"কদ্দুর রে তোর বাড়ি? আধঘন্টা ধরে হেঁটেই চলেছি! বললি, সামনেই! এটা তোর সামনে? তেমন বুঝলে টোটো নিতাম!" - রুক্ষ গলায় বলল সোহম।
"আলের ওপর দে টোটো!" -হাসল মিনু।
সাতসকালে ট্রেনে চড়ে, শুধু কেক আর চা চলেছে। সাঁইথিয়া স্টেশনে নেমে থেকে হেঁটেই চলেছি!
কেন? শুনুন তবে।
আমরা প্রতিভা খুঁজে বেড়াই। গ্রামে, শহরে, পাড়ায় পাড়ায়। আমি আর আমার ফটোগ্রাফার বন্ধু সোহম। একটু পাগলাটে বিষয় বটে, কিন্তু পয়সা আছে! সাধারণ আইটেমকে আইডল বানিয়ে মার্কেটে ভাইরাল করতে পারলেই ভাল কমিশন! চ্যানেলগুলোতে তো "ট্যালেন্ট হান্ট" প্রোগ্রামটা এখন সুপারহিট!
ভারী মিষ্টি গানের গলা বছর দশেকের মেয়েটার। ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষে করছিল। কুড়িটা টাকার বিনিময়ে কতগুলো বাউল গান পরপর শোনালো! ঠিক করলাম ওকেই প্রোজেক্ট করব! তাই ওর বাড়ি যাচ্ছি ওর মা-বাবার সাথে কথা বলতে।
পথে একটু জলযোগ করতেই হল। চা শেষ করে সিগারেট জ্বালিয়েছে সোহম। মিনু এখনো কচুরি খেয়ে যাচ্ছে। এই বসন্তেও কি ঝাঁঝ এখানকার রোদের! মাটিতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে ইহকাল পরকাল সবটা শুষে নেবে!
মেটে রঙের খড়ছাওয়ানো ঘরটা আমার চেয়েও বেঁটে! আদুল গায়ে, তেলচিটে গামছা পরা, কালো, মাঝবয়সী লোকটা বেরিয়ে এসে আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে!
"আমি মিনুর বাপ্। আপনেরা?"
"আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। টিভি চ্যানেল!ট্রেনে আপনার মেয়ের গান শুনে ভাল লাগলো। তাই "ট্যালেন্ট হান্ট" অনুষ্ঠানের জন্য ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। যদি আপনারা অনুমতি দ্যান, তাহলে ওকে আমরা কদিনের জন্য কলকাতায় নিয়ে যাবো। সাথে ওর মা-ও যাবেন।"
কালো, তোবড়ানো গাল, গামছা পরিহিত মানুষটার দৃষ্টিতে এখনও ভ্রু-কুঞ্চন!
"টিভি? তা আমাদের তো টিভি লাই বটেক্!"
"ও! ঠিক আছে। টিভি পাবেন মিনু সিলেক্ট হলেই!" সোহম বলে উঠল।
"মেয়ে, মা দুজনাকেই লিয়ে যাবেন? সে হবেক লাই! আমার চলবে কি করে? মেয়ের রোজগার। ওর মা না থাকলি রাঁধবে কে? বাচ্চাগুলোরে দেখবে কে? না বাবু। ওসব ট্যালেন হান আমার লাগবে নে। আমাদের তো ঐ মেয়ের ভিক্ষে আর ওর মা'র ঠিকে কাজ! একশো দিনের কাজটাও তো রোজ জোটে না! গরীবের ঘরে ওসব টিভি ফিভি লাগবে নে গো!"
বললাম - "আরে অত ভাববেন না? আপনার মেয়ের গানের গলা খুব ভালো! একবার সিলেক্ট হলেই দেখবেন অনেক টাকা রোজগার হবে! তখন কোনো চিন্তাই থাকবে না!"
কালো লোকটা কি একটা ভাবলো!
"না বাবু। ওর গান রেলের বগিতেই চলুক্। রোজ পঞ্চাশ ষাট কামাই আছে বটেক্। ও আমি ছাড়তে পারবো না।"
মিনুর বাপ ঘরে সেঁধিয়ে গেল নমস্কার জানিয়ে। পরিস্থিতি নেগেটিভ। ফিরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। আলপথে ব্যালেন্স করছি, হঠাৎ....
"বাবু! একটা কথা!"
মিনুর বাপের গলা! মানলো তাহলে! যাক্ বাবা!
"বলুন?"
"আপনেরা মিনুকে এক্কেরে নিয়ে যান না কেনে! আমরা ফেরৎ চাইবো না! ভাববো মরে গেছে! বদলে বুঝে শুনে একটা টাকা দে যান! সত্যি বলছি! কক্ষনো চাইতে আসবো নে! আপনেরা যা খুশি করবেন ওকে নে! কিচ্ছু বলবো নে! শুধু কটা টাকা.... আমরা খুব গরীব বাবু! খুব!"
আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! রোদের হলকায় পাঁজর পুড়ছে! নাকি ট্যালেন্ট পোড়া গন্ধ?
কোনো জবাব না দিয়ে ফিরে যাচ্ছি। পিচরাস্তায় মিনুর সাথে দেখা। একটা পাঁচশো টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে সোহমকে বললাম চল্, "আগে টোটো পেয়ে যাবো।"
টোটোর লুকিং গ্লাসে মিনুর মুখটা ক্রমশ ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিভা মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্তের মত। চোখের সামনে কালকূটের লেখাটা ভেসে উঠছে যেন -
"অমৃতের সন্ধানে গিয়েছিলাম। কি নিয়ে ফিরছি, জানি না। চোখের জল যে এতো লবণাক্ত, তা আগে কখনো টের পাইনি।"