:-) এর টিপ্পনি পড়ে একটা পুরোনো হোয়া পোষ্টের কথা মনে পড়লো। প্রেক্ষিতটা ভিন্ন কিন্তু :-) এর শ্লেষে উদ্ভাসিত বাঙালির ট্রেডমার্ক উবের উন্নাসিকতার প্যাটার্নটা অভিন্ন।
অতীতচারী গর্বিত বাঙালি ও এক 'উড়ে'র গল্প
সুদীপ্ত দত্ত
বাঙালি রসখ্যাপা জাত। বাঙালি নিজশৈলীতে সেই রসমন্থনে রাজনীতি, ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, কলা, চলচ্চিত্র, ক্রিকেট, ফুটবল সবেতে মগ্ন। সমাজ মাধ্যমের কল্যাণে সৃষ্টিশীল বাঙালির এই রসমন্থন স্পৃহা, জিনগত প্রতিভায় এখন আরও প্রকটিত।
কর্মসূত্রে এখন বিশ্ববাংলা থেকে দূরে। সমাজমাধ্যমই আমার কাছে বঙ্গরঙ্গ বোঝার হাওয়া অফিস। সেখানেই আমি রসের প্রকৃতি, প্রাবল্য, মন্থনের অভিঘাত, ক্লাইম্যাক্স এবং যবনিকার আভাস পাই। এই যেমন গত ৪৮ ঘন্টারও বেশি সময় চলছে ডুরান্ড, ডার্বি, চিংড়ি আর ইলিশ। ছবি, মিম, টিটকিরি, টিপ্পনিতে সমাজমাধ্যমে সুনামি। পরিবার, পাড়া, বৃহত্তর সমাজ থেকে কর্মক্ষেত্র, বাঙালি এ সময় স্যাডিস্টিক প্লেজারের সশব্দ ঢেঁকুরে বিপক্ষের স্বরকে ধামাচাপা দিতে চায়। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এমনও লেখা হচ্ছে দেখলাম, "শালাদের গোলে এমন শট মার, যাতে ইছামতী টপকে ওপারে গিয়ে পড়ে।" উলটো দিক থেকে ধেয়ে আসছে, "হালার ব্যাটা, তোরে যেদিন পামু, গলায় পা তুইল্যা পিষ্যা ফ্যালাম।"
কী মনে হল হঠাৎ, 'শালা' আর 'হালা'র সংখ্যা গুনতে বসলাম। এ কী দুরবস্থা ! মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল দুই দলের ২১ জন ক'রে মোট ৪২ জনের মধ্যে বাঙালি মাত্র ২! মোহনবাগান অধিনায়ক সুভাশিস বসু এবং মোহনবাগানেরই ফারদিন আলি মোল্লা। ফারদিন অবশ্য মাঠে নামেননি। বাকি? সব ভিন রাজ্যের বা বিদেশি। 'শালা'ই বা কই? 'হালা'ই বা কই? তাহলে বাঙালি লড়ে মরছে কেন? 'শালা'- 'হালা'র লড়াইয়ের ঐতিহ্যের সত্বে আজকের বাঙালির কি আদৌ কোনও অংশীদারী আছে? পিকে, চুণী, মান্নার সোনালী ঐতিহ্য পেরিয়ে এই সেদিনও তো দীপেন্দু, মেহতাবরা সব ছিল। কিন্তু তারপর? মিম বানানোর ফাঁকে, একবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করবেন নাকি?
জাম্পকাট ১ : পড়শি রাজ্য ওড়িশার প্রান্তিক জেলা সুন্দরগড়। তারই একটি ব্লকে প্রায় ১০/১২ কোটি টাকা খরচ করে বসছে অ্যাস্ট্রোটার্ফ। হকি খেলা হবে। ভিড় করে সেই কাজ দেখছে কালো কালো চেহারার আদিবাসী সব। দু একজনের হাতে হকি স্টিক আছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগের হাতেই বাঁশ বা কেন্দু গাছের ডাল। ওটাই হকি স্টিক। সুন্দরগড় হল ওড়িশা হকির আঁতুড়ঘর। ওড়িয়ারা গর্ব করে বলেন, সুন্দরগড়ের শিশু হকি স্টিক নিয়ে হাঁটতে শেখে। তো সেখানেই বসছে অ্যাস্ট্রোটার্ফ। কাজ খতিয়ে দেখতে এসেছেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী। সব বুঝে নিয়ে তিনি ভিডিও কল করলেন।ওপারে এক দীর্ঘকায়, দুধে-আলতা, সুপুরুষ বৃদ্ধ। মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। নাম নবীন পট্টনায়ক। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী।
২০১৮ সাল। হাত তুলে নিল মূল স্পনসর সাহারা। ভারতীয় হকি তখন অনাথ। ঠিক সেই সময়ে, জাতীয় ক্রীড়ামহলকে চমকে দিয়ে, নবীনের ওড়িশা সরকার বলল, ভারতীয় পুরুষ এবং মহিলা হকি দলকে ৫ বছর স্পনসর করবে ওড়িশা। ঢালবে ১০০ কোটি টাকা। অনেকেরই তখন চোখ কপালে। ভুরু কুঞ্চিত। বলে কী রে! যে রাজ্যের নাম শুনলেই এখনও কালাহান্ডির ছবি চোখে ভাসে, যে রাজ্যে মাঝে মাঝেই সাইক্লোন সব তছনছ করে দিয়ে যায়, সে রাজ্যের এত বুকের পাটা !
ভুবনেশ্বরে মুখ্যমন্ত্রী আবাস নবীন নিবাসের লনে পায়চারি করতে করতে, নবীনের মুখে তখন মিটিমিটি হাসি। ঠিক দুবছর বাদে নবীন সরকার একটি বিজ্ঞাপন দিল। পুরো প্রথম পাতা জুড়ে। দেশের সব প্রথম সারির সংবাদপত্রে। তাতে লেখা হল, "Odisha is proud to have partnered with Hockey India in this remarkable journey." কেন এমন বিজ্ঞাপন ? কারণ, ২০২০ সালের সেই দিনটিতে, ৪১ বছরের খরা কাটিয়ে, টোকিও অলিম্পিকে সেমিফাইনালে পৌঁছেছে ভারতীয় হকি দল। মহিলা হকি দলও ইতিহাসে প্রথম বার সেমিফাইনালে। নবীন নিবাসে বসে, নবীন পট্টনায়ক তখন সংবাদ মাধ্যমে বাইট দিলেন, "Investment in sports is an investment in youth. Investment in youth is an investment in the future."
সত্যিই তো। বড় ভেবেচিন্তে, হিসেব করেই বিনিয়োগ করেছেন নবীন পট্টনায়ক। এমন বিনিয়োগ, যে আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন পরপর দুটি হকি বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব ওড়িশাকে দিতে দু'বার ভাবেনি। ২০১৮ র হকি বিশ্বকাপ আয়োজনের পর, নবীন যেন জানতেন, পরের বিশ্বকাপ তিনিই করবেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে শুধু নীরবে কাজ করে গেছে ওড়িশা হকি ফেডারেশন।
না, নেপোয় দই মারার মতো, নবীনকে ওড়িশা জুড়ে প্রচার করতে হয়নি। খেলা হবে বলে চিৎকার করে বাজার গরম করতে হয়নি। একদা দুন স্কুলের ছাত্র নবীন, নিজে স্কুল টিমে হকি খেলতেন। ছিলেন গোলকিপার। বিজু পট্টনায়কের যোগ্য উত্তরসূরী যখন রাজ্যের হাল ধরলেন, তখন হাতে অনেক কাজ। নবীন কিন্তু স্বপ্ন বিস্মৃত হননি। দূরদর্শী নবীন বুঝেছিলেন, ওড়িয়া অস্মিতাকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে, হাতে তুলতে হবে হকি স্টিক।
ওড়িশা সরকার তাই জাতীয় পুরুষ এবং মহিলা হকি দলের স্পনসরশিপ ১০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১৫০ কোটি করল। ভারতীয় হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক দীলিপ তিরকের সুন্দরগড় জেলায় তাই এখন ১৭ টি ব্লকের প্রতিটিতে ১ টি করে অ্যাস্ট্রোটার্ফ তৈরি হচ্ছে। নবীন সরকার খরচ করছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ২০২৩ হকি বিশ্বকাপের আগে, সুন্দরগড় জেলারই রৌরকেলায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম হকি স্টেডিয়াম। আদিবাসীবহুল সুন্দরগড় জেলায় তৈরি হয়েছে ওড়িশা স্পোর্টস একাডেমি। রাজ্যচষে প্রতিভা বাছাই করে এনে সেখানে চলছে বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণ। স্পোর্টস একাডেমিতে প্রায় ১৫০০ ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছে মেডেল আনার জন্য। বিশ্বজয়ের জন্য। তেরঙ্গা তুলে ধরার জন্য। ওড়িশার ১৫ টি জেলায় এই মুহূর্তে চলছে ১৬ টি স্পোর্টস হস্টেল। সরকারি পয়সায়।
নবীনের এই নিরলস, নীরব সাধনা নজর এড়ায়নি খোদ রতন টাটার। "কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে ট্রিগার টানার" অভিযোগ এনে বাংলা ত্যাগী রতনের টাটা ট্রাস্ট এবং টাটা স্টিল, নবীন সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ভুবনেশ্বরে গড়ে উঠেছে নভল টাটা হকি একাডেমি। ওড়িশা জুড়ে এমনই ১০ টি High Performance Sports Centre গড়ে উঠছে। নবীন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে রিলায়েন্স গোষ্ঠী। রিলায়েন্সের সেন্টারে তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের আথলিট। পুলেল্লা গোপীচন্দ আর ডালমিয়া সিমেন্টের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে, ব্যাডমিন্টন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। JSW পয়সা ঢেলেছে সুইমিং আর ফুটবলে।
আর এসবই হচ্ছে নীরবে। সাধনার মতো। ঢেঁড়া পেটানো নেই। কুচ্ছিৎ বিকৃত আমিত্বের বিজ্ঞাপন নেই কোথাও। নবীন ওড়িশায় ছাপ রেখে যাচ্ছেন, নবীন পট্টনায়ক। ওড়িয়া অস্মিতার ধ্বজা উড়ছে পতপত করে। শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের নিশানের মতো।
জাম্পকাট ২ : ঠিক ২০১৮ সাল। বঙ্গে শুরু হল দুর্গাপুজোর অনুদান। ২৮ হাজার ক্লাবকে ১০ হাজার করে টাকা দিয়ে শুরু। ক্লাবের সংখ্যাটা এবার দেখলাম প্রায় ৪০ হাজার। অনুদান ক্লাব পিছু ৭০ হাজার। অর্থাৎ, আমার আপনার করের টাকায় মোচ্ছবের খরচ প্রায় ৩০০ কোটি। পরের ডার্বির ঠিক আগে, 'শালা' আর 'হালা'র লড়াই শুরুর মুহূর্তে, একবার ভেবে দেখুন, এই ৬ বছরে এই প্রায় ১০০০ কোটি টাকায়, বাংলা জুড়ে ঠিক কতগুলো ফুটবল অ্যাকাডেমি হতে পারত। তিন প্রধানের প্লেয়ার্স লিস্টে থাকতে পারত ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, মুখোপাধ্যায়, দাস, ঘোষ, মিত্র, হালদার, বাউড়ি,মুর্মুরা। জাতীয় পুরুষ হকি দলে ওড়িশার কিন্তু দুই প্রতিনিধি আছেন। আর মহিলা দলে ওড়িশার চার জন। দুই দলেরই সহ অধিনায়ক ওড়িয়া।
আর সব খেলার সেরা, বাঙালির তুমি ফুটবলের দুই ক্লাবে? কেন লড়ছি তবে আমরা? কোন অধিকারে? আবেগ শুধু অতীতচারণেই আবর্তিত হলে, কালের নিয়মেই একদিন তা বিলীন হয়ে যায়। আপনি আসলে বালিতে মুখ গুঁজে 'শালা' আর 'হালা'র লড়াই লড়ছেন। 'দুটো ক্লাবের খেলা দেখতে যাচ্ছেন, যান না। ফুটবল দেখুন। যেমন রাত জেগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখেন। আরও সহস্র ডার্বি হোক। আপনি শুধু তার মধ্যে বাঙালি, ঘটি, বাঙাল, চিঙড়ি, ইলিশ ইত্যাদি মিশিয়ে সাড়ে পাঁচ ভাজা বানাবেন না।'
পুনশ্চ : পড়শি রাজ্যের মানুষকে ভুলেও আর 'উড়ে' 'ফুড়ে' বলতে যাবেন না। গৌরবের অতীত নেই বলেই হয়ত, সোনালী ভবিষ্যৎ গড়তে ওড়িশার মানুষ এখন বদ্ধপরিকর। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আগামীতে বিনিয়োগের দূরদর্শীতাকে হাতিয়ার করে, ওড়িশা এখন এক আগুয়ান রাজ্যের নাম। আত্মঘাতী জলসাঘরে আপনার অতীতচারণ শেষ হবে যখন, বঙ্গ আর কলিঙ্গের মধ্যে তখন হয়ত, আলোকবর্ষ দূরত্ব। খেলা তখন শেষ।
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★
(তবে হ্যাঁ - গুচের পাতায় আমার মতো গোলাকে নিকেরা তাচ্ছিল্য করতেই পারেন)