প্রথম দুদিন ঠিক খেয়াল করেনি, তিন নং দিনে দীপ্ত লক্ষ্য করল, হ্যাঁ, মেয়েটা এদিকেই তাকিয়ে আছে। একটু দূরে বলে ঠিক চোখে চোখ পড়ছে না, কিন্তু তাকিয়ে আছে এটা নিশ্চিত। দীপ্তর উনচল্লিশ বছরের মনে বেশ একটা পুলক জাগে।
পুলক জিনিসটা অকারনেই জাগে, বেশ একটা খুশি খুশি মন, অকারন।
কোল থেকে নেমে জিমো রেলিং এর উপর তুলোর বলের মত গড়াতে থাকে। রেলিং খুব ঘন তবু একটু খেয়াল রাখতেই হয়। বলতে গেলে জিমোর জন্যই এই ব্যালকনিতে আসা শুরু হয়েছিল। সারাদিন ঘরে থেকে হাঁপিয়ে ওঠে জিমোটা। রনিতা থাকতে রনিতার সঙ্গেই সারাক্ষন থাকত। কিন্তু পুনে গিয়ে রনিতা আটকে গেছে। ভাগ্যিস ওখানে দিতিরা আছে, ননদের বাড়িই এখন কতদিন রনিতার ঠিকানা হবে তা কে জানে!
এর আগে ব্যালকনিতে সেভাবে আসেনি দীপ্ত, অন্তত এসে দাঁড়ায়নি কোনদিন, সময় জিনিসটা এভাবে কোনদিনও হাতে আসেনি স্কুল কলেজ চাকরি দিয়ে পরপর সাজানো ওর জীবনে। সবজায়গাতেই একটাই বীজমন্ত্র ছিল এ যাবৎ.... ব্যস্ততা।
এখন কাজ করতে করতে কিছুক্ষন অ্যাওয়ে হয় সেও অন্যদের মত। বেরোনো নেই, এমনকি নীচে নামাও সীমিত হয়ে গেছে, জিমোকে সারাদিন এককোনে গুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগে। তো সেই শুরু ব্যালকনিতে আসার।
সামনে সেটা ফ্ল্যাট নয়, তিনতলা একটা বাড়ি। তিনতলায় ঘর কম, তাই অনেকটা ছাদ। বেশ বাগান ধরনের অনেক টব, টবে টবে ফুলগাছ, ক্যাকটাস….. বোধহয় কিছু লঙ্কা, লেবু, টমেটো জাতীয় গাছও আছে। মেয়েটাকে খেয়াল করার আগে এগুলোই দেখত দীপ্ত। এখন প্রথমেই দেখে মেয়েটা আছে কিনা I হ্যাঁ আছে। তাকিয়ে আছে এদিকেই। কোন আড়ষ্টতা নেই, চকিত চেয়ে চোখ সরিয়ে নেওয়া নয়, তাকিয়েই থাকে।
এখান থেকেও বোঝা যায় বেশ সুন্দরী। কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া কালো চুল, অনেকটা মিথিলা পালেকরের মতোI রনিতা দেখত বলে ‘লিটল থিংস’ ওয়েব সিরিজটার দু একটা এপিসোড দেখেছিল সে, মিথিলা ছিল তাতে। এমনকি অনেকটা ওরকমই দেখতে মেয়েটা।
পিছনে হালকা হয়ে গেলেও মাথার সামনে দীপ্তর বেশ চুল আছে। ভুঁড়ি নেই বলে সমবয়সী অনেকের চেয়ে ইয়ং দেখায় হয়ত.... তা বলে....মেয়েটা হার্ডলি কলেজে পড়ে। কী ভেবেছে ওকে? কলেজে পড়া ছেলে অতটা না ভাবলেও হয়ত ভাবছে নতুন চাকরী জয়েন করেছে। লকডাউনে মুখে বেশ জঙ্গল জমেছে---সেটা কি ওকে আরো ফেবার করেছে তবে!
এই জানুয়ারীতেই ওদের এই ফ্ল্যাটে আসা, রনি মার্চে পুনে গেছে, এর মধ্যে রনিতাকে কি দেখেনি ও? অবশ্য রনিতারই বা সময় কোথায় ছিল ব্যালকনিতে আসার I রনিতাকে কি দীপ্তর থেকে বয়স্ক দেখায় নাকি? এ্যাঁ?
লাল টি-শার্টটা রনিতা কিনেছিল যখন, একটু বেশী রকম লাল বলে মনে হয়েছিল I রনিকে বলেছিল সে, “কটকট করছে না রং টা?”
না অতটাও নয়, আজ দেখল যখন, মনে হল। লাল রং ততটা পরেনা ….কেন পরেনা ? আজ ওটা পরেই জিমোকে নিয়ে ব্যালকনিতে যাবে ভাবছে যখন, তখনই বিভু দরজা খুলে কোথাও গেছে, আর জিমো খোলা দরজা পেয়ে দে ছুট। আসলে নীচের মাঠে খেলার অভ্যাস ছিল ওর। তাড়াতাড়ি নামতে হল দীপ্তকেও। নেমেই দীপ্ত ওকে দেখল। সেও নেমে এসেছে নীচে। নিজেদের গেটের কাছে। মুখে মাস্ক কিন্তু দুটো চোখ সোজা এদিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যে লাগল..... ছেলেদের এরকম লাগলেও কি শিহরনই বলে?
এ তো একেবারে স্পষ্ট, কোথাও কোন আভাস রাখছে না সে। ব্যালকনিতে গেলে এখন অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে দীপ্তরও দেখা সে আছে কিনা।
মনে গুনগুন করে যেন কেউ গাইছে.... “ইস প্যার কো ম্যয় ক্যা নাম দুঁ....”
রনিতা জীবনে আট বছর, তখন খুকি ছিলে তুমি কন্যা....তবু,... এবং তবু....
কিন্তু কী একটা অদম্য টানে আবার আজ জিমোর পাহারা আলগা হল আর দীপ্তও একছুটে নামল নীচে। হ্যাঁ, ওই তো এসেছে নীচে। সেই দরজার সামনে…..মুখোমুখি।
জিমোকে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখল রনিতার ফোন এসেছিল। কলব্যাক করল না, পরে কথা হয়ে যাবে, থাক।
রনিতারও একজন প্রেমিক ছিল, সেটা বললেও ব্রেকআপের কারন রনিতা বলেনি। কিন্তু এখন পুনেতে আছে সে ছেলে, এটা জেনেছিল দীপ্ত। কে জানে রনিতার এত ঘন ঘন পুনেতেই কাজ পড়ে কেন? ও কী আবার ফিরে যেতে চায় তার কাছে? চাইবে কি?
চাইলে কী বলবে দীপ্ত?
এই যে রনিতা নেই, খুব কি বিরহ হচ্ছে মনে?
চোখ বন্ধ করতেই....... একরাশ ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল...চোখটা খুলে ফেলল সে।
কী হল কে জানে! সেই কলেজের প্রথমদিকের দিনগুলোর মত ছটফট করছে মনটা। একটা তীব্র টান..এখন ব্যালকনির থেকে নীচের মাঠ বেশি টানছে I
জিমোটাও লকডাউনে কাবু হয়ে থাকে, আজ খোলা মাঠে গড়াচ্ছে মনের আনন্দে, আর সেই চোখ….I
হঠাৎ পাশ থেকে একটু হালকা গলা ঝাড়ার মত শব্দে দীপ্ত তাকিয়ে একটু তফাতে একজনকে দেখতে পেল, যে ভদ্রলোকের মুখোশের ভেতর হাসিমুখটা বোঝাই যাচ্ছে।
"আপনার ডগি খুব সুইট। একেবারে তুলোর পুতুল ডগির মত।"
বললেন তিনি, "কী ভালো লাগছে, কী দুষ্টু দুষ্টু ছোটাছুটি.....”
তারপর মুখের হাসি মিলিয়ে দিয়ে বললেন, "আমাদের ছিল জানেন, একেবারে হুবহু আপনারটার মত। এতো সুন্দর আর আদুরে ছিল কী আপনাকে বলব I ঐ যে আমার মেয়ে, ওর তো যাকে বলে প্রানের মত, এই এতটুকুনি এনেছিলাম কিনা। ড্রপারে করে দুধ খাইয়ে ওই বড় করেছিল। হঠাৎ কী হল কে জানে, দুদিন ঝিমিয়ে থেকে মরে গেল I"
ভদ্রলোকের গলা ধরে এল, "এ হল মাস ছয়েক আগের কথা। মেয়েটা তো কতদিন খায়নি, ঘুমায়নি কেঁদেকেটে, মনমরা হয়ে থাকত। তারপর সেদিন হঠাৎ আমাকে বলল আপনার ডগির কথা। একেবারে নাকি আমাদের তুসোর মত। সেই থেকে আপনারটা দেখে দেখে ওর দিন কাটে। কী আর বলব, মধ্যে একজন বলেও ছিল এনে দেবে ওমনি একটা, আর তারপর তো কী যে হয়ে গেল, এই করোনা ভাইরাস.... একেবারে ভাবনার বাইরে সব.....”
ভদ্রলোক মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
ফোনটা আগেও একবার বেজেছে। এবার তুলতে রনিতা বলল, "কী এত ব্যস্ত বলো তো? ফোনটা ধরও না। কবে যে ফিরতে পারব! আর পারছি না।" তারপর বলল, "এই, কী করছিলে?"
"লকডাউনের প্রেম।"
রনিতা বোধহয় শুনতে পেল না, বা শুনলেও বুঝল না। ও নিজের কথা বলতেই থাকল।
বাঃ ।....দারুণ লাগল