মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথবিদ্যাসাগর স্মৃতি-মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন : রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ সারস্বতকৃত্য।
মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জন সেনের চেষ্টায় সেখানে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির তৈরী হয়েেছে - স্মৃতি সমিতির কর্তারা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে মন্দিরের দ্বার উদ্ঘাটন করাতে চান। সজনীকান্তের সঙ্গে তখন কবিগুরুর তখন অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক। সমস্ত মান অভিমান ভুলে সজনীকান্ত ফিরে এসেছেন তাঁর অন্তরতম গুরু রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায়। স্মৃতি মন্দিরের উদ্যোক্তারা কবিগুরুর সম্মতি আদায়ের জন্য এই সজনীকান্তকেই ধরলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন মংপুতে হাওয়া বদল করতে গেছেন। সজনীকান্ত মংপুতেই পত্র মারফৎ যোগাযোগ করলেন। তার উত্তরে কবি লিখলেন:
".....আমার শরীর সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা বোধহয় তোমাদের ইচ্ছানুবর্তী। এ ঘর থেকে ও ঘর আমার পক্ষে বিদেশ। একে চলতে হয় সাবধানে, অভ্যস্ত নিয়ম আকড়ে ধরে -নতুন জায়গায় সেটা সহজসাধ্য হয় না, কষ্টকর হয়। মেদিনীপুর যেতে হলে আমার পক্ষে একটা দৈহিক বিপ্লব হবে...."
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিদ্যাসাগরের ভক্ত। চৌত্রিশ বছর বয়সে 'বিদ্যাসাগর চরিত' প্রবন্ধে নিজেকে 'অযোগ্য ভক্ত' বলে উল্লেখ করেছেন আর বিদ্যাসাগরকে বলেছেন'অখন্ড পৌরুষের আদর্শ'। কবির সেই আদর্শ পুরুষের পূণ্য নামে উৎসর্গ করা স্মৃতিমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের জন্য যখন আমন্ত্রণ এল তখন তা ফেরাতে পারলেন না। রবীন্দ্রনাথ শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।
এই ছিল রবীন্দ্রনাথের চরিত্রধর্ম। চারুশীলন ও শুচিশীলনে তাঁর তুলনা খুজে পাওয়া ভার । যথাকালে যথাকৃত্য পালনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। ১৬ ই ডিসেম্বর সকালবেলা দশটার সময় মেদিনীপুর শহরে হাজার হাজার দর্শকের সামনে রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বার উন্মোচন অনুষ্ঠানটি তৎকালীন বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরনীয় ঘটনা।
মেদিনীপুরে পৌঁছে কবির থাকা খাওয়া কোথায় কিভাবে হবে সে বিষয়ে সমস্ত ব্যবস্থা তদারক করবার জন্য কবির একান্তসচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরীকে কয়েকদিন আগেই মেদিনীপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি কবিকে জানালেন যে তাঁর থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে জেলাশাসকের গৃহে। বিনয়রঞ্জনের স্ত্রী চিরপ্রভা সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী। তাঁর বিশেষ আগ্রহেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কবি কিন্তু বিব্রতবোধ করলেন। ৪/১২/৩৯ তারিখে এক চিঠিতে চিরপ্রভাকে তাঁর অসুবিধার কথা জানালেন। সজনীকান্তকেও ৬/১২/৩৯ তারিখে লিখলেন:-
".....চির (শ্রীমতী সেন) তাঁর বাড়িতে আমাকে অতিথিরূপে পেতে চান, আমি একটি সম্পূর্ণ নিরালা বাড়ির দাবী জানিয়েছি। তুমি তো সেই রকমই আশ্বাস দিয়েছিলে। এখন কি ব্যবস্থা পরিবর্তনের আশঙ্কা আছে না কি। তোমার সঙ্গে মোকাবিলায় সব কথা পরিষ্কার হলে নিশ্চিন্ত হতে পারি....."
স্মৃতিমন্দিরের উদ্যোক্তারা মেদিনীপুরে কবিকে নিয়ে আসার ভার দিয়েছিলেন সজনীকান্তকে। সেই উদ্দেশ্য সজনীকান্ত ১৩ই ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হলেন। পনেরো তারিখে শান্তিনিকেতন থেকে রওনা হবার পর ট্রেনের একটি ঘটনা সজনীকান্তের অনবদ্য ভাষায় অপূর্বতা পেয়েছে। কবির বয়স তখন আটাত্তর পেরিয়ে উনআশি। সেই বয়সে কবি ট্রেনযাত্রায় সহগামীদের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা নিজ হাতে করছেন --এই বর্ণনাটি শুধু ভোজ্যরসে নয় মানবিকতার রসেও স্বাদু। সজনীকান্ত লিখেছেন :-
..." ১৫ই ডিসেম্বর প্রাতঃকালে পূর্ব বন্দোবস্ত মত একটি ফার্স্ট ক্লাস বগি বোলপুর স্টেশনের সাইডিঙে হাজির করা হইল। বিপুল রাজকীয় সমারোহে সপারিষদ কবি তাহাতে অধিষ্ঠিত হইলেন। অনিলচন্দ্র, অমিয় চক্রবর্তী, কৃষ্ণ কৃপালনী প্রভৃতি আমরা কয়েকজন, ক্ষিতিমোহন সেনশাত্রী মহাশয়কে রবীন্দ্রনাথের কাছে ঠেলিয়া দিয়া পাশের কামরায় গুলতানি করিতে করিতে চলিলাম। গুসকরায় কবির কক্ষে আমাদের ডাক পড়িল। দেখিলাম তিনি মহা উৎসাহে নানা ধরণের টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি খুলিয়া সকলের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থায় মাতিয়াছেন। পরোটা আলুর দম ও হালুয়া প্রধান উপকরণ। তিনি স্বয়ং প্রত্যেকের হাতে হাতে ভোজ্য বাঁটিয়া দিলেন। আমরা দুই এক টুকরো পরোটা গলাধঃকরণ করিলে সকৌতুকে প্রশ্ন করিলেন, পরোটা কেমন লাগছে হে? এইরূপ প্রশ্নের কারণ সহসা হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম, মৃদৃহাস্যের সহিত তিনি বলিলেন ক্যাস্টর অয়েলে ভাজা অথচ তোমরা কেউ ধরতেই পারলে না। অনিল ও আমি...ইহাতে মোটেই ভয় পাইলাম না বরঞ্চ আরো দুইখানা করিয়া পরোটা যাচিয়া লইয়া কবির আনন্দবিধান করিলাম। কিন্তু দেখিলাম পেলবদেহী অমিয় চক্রবর্তী ও কৃষ্ণ কৃপালনী রীতিমত ভড়কাইয়ছেন।"
শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছাল। মেদিনীপুরগামী ট্রেনের অনেক দেরী। কলকাতা পৌরসভার কর্তৃপক্ষ তৎকালীন মেয়র নিশিথ সেনের নেতৃত্বে কবিকে তাঁদের প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন। বিকেলের দিকে কলকাতা থেকে মেদিনীপুর তীর্থযাত্রীরা একে একে হাওড়ায় মিলিত হতে লাগলেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আচার্য যদুনাথ সরকার, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র পন্ডিত (দাদাঠাকুর) নলিনীকান্ত সরকার, রামকমল সিংহ, পবিত্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র শান্তি পাল প্রমুখ বহু সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক সে তীর্থযাত্রায কবির অনুগামী হয়েছিলেন। সজনীকান্ত তাঁর অভ্যস্ত সরসতার সঙ্গে লিখছেন :-
"পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী সেই ফাঁকে কলকাতায় তাঁহার শুভাগমন প্রত্যাশায় মুলতুবি-রাখা কয়েকটি দৈনিক বিবাহের অনুষ্ঠানে পৌরহিত্যও করিয়া আসিলেন। মোটের উপর এমন অপূর্ব জমায়েত আমাদের কালে কদাচিৎ ঘটিতে দেখিয়াছি। রাজেন্দ্র -সঙ্গমে শুধু দীনেরাই নন, নবীন ও প্রবীনেরা সোল্লাস কোলাহলে তীর্থযাত্রায চলিলেন। "
রাত দশটায় ট্রেন মেদিনীপুরে পৌঁছল। স্টেশনে এই শীতের রাত্রেও কবিকে দেখবার জন্য স্বভাবতই বহু সহস্র লোকের সমাগম হয়েছিল। জনতার মধ্যে কয়কজন শ্বেতাঙ্গকেও দেখা গেল। সংবর্ধনাকারীদের মধ্যে মহিষাদলের রাজকুমার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জন সেন, জেলা জজ এস এন গুহরায়, রায়বাহাদুর দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, মহকুমাশাসক বি.কে. আচার্য, মনীষীনাথ বসু ক্ষিতীষচন্দ্র চক্রবর্তীও চিত্তরঞ্জন রায় প্রবৃতি বহু গন্যমান্য লোক ছিলেন।
পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ৮টায় শোভাযাত্রাসহকারে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর -স্মৃতি-মন্দিরে উপস্থিত হলেন। কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগতভাষণ জানানোর পর কবি স্মৃতি মন্দিরের দ্বার উন্মোচন করেন।
দ্বারোদ্ঘাটন উৎসবেও লোকে লোকারণ্য। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বলেছেন, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের "জল পড়ে, পাতা নড়ে"ই তাঁর জীবনে " আদি কবির প্রথম কবিতা।" নবজাগ্রত বাংলার সেই প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষাগুরুর উদ্দেশ্যে তাঁর যোগ্যতম উত্তরসূরী সেদিন যে ভাষায় তাঁর শেষ প্রণাম নিবেদন করেছিলেন তা যেমন উদাত্ত গম্ভীর তেমনি মর্মস্পর্শী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণে বললেন:
".....আজ বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার দিন এল যে, সৃষ্টিকর্তারূপে বিদ্যাসাগরের যে স্মরণীয়তা আজও বাংলা ভাষার মধ্যে সজীব শক্তিতে সঞ্চারিত, তাকে নানা নব নব পরিণতির অন্তরাল অতিক্রম করে সম্মানের অর্ঘ্য নিবেদন করা বাঙালীর নিত্যকৃত্যের মধ্যে যেন গন্য হয়। সেই কর্তব্যপালনের সুযোগ ঘটাবার জন্য বিদ্যাসাগরের জন্মপ্রদেশে এই যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে আমি তার দ্বার উদ্ঘাটন করি। পূণ্যস্মৃতি বিদ্যাসাগরের সম্মাননার অনুষ্ঠানে আমাকে যে সম্মানের পদে আহ্বান করা হয়েছে, তার একটি বিশেষ সার্থকতা আছে। কারণ এই সঙ্গে আমার স্মরণ করবার এই উপলক্ষ্য ঘটল যে, বঙ্গ সাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোক যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর...."
কবি আরও বললেন:
" আমি আয়ুর শেষ সীমায় এসে পৌছেছি। এইটাই আমার শেষকৃত্য, শেষ উপহার, শেষ উৎসর্গ। মেদিনীপুর তীর্থরূপ নিয়ে আমাকে আহ্বান করছে এই পূণ্যক্ষেত্রে.!... বঙ্গসাহিত্যের উদয় শিখরে যে দীপ্তিমানের আবির্ভাব হয়েছিল, অন্যদিগন্তের প্রান্ত থেকে প্রণাম প্রেরণ করছি তাঁর কাছে। যাবার সময় এইটাই আমার শেষ কাজ মনে করুন। ভবিষ্যতে আপনারা মনে করবেন, কবি শেষ কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য আপনাদের কাছে এসে নিবেদন করে গেছেন--যিনি চিরকালের জন্য আমাদের দেশে গৌরবান্বিত তাঁরই উদ্দেশে।...."
রবীন্দ্রনাথের এই পবিত্রকৃত্যের কথা স্মরণকরে সজনীকান্ত লিখেছেন "এই ঐতিহাসিক পূজা দর্শন করিবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলাম বলিয়াই নয়, সংঘটনকারীদের একজন ছিলাম বলিয়া আমি চিরদিন গৌরব এবং আত্মপ্রসাদ লাভ করিব"।
শুধু সজনীকান্ত নন, হাজার হাজার দর্শকের সঙ্গে কবির অনুগামী হয়ে যাঁরা সেদিন গিয়েছিলেন তাঁরাও সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থেকে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেছেন। আর এই ছিল মর্ত্য থেকে বিদায় নেবার পূর্বে রবীন্দ্রনাথের শেষ সারস্বতকৃত্য।
ঋণ:-
রবীন্দ্রজীবনী :প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত :জগদীশ ভট্টাচার্য।