কেকেদাকে বলছি।দ্যাখো যারা বিশ্বাসী এবং যারা অবিশ্বাসী, তাদের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। কারও ক্ষেত্রে পারিবারিক অভ্যাস আচারের ভেতর থেকেই বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, সে সেটা চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন শুনেছি বাঙালি হিন্দু বাড়িতে নাকি "সন্ধে দেওয়া" হয়। এগুলো নিশ্চয় তারা কোনও বিশ্বাস বা অভ্যাস থেকে করে। এর তো কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই এই ইলেকট্রিকবাতি ঝলমল যুগে। তবু করে। অভ্যাস বা বিশ্বাস।
আমি কোনওকালে এই রীতি আমার পরিবারে দেখি নি। কাগজে কলমে তো হিন্দু পদবী, হিন্দু পরিবারই বলা চলে। শ্রাদ্ধ টাদ্ধ বাদ দিইয়েছি নিজের জোরেই শিশু বয়সেই। বড়োরাও সে যুক্তি মেনে নিয়েছিল। তাই ধর্মান্ধ তো দূরে থাক ধর্মে বিশ্বাসী পরিবারে বেড়ে উঠি নি। তারপরে তো পুরো ম্লেচ্ছ সংস্পর্শ জীবন, যে দেশে ধর্মীয় আচার বা উৎসব কিছুই নেই, এমন জায়গায় বাস।
তাই বলে যারা বিশ্বাস করে, তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা অপমান করব? কেন? তাহলে আমার শিক্ষা কেমন?
যে মানুষের বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর, — তাকে তার বিশ্বাসের দুনিয়া থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে, অপমান করে, যুক্তি সহকারে নাস্তিক করে তুলে আমার কী উদ্দেশ্য সাধন হবে বলতে পারো?
সে যদি এক টুকরো পাথরের জন্য মনের জোর পায়, তার তো তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই। মনের জোরে সকলে পালোয়ান বা বলীয়ান হয় না। যার সেই জোরটুকু কম, তাকে অপমান করব কেন? তার ঐ আত্মসমর্পনেই যদি সুখ থাকে, শান্তি থাকে, তাকে সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনতে কি পারব আমি? তাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তির ফোয়ারায় ধুইয়ে দিলেও সে কি পারবে মনের জোরটুকু তৈরি করে নিতে? বরং ঐ পাথর হোক কি তাবিজ, বা গাছে কি থানে সুতো বাঁধা, ঢিল বাঁধা, মানত করা, এসবে তার শান্তি আছে। প্রত্যেককে আমার মতই হতে হবে কেন?
সে শান্তিটুকু কতদিন পাচ্ছে সেটা বড়ো নয়, অল্প সময়ের জন্য হলেও তো পাচ্ছে। আমরা সকলেই একদিন মরে যাবো, সে তো আটকানো যাবার নয়।
মানুষ মানুষকে দুঃখের দিনে সান্ত্বনা দেয় না? পাশে এসে দুটো ভাল কথা বলে না? তাতেই তো কতকটা দুঃখ কমে যায়। বন্ধ্যাত্ব নিয়ে বারবার করে বলছি যেমন, যে মেয়ের সন্তান হচ্ছে না বলে সে দুঃখে মুষড়ে পড়েছে, ক্রমাগত সমাজের কাছে অপমানিত হচ্ছে, সে মেয়ের মনের জোর যদি কম থাকে, তবে কি সে মরেই যাবে? মনের দোর কম থাকার জন্য অন্যরা তাকে ডিস্ক্রিমিনেট করলে সেটা নিন্দনীয়। মেয়ে হয়ত হাজারহাত কালীতলায় মানত করল, কিংবা বনবিবির থানে হত্যে দিল, তারপরে তার মনের ভেতরের সেই অসম্ভব কষ্টের একটা বড়ো অংশ সে ঐ ঠাকুরের থানেই সঁপে এসেছে এই বিশ্বাস নিয়ে যে ঠাকুর চাইলে কোলে সন্তান আসবে। কতকটা সময়ের জন্য তার মন নির্ভার। অনেক সময়ে দেখা গেছে কোলে সন্তান এসেছে, অনেক সময় আসে নি। তবে কটা দিনের জন্য হলেও সে শান্তি পেল।
আমি আমার জীবনের একটা সময়ে অনুভব করেছি যে লোকায়ত বিশ্বাস আমাদের মত সাধারণ মুখ্যু সুখ্যু মনের দিক থেকে কমজোরিদের জন্য বেশ নির্ভর করার মত আস্তানা। বনবিবিতলায় গাছে সুতো বাঁধা, কি বটঅশ্বত্থের তলায় এক টুকরো সিঁদুরমাখা পাথর আর যাই করুক মনটাকে অনেক শান্তি দেয়। এই অজস্র হিংসা হানাহানি ঝগড়া ঈর্ষার ক্রমবর্ধমান এনট্রপি থেকে কতকটা সময়ের জন্য আগলে রাখে। সকলেই তো একই লক্ষ্যে চলেছি, মৃত্যু। এই জগৎটা সেভাবে দেখলে মায়া।