়ে দিয়েছিলো নীরার মন। এখনো নীরা মনে করতে পারে সেদিনের কথোপকথন।
- বলুন মিস্টার জনাথন, আপনার আর কী মনে হয় ?
- বড্ড ভয় হচ্ছে ম্যাডাম, যদি ফিরে যাবার ফর্মুলাটা সত্যি আর মনে না পড়ে !
- ভয় নেই, ঠিকই মনে পড়বে !
অভ্যস্ত ভঙ্গীতে অসত্য আশ্বাস দিয়েছিলো নীরা।
- আর মনে না পড়লেই বা কী মিস্টার জনাথন ? আমাদের এই দুনিয়া কি খুবই খারাপ?
- আমার পার্টনার আর আমার তিনমাসের ছেলেটা ! তারা যে অপেক্ষা করে আছে ! এর মধ্যেই তো সাতটা মাস কেটে গেছে, মানে ওদের হিসেবে বছর নয়েক।
বিড়বিড় করে কীযেন হিসেবে ডুবে গেলো জনাথন। আর চমকে উঠেছিল নীরা। জনাথন কী সূত্র ভুলেছে সেকথা তুচ্ছ কিন্তু স্বাভাবিক চেতনার এই প্রান্তিক অবস্থানেও সে ভোলেনি তার আপনজনদের কথা। জাগতিক মায়ার দোহাই দিয়ে অস্বীকার করেনি তার দায়িত্ব। জরৎকারু মুনি হোক কিম্বা শাক্য সিদ্ধার্থ কত অবলীলায় ত্যাগ করেছেন স্ত্রী সন্তানকে বোধ আর বোধির টানে। জিষ্ণুওতো একবারের জন্য তাকায়নি পেছন ফিরে নীরার দিকে ।
- ম্যাডাম, ফর্মুলাটা যে আমায় মনে করতেই হবে !
সম্বিৎ ফেরে নীরার।
- হ্যাঁ , নিশ্চয়ই। আপনি এই ওষুধগুলো নিয়ম করে খান এক সপ্তাহ। আর রিলাক্স করুন একটু।
খচ খচ করে কয়েকটা দুশ্চিন্তা কমানোর আর ঘুমের ওষুধ লিখলো নীরা।
- মিস্টার জনাথন, আপনি সামনের সপ্তাহে আরেকবার আসবেন দয়া করে। আজ আর নয়।
বিদায় জানিয়ে চলে গিয়েছিলো জনাথন।
বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীরা। আলগোছে তুলে নিলো চিরকুটখানি। বিস্ময়ের হিলহিলে স্রোত বয়ে গেলো তার মেরুদন্ড বেয়ে। এও কী সম্ভব ! জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে উঠতে জিষ্ণুকে সে কবেই পেছনে ফেলে এসেছে অথবা জিষ্ণু তাকে ! জিষ্ণু রসায়নে চোখ ধাঁধানো ফল করার পর মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গন্ডী টপকে পারি জমিয়েছে বিদেশে।
নীরা তখন সবে স্নাতক। নীরার হাজার অনুরোধ উপরোধ এমনকি তার দু’মাস অন্তঃসত্ত্বা হবার খবরও আটকাতে পারেনি জিষ্ণুকে। অনাগত সেই সন্তানের আর পৃথিবীর আলো দেখা হয়নি। নীরাও আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিয়েছে তার একার জীবন। কিন্তু জনাথন কেমন করে জানতে পারলো সেকথা !
এই তো! সে স্পষ্ট করে লিখে গেছে
- ম্যাডাম, ধন্যবাদ। আমি ফর্মুলাটা মনে করতে পেরেছি। ফিরে যাচ্ছি আমার জায়গায়। যাবার আগে আপনাকে একটা উপহার দিয়ে যাচ্ছি । ডা: জিষ্ণু বসুর ঠিকানা আর যোগাযোগ নম্বর। এই লিখে গেলাম। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করবেন। বিদায়।
নিজেকে শান্ত করলো নীরা। মহাবিশ্ব , আলোকবর্ষ পেরিয়ে যদি ফিরে আসা যায় তাহলে দুএকটা সমুদ্র আর গিরিখাত পেরিয়েও ফিরে আসা যায়। জিষ্ণু ফিরে আসবেনা বলেই গিয়েছে হয়তো। যদিবা সে ফিরেও আসে তাদের সেই সন্তান ! ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ মানুষের চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলো নীরা। জানলা খুলে টুকরোগুলো উড়িয়ে দিলো ঘোলাটে আকাশের বুকে। জনাথনের মতো ফিরে আসতে আর কতজনই বা চায় ? জিষ্ণুরা চিরকাল মুক্তি চেয়েছে। তাই আজ মুঠো খুলে মুক্তিই দিলো নীরা। নারীরা যে মুক্তিও দেয় !
----
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।