বাঘ ও সেতার -খুবই ভালো লাগল ঘ্ন
যাঁরা খেরোর খাতায় নতুন লেখালিখি করছেন, গুরুচণ্ডা৯-র টেকনিকাল ফীচারগুলো তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য আগামী শনিবার ভারতীয় সময় রাত ৮-১০টা আমরা একটা ওয়েবিনার করছি গুগল মীট-এ। ইচ্ছে আছে আগামী কয়েক সপ্তাহ জুড়ে প্রতি শনিবার ঐ নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েবিনার করার। আপনাদের কী কী অসুবিধে হচ্ছে লিখতে বা একটা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গুরুচণ্ডালির পূর্ণ স্দ্ব্যবহার করতে, সেটাও আমরা নোট করব, যাতে এটাকে আরও উন্নত করা যায়, প্রযুক্তিগতভাবে। সম্ভব হলে থাকবেন। শনিবার রাত আটটায় নিচের লিংকে ক্লিক করেই মীটিং এ জয়েন করা যাবে।
@আরকারুপ ( গুগল পদ্ধতিতে দেখি কিছুতেই ট্যাগ হয়না, উলটে নিজের থেকে নাম বাংলা করে দেয় !! তাও এই বিকট বানানে )। জানিনা, অর্করূপবাবু নোটি পাবেন কিনা।
লেখাটা বেশ ইন্টারেস্টিং তো ! গানগুলোর ইউটিউব লিঙ্ক ও সংগে দিয়ে দিলে পড়ার মাঝে মাঝে বাজিয়ে বাজিয়ে শুনলে আরও ভাল বোঝা যেত। বিভিন্ন ঘরানার সেতারের নমুনা দিয়েও। খুঁজে খুঁজে অবশ্য শোনাই যায়।
'সেতার বাদনের মূলত দুটি ঘরানা বা স্কুল প্রচলিত - বীণকার ঘরানা এবং গায়কি ঘরানা । প্রথম ঘরানা মূলত ধ্রুপদের অনুসারী , দ্বিতীয় ঘরানা খেয়ালের ; বীণকার ঘরানা ধীরে সুস্থে আলাপ করে এবং যন্ত্রের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যকে বাজনার আলাপে পুরোমাত্রায় এক্সপ্লয়েট করে। তারের ওপর এই বিশেষ শৈলীর কারণে বলা হয় তন্ত্রকারী (তন্ত্রী = তার)। ধ্রুপদের অনুসারী বলে এই ঘরানার বাদনশৈলীতে মন্দ্র সপ্তক বা বেস অক্টেভের প্রয়োগ হয় বেশি এবং সেতারে সেই গম্ভীর ধ্বনি আনতে দুটি বিশেষ তার বসানো হয়ে থাকে । এই তার দুটিকে বলা হয় খরজ এবং খরজ পঞ্চম (অতি মন্দ্র সপ্তকের সা এবং পা ) । সেতারের অন্যান্য তারগুলির আওয়াজ তুলনায় চড়া হওয়ায় দুয়ের সম্মিলনে বীণকার ঘরানার সেতারের আওয়াজ অনেকটাই আলাদা। গায়কি ঘরানা কন্ঠ সঙ্গীতের অনুসারী , মানুষের গলায় সুর লাগানোর পদ্ধতিকে এই সেতারে আনবার চেষ্টা করেন বাদক , খেয়াল গায়নে মন্দ্র সপ্তক বেশি ব্যবহার হয়না তাই এঁদের খরজের তারের প্রয়োজন হয়না। '
এটা পড়ে দু'তিনটে প্রশ্ন মনে হল । খেয়াল আর ধ্রুপদ দুইই তো গাওয়া হয়। তাহলে খেয়ালের সংগেই কণ্ঠসংগীত আসোসিয়েট করা কেন ?
আর সেতারের থেকেও বেশি কথা বলে বলে মনে হয় সারেঙ্গি, এস্রাজ, বেহালা শুনলে। কেন মনে হয়, এর সঙ্গে মন্দ্র, তারসপ্তকের প্রয়োগ, তারের আওয়াজ , সম্পর্ক নিশ্চয় আছে, থাকলে সেনিয়েও যদি লেখেন।
বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।
(নিখিল বন্দোপাধ্যায় সত্যজিতের সঙ্গে কোন ছবিতে কাজ করেছেন?)
সেতারে "গায়কী অঙ্গ" এই কথা বোধহয় বিলায়েত খাঁ সাহেব প্রথম প্রকাশ্যে বলেন। হয়ত ওনাদের ঘরে, মানে ইমদাদ খাঁ সাহেবের ঘরে, কথাটা চালু ছিল। সাধারণের মধ্যে চালু করেন বিলায়েত খাঁ সাহেব। তখন এই নিয়ে বেশ ঘোঁটও পাকিয়েছিল। শুনে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, "তাহলে আমরা কী বাজাই? ঢোলক অঙ্গ?"
তা যাক, আসল কথা হল সেতারে বাঘের ডাক। প্রথম খটকা - "পায়ে পড়ি বাঘমামা"-য় কি সেতার বেজেছে? আমার তো শুনে বীণা মনে হল। ওই টিম্বার সেতার থেকে বের করা যায় বলে মনে হয়না।
তবে সেতারের তার থেকে ইন্টারেস্টিং আওয়াজ বের করা পুরনো কায়দা। দেবাশিস দাশগুপ্তর লেখায় পড়েছিলাম, অনুপম ঘটকের পরিচালনার রেকর্ডিঙে লক্ষণ ভট্টাচার্য সেতারে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বের করছেন। অনুপম ঘটক জিগেস করলেন, "ওটা কী করছেন?" ভদ্রলোক বলেছিলেন, "সকালের রাগে গান তো, তাই তালে তালে কাক ডাকিয়েছি।" দেবাশিসবাবু লিখেছেন, ঠিক কাকের ডাক না হলেও, খরজের তারে তৈরি আওয়াজ একটা মাহোল তৈরি করেছিল।
পরে কিশোরকুমারের "এই যে নদী" শুনতে গিয়ে সেতারে এক ঝাঁক কাকের ডাক শুনলাম। গানের একদম শুরুতে, প্রথম পাঁচ সেকেন্ড শুনুন। শুনতে পাবেন।
আরে ওটা কাক নয়, নদীর জলস্রোতের শব্দ।
ঠিক আছে, তাই সই - জলস্রোতের আওয়াজ।
সম্বিৎবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বলি - অবশ্যই সেতার বেজেছে , আলাদা গঠনের সেতার। দু ধরনের সেতার হয় মূলত। খরজ পঞ্চম সেতার এবং গান্ধার পঞ্চম সেতার , এখানে খরজ পঞ্চম সেতার (রবিশঙ্কর , নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) ব্যবহার হয়েছে ; মাইহার ঘরানা যেহেতু ধ্রুপদী আলাপের অনুসারী তাই ধ্রপদী মন্দ্র সপ্তকের আওয়াজ তাঁরা সেতারে আনতে চেয়েছিলেন এবং সুরবাহারের তারদুটিকেই সেতার এনে বসান , ফলে আওয়াজের সেই গম্ভীর আওয়াজ আনতে কোনো অসুবিধা হয়না ।
নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় "দ্য ইনার আই" তথ্যচিত্রের জন্য কোমল ঋষভ আশাবরী বাজিয়েছিলেন , তথ্যচিত্রের শেষের দিকে শুনতে পাবেন ।
আরেকজন প্রশ্ন করেছেন শুধু খেয়ালের সঙ্গে কেন গায়কি অঙ্গকে অ্যাসোসিয়েট করা হয় , আসলে যেকোনো যন্ত্র (বিশেষ করে ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্র) মাত্রই সে মানুষের গলার মাইমেসিস করে। আলাদা করে গায়কি অঙ্গ বলে সত্যি কিছু হয়না , কারণ বীণায় যে আলাপ বাজে তা কণ্ঠেরই অনুসারী । তবে ডিস্টিঙ্গুইশ করার সুবিধার জন্য ওঁদের সেতারের স্টাইলকে গায়কি স্টাইল বলা হয় ।
দ্বিতীয় যে প্রশ্ন করেছেন যে , সেতারের থেকেও সারেঙ্গি , এস্রাজ , বেহালা বেশি কথা বলে - একদম ঠিক ! কারণ সেগুলি বোয়িং ; সেতার , সরোদ প্লাকিং - কিন্তু এক্ষেত্রে সারেঙ্গি বা এস্রাজ ব্যবহার করলে গানের প্রতি সুবিচার করা হোতো না কারণ ওই যন্ত্রে খরজের তারের মন্দ্রধ্বনি নেই । রণধীর রায় এস্রাজে পঞ্চমের তার লাগালেও খরজের তারে আলাপ করেননি কখনো । তাছাড়া সেতার প্লাক করে বা টোকা দিয়ে বাজানো হলেও আঙুল দিয়ে টেনে বা মীড় দিয়ে ভোকাল এফেক্ট আনা হয় , এই সুবিধা খরজের তারে সবথেকে বেশি । খরজের তার খুব মোটা , ফলে একটা টোকা পড়লে তার রেশ থাকে অনেকক্ষণ এবং ফলে ভোকাল এফেক্ট আনা সোজা তবে পরিশ্রম এবং সাধনাসাপেক্ষ। রবিশঙ্করের প্রথম যৌবনের বাজনায় , নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপের খরজ অংশ শুনে দেখবেন , ভোকাল এফেক্ট বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না।
সম্বিৎবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বলি - অবশ্যই সেতার বেজেছে , আলাদা গঠনের সেতার। দু ধরনের সেতার হয় মূলত। খরজ পঞ্চম সেতার এবং গান্ধার পঞ্চম সেতার , এখানে খরজ পঞ্চম সেতার (রবিশঙ্কর , নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) ব্যবহার হয়েছে ; মাইহার ঘরানা যেহেতু ধ্রুপদী আলাপের অনুসারী তাই ধ্রপদী মন্দ্র সপ্তকের আওয়াজ তাঁরা সেতারে আনতে চেয়েছিলেন এবং সুরবাহারের তারদুটিকেই সেতার এনে বসান , ফলে আওয়াজের সেই গম্ভীর আওয়াজ আনতে কোনো অসুবিধা হয়না ।
দুটি বাজনা রইলো, রবিশঙ্করের নটভৈরব এবং নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারুকেশি , দুজনেই শুরু করেছেন খরজ আলাপ দিয়ে। মন দিয়ে শুনুন , আওয়াজের সাদৃশ্য বোঝার চেষ্টা করুন , আমি নিজে সেতার বাজাই এবং একই ঘরানায় শিক্ষা পেয়েছি , খরজ আলাপ অত্যন্ত প্রয় অঙ্গ এবং তারের সেই টিম্বার প্রতিদিনই বার হয়। কাজেই এই আওয়াজ আমার পরিচিত। তাছাড়া টেকনিক্যালি বীণার স্কেল বেশ নিচু , পায়ে পড়ি বাঘমামা গানটি বেজেছে ডি স্কেলে , অত উঁচুতে বীণা প্রথমত চড়ানো যায় না , গেলেও যে আওয়াজ বেরোবে তা শুনতে অত্যন্ত শ্রুতিক্টু লাগবে। কিন্তু সেতার ডি স্কেলে ভালোই বাজে , এবং সেতারের গঠনের জন্যই তাতে খরজের তার ওই স্কেলে চড়াতে অসুবিধা হয়না। প্রসঙ্গত নিখিলবাবুর বাজনার লিঙ্কটিও খুললে শুনবেন তিনি ডি স্কেলেই বেঁধেছেন , এবং তাতে শুরুতে খরজ কীরকম বেজেছে শুনে আশা করি বুঝবেন। রবিশঙ্করের রেকর্ডটি অবশ্য সি স্কেলে , তাতে কিছু অসুবিধা নেই।
আপনি বক্তব্য নাই মানতে পারেন , কিন্তু প্রতিদিনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর সত্যতা যাচাই করে চলেছে ।
রবিশঙ্করের রেকর্ডটিতে - প্রথম সাতাশ সেকেন্ড
নিখিল ব্যানার্জির রেকর্ডটিতে - প্রথম দেড় মিনিট।
যদি আরও প্রমাণ চান , তাই এদুটিও দিলাম। এতে সেতারে খরজের টিম্বারের আরও ভালো বুঝতে পারবেন । নিখিল ব্যানার্জির বাজনাটিতে ৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড থেকে শুনতে শুরু করুন। রবিশঙ্করের বাজনাটিতে ৭ মিনিট থেকে। আশা করি চারখানি প্রমাণের পর সংশয় দূর হবে। প্রসঙ্গত , রবিশঙ্করের এই রেকর্ডটি পুরিয়া ধানেশ্রী রাগের অর্থাৎ যে সুরে সত্যজিৎ আমাদের আলোচ্য গানটি বেঁধেছিলেন , কাজেই খরজের চলনে মিলও পেয়ে যাবেন।
আমি সত্যজিতের ওপর তিনটে বইয়ে খুঁজলাম যদি এই ব্যাপারে কোন দিশা পাওয়া যায়। পেলাম না।
ভিডিওগুলোর জন্যে ধন্যবাদ। আমার বক্তব্য তাও একই রইল। দেশি প্লাকড স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্টের প্রায় সবেতেই অতি-উদারায় এই নাদ বের করা যায়। সরোদেও পাওয়া যাবে। আমার বক্তব্য সেটায় ছিল না। এই নিচু নোটের ব্যাপার ফিজিক্সের হিসেবে ফ্রিকোয়েন্সির এলাকা। আমি বলছিলাম টোনাল কোয়ালিটি সম্বন্ধে, যেটা ফিজিক্সের হিসেবে কতগুলো হারমোনিক্স, ওভারটোন লাগছে তার ওপর নির্ভর করে। (তিরিশ বছরের পুরনো ফিজিক্সের ফান্ডা, আশা করি বেসিক ফিজিক্স এখনও বদলে যায়নি)। স্পেক্ট্রোমিটারে না ফেললে সেটা বিচার করার একমাত্র উপায় কান। সেই বিচারে আমি এখনও বীণার দিকে ভোট দেব। তবে এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। লেটস এগ্রি টু ডিজেগ্রি। বরং আপনার বাজনার ডিজিটাল কপি থাকলে শুনতে আগ্রহী।