১৯১২য় তাঁর জন্ম। গেল আগস্টের ২০ তারিখে ১০০ বছর পূর্ণ হল। এখন যে মনে হয় একশো বছর কিছুই নয়। এই তো সেদিন দেখতাম এই বড় লেখক তাঁর শীর্ণ শরীর নিয়ে শিয়ালদার দিক থেকে হেঁটে আসছেন সাবেক হ্যারিসন রোড, হাল মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে। হাতে একটি ছাতা, কোনো হাতব্যাগ থাকত কিনা মনে নেই। অনেকদিন তো হল, ১৯৭৫-৭৬ হবে। ৩৫-৩৬ বছর আগের কথা। ছাতাটি নিয়ে তিনি একটি আশ্চর্য গল্প লিখেছিলেন। বানিজ্যিকভাবে অসফল এক লেখকের কথা ছিল সেই গল্পে। কিন্তু গল্পটি তাঁর নয়, গল্পটি সেই ভাগীরথি প্রকাশনীর কর্মচারী গোলকের। গোলকের নয়, তার ছাতার। ছাতাটি বহুকালের পুরনো, কতবার যে রিপেয়ার হয়েছে, তার বাঁট, তার কাপড়, এটা ওটা কতবার যে বদলেছে গোলক তার কোনো ঠিক নেই। এই ভাবে বদলাতে বদলাতে আসল ছাতাটি আছে কিনা সন্দেহ। সেই ছাতা গোলকের প্রাণ। ছাতা নিয়েই বই পাড়ায় সে পরিচিত। বই-এর বিক্রিবাটা নেই, নিঝুম বসে আছে গোলক। তখন লেখক মুরারি মাইতি ধানবাদ থেকে এসেছেন আট বছর আগে ছাপা তাঁর মেঘলা আকাশ নামের বই-এর খোঁজ নিতে, কতটা বিক্রি হল, নতুন বই আবার ছাপবেন কিনা প্রকাশক। লেখক ভাল ব্যবহার পান না গোলকের কাছে, কত নামী দামী লেখকের বই বাজারে কাটছে না। শহর, বইপাড়া অশান্ত, মিটিং মিছিল লেগেই আছে। বোমা পড়ছে সবদিনই প্রায়। সেই সময়, ১৯৭০-৭১ এর কলেজ স্ট্রিট আর বইপাড়ার চেহারাটি রয়েছে গল্পে। লেখক বই-এর খোঁজ নিচ্ছেন, তখনই বাইরে ভীষণ শব্দ, বোমা পড়ল বোধ হয়। কৌতুহলে ছুটে বেরিয়ে গেল গোলক, তেমন হলে তো ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে। না, টায়ার ফাটার শব্দ। গোলক খবর নিয়ে ফিরে এসে দেখে লেখক নেই। বুকটা ধক করে উঠল। সে দেওয়ালে ঝোলানো তার শার্টের নীচে রাখা সেই পুরনো ছাতাটি দেখল আগে। আছে কিনা, না লোকটা নিয়ে গেল। ধুলিমলিন মেঘলা আকাশ, আর সব না কাটা বই-এর চেয়ে গোলকের কাছে বহুবার রিপেয়ার করা ওই ছাতাটির দাম বেশি।
কলেজ স্ট্রিটে সেই সময় পুস্তক প্রকাশনী নামের একটি সংস্থা ছিল। তাঁর কর্ণধার কনকবরণ মিত্র ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর অসম্ভব অনুরাগী। কনকবাবুর ওখানে যেতেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সেই সময় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছিলেন কনকবাবু। তখন আমি সদ্য চাকরি পেয়ে দূর পশ্চিম সীমান্ত বাংলা - মেদিনীপুর, বিহার আর ওড়িশার সংযোগস্থলে গোপীবল্লভপুর থানার এক গ্রামে। কলকাতায় এলে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না। ফেরার দিন সন্ধ্যেয় বঙ্গ বিহার ওড়িশার সংযোগস্থল জামশোলা ব্রিজে নেমে প্রবেশ করতে হত ভিতরে। আমি কলকাতায় বেড়ে ওঠা যুবক, আমার ওই যে যাওয়া আর সেই আদিবাসী অধ্যুসিত এই গল্প অগ্রজ আর বন্ধুদের কাছে করতাম ফিরে এসে। একদিন পুস্তক প্রকাশনীতে গিয়ে দেখি তিনি। কী আশ্চর্য! বসে আছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। কনকদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রণাম করে তাঁর মুখোমুখি। তাঁর পুত্র তীর্থংকরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সদ্য। পরে হয়েছিলাম অভিন্ন হৃদয়। সেই তো প্রথম দেখা। সেই তো কথা বলা। তাঁর আনেক গল্প তখন পড়া হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই ‘ছিদ্র’ গল্পটি নিয়ে খুব আলোড়ন হয়েছিল। অশ্লীল অশ্লীল বলে সাহিত্যের কিছু গার্জেনরা গোলযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। গিরগিটি গল্প নিয়েও তাই হয়েছিল। ক’দিন আগে পুজো সংখ্যায় পড়েছি ‘সামনে চামেলি’ নামের এক আশ্চর্য সুগন্ধে ভরা গল্প। সুগন্ধের কথা বললাম, তাঁর লেখার ভিতরে বর্ণ, স্পর্শ, গন্ধ – সব পাওয়া যায়। সামনে চামেলিও ছিল এক ব্যর্থ মানুষের গল্প। বিষাদময়। কিন্তু তার ভিতর থেকেও বুঝি এক সুগন্ধ বেরিয়ে আসে।
“সেই একটা রাস্তা। ভারি সুন্দর। আপনারা দেখেছেন কি! খুব নির্জন। হয়ত দেখেছেন, মনে নেই। তার মানে যতটা মন দিয়ে দেখার দরকার, ততটা মন ছিল না। যে জন্য রাস্তাটা ভুলে গেছেন। এই হয়।
কেন না চলতে চলতে দেখা, আর দ্দেখবার জন্য থমকে দাঁড়ান এক কথা নয়। (সামনে চামেলি)”
সে ছিল একটা নির্জন রাস্তা আর সেই রাস্তায় ক্রাচ বগলে সে হাঁটে। দুঃখী, বঞ্চিত আর ব্যর্থ মানুষের কল্পনা আর আকাঙ্খার গল্প। খুব বড় লেখক, আমার পিতৃতুল্য লেখক জিজ্ঞেস করতে লাগলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তখন তিনি শিশুর মতো। আমরা যারা ওই পুস্তক প্রকাশনীতে যেতাম, শচীন দাস, সমীর চট্টোপাধ্যায়, কখনো কবি তুষার চৌধুরী এবং পবিত্র মুখোপাধ্যায় – সকলেই তাঁকে পড়েছেন। তাঁর নানা লেখা নিয়ে আমাদের নানা কৌতুহল নিরসন করতেন হয়ত কখনো, কিন্তু বারবার প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতেন। আমার মনে আছে তাঁকে শুনিয়েছিলাম আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার কথা। গ্রামীণ যাত্রাদল আসছে শীতের ধানকাটা মাঠ ভেঙে, সুবর্ণরেখা নদী পার হয়ে। হিরোইনের কোলে দুধের বাচ্ছা। কোন ভোরে বেরিয়েছে ধ-ডাংরি যাত্রাদল। বেলা বারোটার পর এসে পৌঁছল। হিরোইনের মাথার চুলে খড়কুটো, বাচ্ছা কাঁদছে। রাস্তার দুপারে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের চাষাভুসো মানুষজন দেখছে তাকে। কে যেন হেঁকে উঠে ডাকল আমাকে, হিরোইন হিরোইন দেখুন স্যার... তিনি মগ্ন চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। আমি কুন্ঠিত গলায় বললাম, আপনি এইটা নিয়ে লিখবেন?
হাসলেন তিনি, বললেন, তুমি দেখেছ, অনুভব করেছ, তুমি লিখতে চেষ্টা করো, আমি তো এসব দেখিনি।
খুবই নিমগ্ন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর লেখা তাঁরই মতো। এখনো মনে হয় তাঁর কোনো পূর্বসুরী বাংলা সাহিত্যে ছিল না। আর তাঁর মতো আধুনিক লেখকও বাংলা সাহিত্যে বিরল। কবি জীবনানন্দের অসম্ভব অনুরাগী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গভীর নিমগ্ন-মর্বিড লেখার সঙ্গে পরে জীবনানন্দের অনুভূতিময় গদ্যের কোথাও বুঝি মিল আছে, কিন্তু সেইসব গদ্য খুঁজে বের করে ছাপা যখন শুরু হয়, তখন তিনি প্রয়াত। সেই গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের শেষে নদী ও নারী গল্প দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। ১৯৭৯-তে প্রয়াণের সময়ও অসম্ভব সক্রিয়। তাঁর গল্পের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম। মনে পড়ে কত গল্পের কথা। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন রূপ আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক লেখক। অন্তরের রূপ আর বহিরের রূপ, দুই-এর কথাই বার বার ফিরে এসেছে। আর সেই রূপের সাক্ষী যারা, তারা তো একেবারে ব্যর্থ, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অসফল মানুষ। গিরগিটি গল্পটির কথা মনে করি না কেন, বুড়োটা প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকে মায়া কখন আসবে কুয়োতলায়। বুড়োটা একেবারে ক্ষিন্ন জীবন যাপন করে, মায়াদের পাশের খোলার ঘরে থাকে। এ বাড়ির উঠোন যেমন ফাঁকা, কুয়োতলাটাও। মায়া চেয়েছিল এমনিই বোধহয়। কুয়োতলার চারদিক, এই উঠোনের এদিক ওদিক নানা গাছগাছালি। বর্ষা ঋতু বলে উঠোনের ডান পাশের নিম গাছটি পাতা ও ফলে ভরে গেছে। পাকা নিমফল একটি দুটি মাটিতে পড়ছে...। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন প্রকৃতির রূপ মগ্নও। কুয়োতলায় একা একা স্নান করে মায়া। তার রূপ দেখে গাছগাছালি, পাখিরা, টিয়া বুলবুলিরা। তাতে কি হয়েছে, মায়া এই নির্জন কুয়োতলায় নিরাবরণ হতে পারে। আগে যেখানে ছিল ভাড়ায়, সেখানে পারত না। কুয়োতলায় মেয়েদের কি ভিড়। সেখানে একটি মেয়ের গা থেকে কাপড় সরে গেলে অন্য মেয়েরা সন্দেহভরা চোখে দেখত। মায়া এই নির্জন কুয়োতলায় নিরাবরণ হয়ে সুখে গায়ে জল ঢালার পর আচমকা টের পায় শুকনো পাতার উপর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসে। একটা হাড়ি হাতে করে বুড়ো ভুবন সরকার অদূরে পেয়ারা গাছের গা ঘেসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাঁকাটির মত সরু জিরজিরে হাত-পা, শুকনো খটখটে ক’খানা পাঁজর, শনের মত পাকা একমাথা লম্বা রুক্ষ চুল ও হলদে ফ্যাকাশে চোখ... এমন যার চেহারা, সে যদি কখনো মায়ার ধারে কাছে আসে, কি পাশ কাটিয়ে চলে যায়, পুরুষ বলেই মনে হয় না। মনে হয় মৃত নিষ্প্রাণ সহস্রক্ষতচিহ্নযুক্ত মাদার গাছটি।
সেই বুড়োর সঙ্গে মায়ার কথা হয় একটি দুটি। বুড়োর সঙ্গে মায়া নরম মনে কথা বলে। অস্থিসার সেই বুড়ো একদিন বলে, দিদিকে দেখলে তার ওই ডালিম চারাটির কথা মনে হয়। কোন ডালিম চারা? লেখক লিখছেন, “লম্বা ঋজু একটি মেয়ের সুন্দর দুটো বাহুলতার মতন সুগোল মসৃণ দুটো কান্ড আকাশের দিকে একটুখানি উঠে তারপর থেমে গেছে। তারপর কচি কচি ডাল।...।” নতুন গাছ, যৌবন লেগেছে গায়ে। বুড়ো গাছগাছালি, প্রকৃতির মত দেখে যুবতী মায়াকে। মায়ার সঙ্গে কথা বলে ধন্য হয়। মায়াও গোপনে টের পায় বুড়ো তার রূপে মুগ্ধ। তার রূপ দেখে বুড়ো, যেমন দেখে গাছগাছালি, পাখিরা, হাজার পাতার চোখ নিয়ে নিম গাছটি, ফড়িং, প্রজাপতি, কাক, বুলবুলি, শালিক যখন মায়ার হাত দেখছে, পা দেখছে, পিঠ, কোমর, ভুরু, চোখ, চুল, নখ – সে তো রাগ করে না, খুশি হয়। বুড়ো তো তেমনিই কেউ। দেখে, তাই মনে হয় বেঁচে আছে। বুড়ো যেন আয়না। গল্প থেকে শেষটুকু উদ্ধৃত করি,
‘এই জংলা ছিটের সায়াটা আমাকে কেমন মানিয়েছে বলছেন না তো, কেমন দেখাচ্ছে?’
খসখসে গলায় ভুবন হাসল।
‘বলব, বলছি, ওটা পরনে দেখে তখন থেকেই তুলনাটা আমার মনের মধ্যে কেবল নাড়াচাড়া করছে। চিতাবাঘিনী, বনের চিতার মতন চমৎকার সরু ছিমছাম মাজাঘষা কোমর দিদির।’
‘তাই নাকি, ঘরে গিয়ে আয়নায় দেখব তুলনাটা ঠিক হল কিনা।’
‘কেন, আবার আয়না কেন, আমার চোখকে কি দিদির বিশ্বাস হয় না?’...
মায়া বলেছিল, ‘বিশ্বাস করি, তা না হলে কি আর দুপুর রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই আয়নার সামনে দাঁড়াই, নিজেকে দেখি, বলুন?’
গিরগিটি গল্প যৌনতার নয়, সৌন্দর্যের। এমন সৌন্দর্যের গল্প আমাদের সাহিত্যে আর নেই। আমরা এমন গল্প পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা কাহিনির নানা ঘোরপ্যাঁচে অভ্যস্ত। মনের অতলে প্রবেশ করতে আমাদের খুবই অনীহা। আমরা রূপ-অরূপের খোঁজ রাখিনা, তাই গিরগিটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই সম্পাদককে নিরূপায় হয়ে কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। তবু তিনি ছেপেছিলেন সাহিত্যের সত্যকে চিনে। এই কথা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি ভারবি থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন মূল পাঠ, তাঁর মূল গল্পটি ছাপা হল না এডিট করা অংশ ছাপা হল। হ্যাঁ, এডিট করা গল্প শ্রেষ্ঠ শারদীয়ায় ছাপার পর গেল গেল রব উঠেছিল। অশ্লীল বলে তাঁকে দুষেছিল। এই চিৎকার তাঁর ছিদ্র গল্পের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। খুব লেগেছিল গড়পড়তা পাঠকের। এতটা সত্য কি সহ্য করা যায়! গল্প এগোতে এগোতে যে ওই সব দুর্জ্ঞেয় জায়গায় পৌঁছতে পারে তা আমাদের ধারণার অতীত ছিল। ভারবি প্রকাশিত সেই শ্রেষ্ঠ গল্পটি তিনি স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন আমাদের। বইটি আমার কাছে রয়েছে। কতদিন আগের কথা এসব। বইটিতে কী করে ঘুণ ধরল তা আমি জানিনা। আলাদা করে রেখে দিয়েছি। আমার ঈশ্বরের ছোঁয়া রয়েছে যে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখাটি কাগুজে গুরুতে প্রকাশিত।