ক্ষয়াটে চেহারার হরু মুখুজ্জে পেশাদার পুরুত। আজকাল নিজের গাঁ, পাশের গাঁ পেরিয়ে শহরের দিকেও যজমান ধরছেন এজেন্ট লাগিয়ে। কমিশন বাদ দিয়ে আয় মন্দ হয় না। এবার আবার নতুন যজমান, রাজারহাটের। তাই সেই কাকভোরে রওনা দিয়েছেন ছোট ছেলে পটাইকে নিয়ে।
বছর দশেকের পটাই শহর দেখেনি। বেশ উৎসাহ নিয়েই বাপের সাথে পাড়ি জমালো সে। কাজ বলতে, ঐ মালপত্তর বওয়া আর কি। অনেকটা গাধার মতোই। তা হোক। নতুন কতো কি দেখবে সে! এ আর কম কি! এরমধ্যেই বেশকিছু প্রশ্নে জেরবার হয়েছেন হরুঠাকুর। নিজের মতো করে ক'টার উত্তরও দিয়েছেন। কিন্তু রাজারহাটে কবে, কোথায় "রাজার হাট" বসে, সে হাট রবিঠাকুরের কবিতার মতো কি না -- এ সব প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই। অতএব ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা ছাড়া আর উপায় কি? ঠিক ওই নেতাদের মতো। হয় এড়িয়ে যাও, নয় চমকে, ধমকে থামিয়ে দাও। পটাই এসব বোঝে না। বুঝতে চায়-ও না। ও বাসের জানলায় মুখ রেখে 'বিগবেন' দেখে, ভিখিরি দেখে, সিভিক পুলিশের গাড়ি ধরা দেখে, আর দেখে ব্রিজ। দেখে, আর ভাবে - এ্যতো পোক্ত ব্রিজও ভেঙে পড়ে ভূমিকম্প ছাড়াই?
রাজারহাটের গগনচুম্বী আবাসনের একটাতে থামে ওদের টোটো। এক, দুই করে গুনতে গুনতে প্রায় ধরাশায়ী হওয়ার যোগাড়! বাপ বললো, "ছাব্বিশ তলা"। বাপ্ রে! ওরা যাবে সতেরোয়। লোহার গেটের বাঁ-দিকে একটা ধানের গোলার সাইজে খুপরি ঘর করা আছে। তার মধ্যে একটা পুলিশের মতো পোশাক পরা লোক। ঠিক পুলিশ নয়, সিভিকও নয়। এ নাকি গার্ড। রেলের গার্ড নয়, সে তো কালো কোট পরে! গার্ডটা একটা হিসেবের খাতা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, "আপনার নাম, ঠিকানা, কার কাছে যাবেন, কেন যাবেন, কখন ঢুকছেন, সাথে ক'জন আছে, তাদের ডিটেইল - সব এন্ট্রি করুন এখানে।"
বাবা সব লিখল। শেষে সই করল। গার্ডটা কাকে একটা ফোন করল। ফিরে এসে পটাইদের একটা করে মালার মতো পরিয়ে দিল। লকেটটা একটা চৌকো মতো কার্ড। পটাই ক্লাস ফাইভে উঠে ইংরাজীটা মোটামুটি রপ্ত করেছে। ভি আই এস আই টি ও আর। আচ্ছা - ভিজিটর! গাঁয়ে গিয়ে বলতে হবে -
এই শহরের গার্ড দে / য় ভিজিটর কার্ড
ফিতের মালা সফট / তার লকেটটা হার্ড!
"এটা কী, বাবা?"
"এটা লিফট।"
পটাই দেখল, দেওয়াল সরে যাচ্ছে। ভেতরে একটা ঘর। ঘরের সামনে উুঁচু টুলে আরেকজন গার্ড বসে। বাবা আর পটাই সে ঘরে ঢুকতেই নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা! বাবা 'সতেরো' বলতেই গার্ডটা একটা বোতাম টিপে দিল। আলোও জ্বললো! কি আশ্চর্য! পটাইরা উঠে যাচ্ছে ওপরে! সিঁড়ি চড়তে হোলো না! আপনিই উঠে যাচ্ছে! কী সহজে ওপরে ওঠা যায় এই শহরে! ভাবে পটাই। কত্তো নতুন জিনিস দেখার আছে এখানে। বাবা বলেছে এরপর একদিন পাতাল রেল চড়াবে। ওখানে চলমান সিঁড়ি আছে। কত সহজে শহরে সবাই ওপরে ওঠে!
'যজমান' কথাটা শহরে বিশেষ চলে না। এজেন্ট ছোকরাটা বলে দিয়েছিল, 'ক্লায়েন্ট' এরা। পটাই শুনেছে। হরুঠাকুর পুজোয় বসেছেন। পটাইয়ের মন উশখুশ করছে বারান্দায় যাওয়ার জন্য। পুজো তো অনেকক্ষণ চলবে। একটু ঘুরে এলে হয় না! মনকে আর না অপেক্ষায় রেখে বাইরে এলো পটাই। দেওয়ালে দরজা। পাশে সুইজ। টিপলেই আলো! চিচিং ফাঁক বলার আগেই হাঁ হয়ে গেল লিফট! কত সহজে ওপরে ওঠা যায় এ শহরে! ভেতরে সেঁধিয়ে গেল পটাই। টুল তো ফাঁকা। গার্ড কই? যাকগে! ও তো জানে, বোতাম টিপলে আলো জ্বলে। ওপরে ওঠা যায়। দরজা বন্ধ হতেই তাই একটা বোতাম টিপলো পটাই। লিফট চালু হোলো। কিন্তু এ কী! শরীরটা এমন হাল্কা লাগছে কেন? লিফটটা চলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ওপরে নয়, নীচের দিকে যাচ্ছে! এত সহজে নীচেও নামা যায় এ শহরে? 'জি' লেখা বোতামটার নীচে আরও কয়েকটা বোতাম। বিয়োগ চিহ্ন দিয়ে এক, দুই, তিন লেখা! এটা তো আগের বার লক্ষ্য করেনি? তবে সে কোথায় চলেছে? আরও নীচে? এতটা নীচে নামা যায় এ শহরে? ঘামছে পটাই। বাবা, বাবা বলে চীৎকার করেও লাভ নেই। কী করবে পটাই এখন? অনেকটা নীচে নেমে গেছে যে!
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের মেঝেয় পটাইয়ের অচৈতন্য দেহ উদ্ধার হল। দৈত্যাকার আবাসনের মেইন গেটে দাঁড়িয়ে হরু বাউন। প্রচুর নৈবেদ্য আর পকেটে অনেকগুলো টাকা গুঁজে দিয়েছে শহুরে ক্লায়েন্ট। দেয়নি ডাক্তারের সেবা। গার্ড একটা ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে ঝামেলা মেটালো। জ্ঞান ফিরছে পটাইয়ের। জানলার বাইরে তখন গেরুয়া আকাশে কালো পাখির ঝাঁক। মাঝে মাঝেই চাপা পড়ছে কালো কালো ইমারতের পর্দায়। দূরে ও কীসের শব্দ? ব্রিজ ভেঙে পড়ছে? নাকি হাজার বছরের পুরোনো শহুরে সভ্যতা? ঘোর ভাঙলে বুঝল, ব্রিজ নয়, স্বপ্ন ভাঙছে - উত্তরণের।
✍️পরীক্ষিৎ