কি মুশকিল!কালকে সিদ্ধার্থ বউ বাচ্চা ত্যাগ করেছে বলে, তাঁকে প্রেম চোপড়া করে দেওয়া হলো।এবার, বিষ্ণুপ্রিয়া কে ছেড়ে দিয়েছে বলে চৈতন্যমহাপ্রভু থেকে ওমরিশ পুরী হতে সময়ের অপেক্ষা।
এলেবেলে বাবু ক্ষমা করেন নি,সুতরাং সাধু সাবধান। কিন্তু কতো লোক ই তো সংসার ত্যাগ করে। ভূ পর্যটক,সংগ্রামী নেতা,বৈজ্ঞানিক।ডারউইন তো যৌবন টা নির্জন দ্বীপে অদ্ভুত জনোয়ার দের নিয়ে কাটিয়ে দিলো!
কলেজে আমার ঠিক পরের রোল নম্বর ছিল একটি তামিল ছেলের, যদিও কলকতাবাসী। সে টিভিতে হিন্দি ব্যোমকেশ দেখে ঠিক করেছিল অরিজিনাল ব্যোমকেশ পড়ে দেখবে। সেই আগ্রহে বাংলা পড়তে শেখা শুরু। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ পড়ার পর সে খোঁজ পায় ওঁর ঐতিহাসিক লেখার। আস্তে আস্তে সেগুলোও পড়ে নেয়। তারপর থেকে এন্তার বাংলা গল্পের বই পড়ে যেত।
চৈতন্যের সব ভালো, শুধু বিষ্ণুপ্রিয়াকে চরম উপেক্ষার জন্য ওঁকে ক্ষমা করতে পারি না। আর শান্তিপুরের নিত্যানন্দ হচ্ছে বদমাইশের গাছ। তেমন তাঁর পত্নী জাহ্নবা দেবী। যেমন দ্যাবা, তেমন দেবী!
* ভাবের ঘোরে
অমূল্য সেন-এর বই আমার সংগ্রহে আছে। কিন্তু সে নিয়ে এখানে কিছু লিখব না।
শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র প্রবলভাবে অনূদিত হয়েছেন একটা সময়। লীলা মজুমদারের লেখায় ছিল, শৈলজানন্দ (যদ্দূর মনে পড়ে) বাড়িতে আছেন, হেনকালে এক দক্ষিণী ভদ্রলোক এলেন। এসেই প্রচুর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন। তাঁর লেখা অনুবাদ করেই নাকি তিনি তাঁদের ভাষায় সাহিত্যিক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন। একটা ত্রুটি হয়ে গেছে, অনুবাদের অনুমতি নেওয়া হয় নি। তাই সেই ত্রুটি সংশোধন হেতু তিনি এসেছেন। বলতে বলতে গাড়ি থেকে এক পেল্লায় প্যাকিং বাক্স বেরোলো, এ নাকি শৈলজানন্দকে নিতেই হবে সামান্য সম্মানমূল্য হিসেবে। রেখে তিনি চলে গেলেন। এদিকে সবাই প্যাকিং বাক্স খুলতে হুমড়ি খেলেন, কী আছে - শাড়ি, অন্য কোনো পরিচ্ছদ, মিষ্টান্ন? খুলতে দেখা গেল রাশি রাশি বিজাতীয় ভাষায় লেখা বই - শৈলজানন্দের যাবতীয় সাহিত্যকীর্তির অনুবাদ।
সরি, সামান্য দেরি হয়ে গেল। তবে দেরি হয়ে একদিকে ভালোই হয়েছে। আমার অতি প্রিয় মানুষ রঞ্জনবাবু অনেক কিছু লিখেছেন, বিশেষত যথাযথভাবে জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল-এর উল্লেখ করেছেন। এখন নবদ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে এ বিষয়ে আমার দু'পয়সা।
চৈতন্য ১৫১০ সালে সন্ন্যাস গ্রহণের পর সর্বসাকুল্যে পুরো একটা বছরও হুসেন শাহী রাজ্যে অর্থাৎ বাংলায় কাটাননি। বরং এ কথা মনে রাখা দরকার যে চৈতন্য জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান হুসেন শাহের পরম শত্রু উড়িষ্যার পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা প্রতাপরুদ্রের আশ্রয়ে। চৈতন্য ভাগবত-এর
“কে হুসেন শাহা সর্ব উড়ষ্যার দেশে।
দেবমূর্তি ভাঙ্গিলেক দেউল বিশেষে।।”
পঙ্ক্তি দেখে উড়িষ্যায় তাঁর সৈন্যের কীর্তিকলাপ অনুমান করা খুব কঠিন নয়। বিশেষত কামরূপ অভিযানের সময় হিন্দু জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার দেখে রূপ (সাকর মল্লিক বা রাজস্ব সচিব) এবং সনাতন (দবীর খাস বা ব্যক্তিগত কর্মাধ্যক্ষ) হুসেন শাহ-র ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। এমনকি সনাতন গোস্বামী চৈতন্য অনুগামী হতে চেয়ে রাজকার্য ছেড়ে দিলে হুসেন শাহ তাঁকে কারারুদ্ধ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হননি। রূপ গোস্বামী রাজকার্য ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হন এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে সনাতন কারাধ্যক্ষকে সেই আমলে সাত হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে পালিয়ে যান।
কাজীপর্ব থেকে আমরা জানি যে চৈতন্য নিজে কেবল নবদ্বীপের স্থানীয় রাজশক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েননি, স্বয়ং গৌড়েশ্বর হুসেন শাহও তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন। চৈতন্য একবার গৌড়ের রাজধানীতে উপস্থিত হলে সুলতান তাঁকে দরবারে হাজির করার হুকুম দেন। রাতের অন্ধকারে রূপ-সনাতন দূত পাঠিয়ে চৈতন্যকে অবিলম্বে শহর ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সম্ভবত এই কারণেই সন্ন্যাস গ্রহণের মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাঁকে নবদ্বীপও ছাড়তে হয়, যেমন ছাড়তে হয়েছিল পণ্ডিতপ্রবর বাসুদেব সার্বভৌমকেও।
নবদ্বীপের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বিশেষত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বাংলা থেকে ‘বিধর্মী’ পাঠান রাজত্ব লুপ্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তা জানতে পেরে সুলতান নবদ্বীপ থেকে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে উৎখাত করার আদেশ দেন। জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল-এ লিখছেন
“আচম্বিতে নবদ্বীপে হইল রাজভয়।
ব্রাহ্মণ ধরিঞা রাজা জাতিপ্রাণ লয়।।”
মজার কথা হুসেন শাহের পরম শত্রু রাজা প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত হন বাসুদেব এবং রাজার 'কার্যত' রাজনৈতিক উপদেষ্টার আসনে বসেন চৈতন্য। একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে যা অতি আশ্চর্যজনক।
প্রতাপরুদ্রের কিন্তু উড়িষ্যার সিংহাসনে বসার কোনও আইনসম্মত অধিকার ছিল না। পুরুষোত্তম দেব ছিলেন সূর্যবংশীয় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা-নৃপতি কপিলেন্দ্র দেবের অবৈধ সন্তান। কপিল দেবের আঠেরো জন বৈধ পুত্রসন্তান থাকা সত্ত্বেও প্রধানত জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতদের আনুকূল্যে তাঁর এই জারজ সন্তান পুরুষোত্তম দেব উড়িষ্যার সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তখন থেকেই গঙ্গাবংশীয় রাজাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে ওই শক্তিশালী পুরোহিতবর্গ পুরোমাত্রায় সচেষ্ট হিলেন। প্রতাপরুদ্র চৈতন্যের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে পুরোহিতদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।
জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল থেকে জানা যায় যে চৈতন্য প্রতাপরুদ্রকে পুনরায় (১৫১১-র পর) হুসেন শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে তাঁর রাজ্যের দক্ষিণ অংশ বিপন্মুক্ত করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। চৈতন্যর সাথে প্রতাপরুদ্রর সাক্ষাৎ হয় ১৫১২-তে। আর প্রতাপরুদ্র ১৫১৩ এবং ১৫১৬-তে বিজয়নগররাজ কৃষ্ণদেবের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। ফলত উড়িষ্যাবাসী (আদতে ক্ষমতালিপ্সু পুরোহিত সম্প্রদায়) যে চৈতন্যের ওপরে ক্ষিপ্ত হবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
তবে কি না, ঠাকুরদেবতায় রূপান্তরিত হয়ে গেলে মানুষরা আর সাধারণভাবে মারা যেতে পারেন না। ফলে যতই জয়ানন্দ লিখুন না কেন যে ভাবের ঘরে নাচতে নাচতে ইষ্টক খণ্ডে সেপটিক হয়ে চৈতন্য মারা গিয়েছিলেন, ভক্তের মন অত অল্পতে সন্তুষ্ট হয় না। ফলে হয় কন্সপিরেসি থিওরির চচ্চড়ি হয় নতুবা তিনি নীলাচলে বিলীন হয়ে যান মার্কা গপ্পো নামানো হয়। তাহলে ব্যবসাটা জমে ভালো!
তবে উৎকলবাসী পাণ্ডাদের দোষারোপ করার আগে আপনারা যে কেন রুপ-সনাতনকে ক্লিনচিট দিচ্ছেন সেটা মাথায় ঢুকছে না। পাণ্ডাদের বিষয়টা না হয় প্রমাণিত নয়, কিন্তু ষড়গোস্বামীদের বদমাইশিটা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাহলে?
ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য - ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন। ১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে।
ইন্টারেস্টিং কথাবার্তা চলছে, আমার দু'পয়সা।
প্রথম পয়সাঃ
যদ্দূর মনে পড়ছে চৈতন্যের মৃত্যু নিয়ে আমার ছাত্রাবস্থায় চারটে থিওরি প্রচলিত ছিল ।
১ মন্দিরে বিগ্রহের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া। (ভক্তদের পছন্দের থিওরি)।
২ নীলাচলে পূর্ণিমা রাতে শ্রীকৃষ্ণ ভেবে নীল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেসে যাওয়া। (এটাও ভক্তদের বেশ পছন্দ)।
৩ গুমখুন। ( কন্সপিরেসি থিওরি) তবে স্বার্থের সংঘাতে হওয়া আশ্চর্য নয় ।
৪ কবি জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে " রথযাত্রা দিনে প্রভূ নাচিতে নাচিতে, ইঁটলখন্ড বাজিল পায়েতে"।
পুরীর রাস্তায় নগ্নপদে নগর সংকীর্তনের সময় পায়ে ইটের টুকরো লেগে টিটেনাস হয় এবং তাতে মারা যায় । এটা আমার পছন্দের থিওরি। তবে চারটেই কনজেকচার। নিশ্চিত করে কিছু এতদিন পরে বলা কঠিন।
দ্বিতীয় পয়সাঃ
১৯৬৬ -৬৭ সালে এক ভদ্রলোক রিসার্চ করে একটা বই লিখেছিলেন-- "ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য"। তাতে উনি উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে উপরের সবগুলি থিওরি যাচাই করেছিলেন।
বইটা প্রকাশ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গ সরকার ( কংগ্রেসের ) ওটিকে নিষিদ্ধ করে দিল। সবগুলো কপি বাজেয়াপ্ত হল।
এব্যাপারে বড় ভূমিকা নিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা (অশোক কুমার সরকার পরম বৈষ্ণব যে !) এবং সাহিতিক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত। উনি খোলাখুলি ফতোয়া দিলেন-- ইতিহাসএর আলোকে নয় , শ্রীচৈতন্যকে ভক্তের তৃতীয় নয়ন দিয়ে দেখতে হবে। আদালত ওনার বক্তব্যে সায় দিল। বইটার ব্যাপারে আর কোন খোঁজ পাইনি। কেউ জানেন কিছু?
এপিলেপ্সি থিওরি রোমা রলাঁ দিয়েছিলেন। ওটা খুব একটা কাজের নয় যে শুনেছি। প্রসঙ্গত, চৈতন্যের কাছের কজন ওই সময়েই পুরীতে মারা যান, আর কজন নিজেদের বইতে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দিয়ে গেছেন। বেশ নেতাজী টাইপেরই ব্যাপার।