বলছিলাম কি সমস্যাটা আসলে হল ‘খাপ’-খোলা নিয়ে। সে বিষয়টা মেরুণা মূর্মূ, স্বপ্নময় চক্রবর্তী বা পারমিতা ঘোষ (হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই দেখছেন, পারমিতা ঘোষের কথাই বলছি) যিনিই হোন না কেন, কলের মুখে ছিপি লাগানোটা সবচেয়ে আগে দরকার। ‘যাহা খুশি বলিবার অধিকার’ ছাড়াও এ গণতন্ত্র লইয়া বহু কিছু করিবার আছে, কঙ্গনা রানাউত ছাড়াও বহু রোল মডেল আছে। তাই ফেসবুক নামক একটি ‘অসংরক্ষিত’ দেওয়াল পেয়েছেন বলেই যা মনে আছে ঝেড়ে দিলেন, এটা ঠিক হচ্ছে না ভাই !
না না আমি মোটেই সংরক্ষণ নিয়ে বলছি না। সেটা নিয়ে বলতে গেলে তো থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যেত। ডাক্তারীর যে সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ‘নীট’ (NEET) এই বছর তার ফল প্রকাশের পর এমনটাই হয়েছে অনেকের অবস্থা। কারণ এবার দেখা গেছে সংরক্ষিত (‘কোটা’র) ছাত্রছাত্রীদের ৮২% সাধারণ (মানে অ-সংরক্ষিত) ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ন্যুনতম নম্বরের চেয়ে বেশি পেয়েছে। মানেটা হল সংরক্ষণের সুবিধা না পেলেও তারা সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে লড়েই সুযোগ পেতে পারত। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন হচ্ছে সেটা নিয়ে কথা বলার আগে দেখে নেওয়া যাক সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের জ্বালাটা কোথায়।
জ্বালা মূলতঃ দুইপ্রকার ঃ ‘ওদের’ যোগ্যতা আর ‘আমাদের’ সুযোগ। এক, ‘ওরা’ কম যোগ্য হয়েও ডাক্তারী-ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে আর ‘ওদের’ জন্য ‘আমাদের’ (পড়াশোনা ও চাকরীর) সুযোগ কমে যাচ্ছে। এই যোগ্যতা মানে অবশ্যই পরীক্ষার নম্বর (বা র্যাঙ্ক)। যেহেতু ‘কোটা’র ছাত্রদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নম্বরের পাঁচিল কিছুটা ছোট করা থাকে, তাই এখানে যোগ্যতার (মানে ‘অ’-যোগ্যতার !) কথা ওঠে। তাহলে ‘কোটা’র বিরোধিতা করতে এযাবৎ যাঁরা এই যোগ্যতার কথা বলে এসছেন, নীট পরীক্ষার ফলাফলে তাঁদের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিৎ। কারণ দেখাই যাচ্ছে যোগ্যতায় ওরা আর পিছিয়ে নেই। তাও তো যোগ্যতার প্রশ্নে প্রথম প্রজন্মের একা একা পড়ুয়ার সঙ্গে শহরের এক ডজন গৃহশিক্ষকের লড়াইয়েরকথা বলিনি ওসব আপনি জানেন। কিন্তু ঘটনা হল বিরোধিতার মুখ অজস্র, একটা মুখ বন্ধ হলে অন্য মুখগুলো কথা বলে। তাই যোগ্যতার অভিযোগটি খারিজ হওয়ামাত্র যেকথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তা হল, তপশিলী জাতি-উপজাতিদের মধ্যে এত ছাত্র যখন সাধারণ ছাত্রদের মতই ফল করছে, তখন আর সংরক্ষণ কেন !
ওই যে প্রথমেই বললাম কথা তো বলে ফেল্লেই হল, ভেবে দেখার দরকার নেই কত গমে কটা রুটি হয়। আরে মশাই কোটা তো সত্যিই চিরদিন বহাল রাখার জন্য নয়, এটা চালু রাখা হয়েছে কিছু ‘পিছিয়ে পড়া’ মানুষে জন্য, যাঁরা সব সুবিধে ‘আমাদের মত’ করে পান না। যদি দেখা যায় সত্যিই তাঁরা আর পিছিয়ে নেই, তাহলে কোটা উঠে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছেন কি, যে সংরক্ষণ উঠে গেলে (মানে যদি সত্যিই উঠে যাবার মত পরিস্থিতি হয় !) আপনার লাভটা কোথায় ! ভারতের মোট জনসংখ্যার শতকরা যত ভাগকে ‘কোটা’র আওতায় আনা হয়, তাঁরা যদি সমান ভাবে যোগ্য হয়ে লড়াইয়ের মাঠে নেমে পড়েন তাহলে আর যাই হোক প্রতিযোগিতা যে কমবে না, আর ‘আমাদের’ কিছু সুবিধেও হবে না, সেটা বুঝতে বেশি কিছু লাগে না। ঠিক যেমন মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের চেয়েও এখন ‘আমাদের নিজেদের’ মধ্যেই প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে, কোটা-ফোটা কিছু নয় স্রেফ মেয়েরা মাঠে নেমে পড়েছে বলে! মানে যোগ্যতার প্রশ্নে বা সুযোগের প্রশ্নে কোথাও আপনি হালে পানি পাচ্ছেন না। সুতরাঙ সাধু, সাবধান, যাহা বলিবেন ভাবিয়া বলিবেন, পরে নিজের কথা নিজেকেই গিলিতে হইতে পারে।
আসলে কথাটা হল চারপাশে চোখ ফেললে বহুবিধ কোটা আমাদের নজরে পড়া উচিৎ; সেসব অলিখিত, অন্যায্য কোটা বিষয়ে অবগত থেকেও তাদের আমরা কিঞ্চিৎ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মেনে নিই। কয়েকলক্ষ টাকা খরচ করে কোটায় (রাজস্থানের) কোচিং নিয়ে যে ছেলেটি নীট বা ‘জেইই মেন’ পাশ করল তার দিকে তাকিয়ে আপনিও দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন, নিজের ছেলেকে ওখানে পাঠাবার সঙ্গতি ছিল না বলে। ভাবেন নি তো যে উচ্চশিক্ষা কি তাহলে ‘বড়লোকের’ জন্য সংরক্ষিত! পুলিশকাকুর ভাইপো বলে কিম্বা মেয়রের ভাইঝি বলে যারা যা যা পেয়েছে তাকেও ‘এমনই তো হয়’ বলে মেনেই নিয়েছেন। ভাবেননি যে এটা ক্ষতার কোটা। আর নিজের মেয়েটি যখন হোমরা-চোমরা বিজ্ঞানীর ‘রেকো’ নিয়ে অনেক ভালো আর একটি মেয়েকে ঠেলে দিয়ে রিসার্চ-ইন্সটিটিউটে’ চাকরীটা বাগিয়ে ফেলল, তখনও ভাবেননি যে এই চাকরী তাহলে আসলে ‘রেকো-কোটা’-য় পাওয়া চাকরী। মানে পিছিয়ে পড়াদের জন্য আইনি সংরক্ষণ নিয়ে ‘দুইখান কথা আছে’ কিন্তু এগিয়ে থাকা (পয়সা বা ভরসা দুরকম ভাবেই এগিয়ে থাকা)-দের বে-আইনি সংরক্ষণ নিয়ে ‘কোনো কথা নাই’।
জানি জাত-পাত নয় দারিদ্র নিয়েই আপনি ভাবেন তাই পদবী নয় অর্থনৈতীক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণ হলে আপনার কিছু বলার থাকবে না। ব্যাপারটা আপাতঃদৃষ্টিতে ঠিকঠাক মনে হলেও ভেবে দেখুন তো সংরক্ষণ কি কোনো দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প যে গরীবি-কে তার মাপকাঠি ধরা হবে ! উঁচুজাতের ‘গরীব কিন্তু মেধাবী’ ছাত্র-র জন্য বৃত্তি আছে, ঋণ আছে, তার তো সংরক্ষণ দরকার নেই। কারণ মেধাই যদি শেষ কথা হয় তাহলে সে তো মেধার জোরেই এগোবে। আর দারিদ্রকে একবার হারিয়ে দিলে জাতের জন্য তাকে কেউ পেছন থেকে টানবে না। কিন্তু এইখানে এসে আপনার মনে পড়বে পায়েল তদভি নামে সেই ডাক্তার মেয়েটির কথা, উঁচু জাতের দিদিরা যার বিছানায় পা মুছত; মেয়েটা ঘেন্নায় আত্মহত্যা করেছিল। আপনার মনে পড়বে সুব্রমণ্যম সাদ্রেলার কথা, কানপুর আই আই টি-র সদ্ব্রাহ্মণ প্রবীন বিজ্ঞানীরা যাঁকে চাকরী থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন তবে কিচ্ছু করতে পারেন নি। আর মনে পড়বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেরুণা মূর্মূ-র কথা; প্রায় সন্তানের বয়সী একটা মেয়ে এই সেদিন স্রেফ পদবীগত কারনেই যাঁকে ‘মূর্মূ সাঁওতালী’ বলে খোলা পাতায় লিখতে সাহস করেছিল। এবার বুঝছেন তো ব্যাপারটা ঠিক অর্থনৈতীক নয়, পুরোটাই অনর্থনৈতীক, যার থেকে বেরোতে গেলে তথাকথিত নিম্নবর্নের ক্ষমতায়ন দরকার; একেবারে আইন করেই এঁদের বসাতে হবে এমন সব জায়গায় যেখানে এমনিতে এঁদের যাবার সুযোগ নেই বললেই চলে। এর নামই সংরক্ষণ। বিভিন্ন উঁচু এবং সম্মানজনক অবস্থানে মুন্ডা-ওঁরাও-হেমব্রম-সাদ্রেলা (এই সব পদবীধারীরা মার্জনা করবেন, খানিক অল্পবিদ্যা বশতঃ এইভাবে পদবী ধরে উল্লেখ করতে হল) দের দেখতে পাওয়াটা আমাদের চোখে স্বাভাবিক হয়ে উঠুক, তখন নাহয় অন্য কিছু ভাবা যাবে।
এ সব কথাই আপনাদের জানা, বহুবার বলা কথা। তাই সংরক্ষণ নিয়ে আমি বিশেষ কিছুই বলতে চাই না, ব্যাপারটা বিপজ্জনক। আমি যেটা বলতে চাই তা হল যা বলবেন জেনে, বুঝে এবং ভেবে বলুন। হতেই পারে যে আপনি চারপাশে এমন সব মানুষকে দেখেছেন যাঁরা পদবী বা গরীবি কোনো ভাবেই পিছিয়ে থাকা নন অথচ ‘কোটা’র সুবিধেটা দিব্যি ভোগ করছেন। আপনার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আপনি দাবী করতেই পারেন যে এই ব্যবস্থাটা নিয়ে নতুন করে ভাবা হোক। এত বছর ধরে এত মানুষ যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ পুষে রেখেছেন তাকে পুরোটাই অগ্রাহ্য করা হয়তো উচিৎও নয়। আর সেটাই এতক্ষণ ধরে বলতে চাইছি, যে সকলের কথাই শুনতে হবে। আপনি মেরুণা মূর্মূর দলের হলেও পারমিতা ঘোষকে স্রেফ যা খুশি তাই বলে ‘কেমন দিলাম’ ভেবে (আসলে ‘আমি কি মহৎ’ ভেবে) কলার তুলে ঘুরতে পারেন না। ওর কথাও শুনতে হবে, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে। আপনি দলিত সাহিত্যের দলের হলেও স্বাপ্নময় চক্রবর্তীকে গালাগালি দেবার সময় ভুলে যাবেন না উনিও প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে অনেক লিখেছেন। কাউকেই স্রেফ গালাগালি দিয়ে, পুলিশে দিয়ে তার মতামত বদলানো যায় না। বরং তার কথা শুনুন, তার সমস্যাটা আগে নিজে বুঝুন, তার পর ঠিক করুন তাকে কি ভাবে বোঝাবেন। হ্যাঁ, কিঞ্চিৎ খর্চা আছে, সময়-পড়াশোনা-ভাবনা…ফেসবুকের জমানার পক্ষে এতটা কি বেশি আশা করে ফেললাম !
যুক্তিটা কিসুই দাঁড়ালো না, স্বপ্নময় চক্রবর্তী মুর্খের মত কমেন্ট করেছেন, তার সমালোচনা করার জন্য সাংঘাতিক পড়াশোনা কেন লাগবে আদৌ বুঝিনি।
হ্যাঁ, সমস্যা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন; কারণ প্রিভিলেজ ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক। লেখার মূল বক্তব্য ভালই লাগল।