এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মলয় রায়চৌধুরী: হাংরি আন্দোলনের এক তেজী নক্ষত্র 

    asim nondon লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ অক্টোবর ২০২৫ | ১৫৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ১) পরিচয়পর্ব:

    ''হাংরি মুভমেন্ট খায় নাকি মাথায় দেয়"। এই বাক্যটা থেকেই হাংরির সাথে আমার পরিচয় ঘটে সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত '২২শে শ্রাবণ' ছবিতে। এরপর নানান ব্লগ আর পত্রপত্রিকার সহায়তায় এই মুভমেন্টের আদ্যোপান্ত জানতে পারি। এবং মলয় রায়চৌধুরী নামটার সাথেও আমার সেই স্টাডি থেকেই পরিচয়। হাংরি আন্দোলনকে আদতে বলা যায়, সিস্টেমের গালে কড়া একটা থাপ্পড়। 
     
    ২) এক তেজী নক্ষত্র: 

    ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ রোজ বৃহস্পতিবার যেন নির্বিঘ্নে নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন মলয় রায়চৌধুরী। ৮৪ তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক ৩ দিন আগে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং সব কিছু ছাপিয়ে হাংরিয়ালিস্ট ছিলেন। 
     
    হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসে যাকে আমরা সবচেয়ে তেজী ঘোড়া বলতে পারি। যদিও পৃথিবীর বাতায়নে মলয় আজ আর নেই, তবু এই বাংলা সহিত্যের আকাশে তিনি রয়ে যাবেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতনই। কারণ হাংরিই হলো বাঙলা সাহিত্যের না-বালকত্ব ঘোচানোর পথে বিশেষ প্রয়াস। 
     
    রাবিন্দ্রীক লালিত্যকে ঝেড়ে ফেলে স্ব-কণ্ঠে নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজের বক্তব্য প্রকাশের সূচনা এবং সিস্টেমের গালে কষে থাপ্পড় মারার নাম হলো এই হাংরি আন্দোলন। প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতা আসলে কেমন হতে পারে এই বিষয়ে জানতে তাঁর টেক্সট পড়লেই বোঝা যায়। লেখার জন্য যিনি কোনো-রকম পুরস্কার তাঁর জীবদ্দশায় গ্রহণ করেননি। এই সাহসকে অনেকে অহমিকা বলে থাকতে পারে, তবে আমি এই বিষয়কে দেখি আপোষহীনতা হিসেবে।
     
    ৩) প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কেন:

    মলয় রায়চৌধুরী'র সাথে আমার পরিচয় ভার্চুয়াল জগতে। তাঁর সাথে কথাবার্তাও ঐ ভার্চুয়াল সীমানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁর টেক্সট আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেই দিন আমি প্রথম 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' পাঠ করেছিলাম। তখন আমি কলেজে পড়ুয়া ছাত্র। 
     
    আমার সাহিত্যপাঠকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১ম ভাগ 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' পড়ার আগের পর্ব এবং ২য় ভাগ হচ্ছে কবিতাটা পাঠের পরের পর্ব। ৯০ লাইনের এই কবিতা পড়ার পর সাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে যায়। আমি বুঝতে শিখি শব্দের শ্লীলতা/অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। 
     
    কবি তাঁর প্রেমিকার প্রতি প্রেম নিবেদনের যে উদগ্র বাসনাকে এই কবিতায় সোজাসাপ্টা নিঃসংকোচে তুলে ধরেছেন;  এই ভণিতাহীন নিঃসংকোচে নিজেকে প্রকাশ করার সাহস, তা আমায় মুগ্ধ করেছিল। ঐ ৯০ লাইনের কবিতাটা পাঠের পরই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, আমার কবিতাভাবনা পাল্টে গেছে। 
     
    প্রেমিকার প্রতি প্রেমে শরীরের ভিতর যে হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ খেলে যায়, সেই অনুভূতিরই নিরেট প্রকাশ ধরতে পেরেছিলাম এই 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায়। একটু যেন হিংসাও করেছিলাম! এমন কবিতার কথা কেন আগে আমার ভাবনায় আসেনি! ব্যাপারটা হাস্যকর। নিজের প্রেমিকাকে পড়ে শুনিয়ে ছিলাম। শুনে আমার রক্ষণশীল মুসলিম প্রেমিকা আঁৎকে উঠে বলেছিল, এও কবিতা? মলয় রায়চৌধুরী'র অধিকাংশ লেখাই বৈদ্যুতিক ছুতারের মতনই চাঁছাছোলা, ব্যাকরণকে ভেঙে সোজাসাপ্টা, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। 
     
    তাঁর লেখালেখি বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে আমার নেই। সেরকম প্রজ্ঞাও হয়তো অর্জন করিনি। তবে তাঁর সাহিত্য পড়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যে তিনি অ্যানার্কিকেই হয়তো অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবং দিনের পর দিন তিনি তাঁর আপোষহীন সেই অস্ত্রে শাণিত করে গেছেন বাঙলা-সাহিত্যকে।
     
    ৪) জঙ্গলরোমিও সম্পর্কে কয়েকটা আলাপ:

    একটা নভেলা। ছোট্ট পরিসরে নিজস্ব ঢঙে গল্প বলে গেছেন। এই নভেলাটা আবার 'অসামাজিক গাধা' এবং 'মানুষের গুয়ের গন্ধ' নামে ২টা পর্বে বিভক্ত। এই গল্পে কোনো দাঁড়ি-কমা নেই, টানাগদ্যে লেখা। গল্পের শুরুর বক্তব্যতেই কেমন একটু অসহায় রকম কুন্ঠা জাগে।

    "কেন-কিঁ কেন-কিঁ কেন-কিঁ কবি লেখক নাট্যকার চিত্রকর অভিনেতা ভাস্কর স্হপতি এরা সবাই অসামাজিক গাধা…"

    যেন আয়নার সামনে নগ্নভাবে দাঁড়িয়ে গেছি। আর পরিত্রাণ নেই। যেন নিজের কাছেই নিজে ধরা পড়ে গেছি। আর কোনো ভ্রান্তিবিলাসের সুযোগ নেই। আত্মার ভীষণ গোপন কথাটিও যেন দিকে দিকে চাউর হয়ে গেছে। রটে গেছে সব জায়গায়। নভেলা থেকে কোটেশন দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আরো ২টা কোটেশন আমাকে এখানে যোগ করতেই হবে। 

     "...এই তো জঙ্গলে যে গাছ যতো উঁচুতে ওঠে সে তার শেকড়কে তত তলায় নামাতে থাকে...ওপরে উঠতে শোষণের জন্য নিচে নামতেই হবে...গোড়ার কাছে কাউকে মাথা তুলতে দেয়া হয় না...প্রকৃতির রাজনৈতিক নিয়ম..." 

    অমোঘ এক সত্যকে লেখক এইখানে অবলীলায় প্রকাশ করেছেন। একেবারে মোক্ষম সাহিত্যিক উপায়েই তিনি এই কাজটি করেছেন। 

    "...পরিবার হলো অতীতের পরানো আপনার পায়ের মরচেপড়া বেড়ি...আর ভবিষ্যৎ হলো আপনার সামনে লোভের সরকারি সেতু..."
     
    এই সত্যকে আপনি নাকচ করবেন কোন শক্তি দিয়ে? কোন যুক্তি দিয়ে আপনি বলবেন এই বক্তব্য মিথ্যে? আপনার মগজের জাদুবাক্সে এই কথাগুলো সুরসুরি দিবে। আপনি এই বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে বাধ্য হবেন। 
     
    জঙ্গলরোমিও গল্পটা আদ্যোপান্তই এনার্কিতে ভরপুর। গল্পে থাকা গল্পটা সম্পর্কে আমি এইখানে তেমন কিছুই বলবো না। শুধু গল্পে থাকা নামহীন চরিত্রগুলো সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। ব্যাকরণগত গল্পে যেমন প্রোটাগনিস্ট থাকে, এই গল্পে তেমন কোনো কিছু নেই। শুধু আছে কয়েকজন পশুকামী ফেরারি এনার্কিস্টদের অগোছালো গল্প এবং বক্তব্য।
     
    ৫) শেষ বললেই হয় না তো শেষ: 

    এখন কথা সংক্ষিপ্ত করতে হবে। কথা শেষ বললেই তো আর শেষ করা যায় না। আরো অনেক থেকে যায় বাকী। কবি মলয় রায়চৌধুরী চলে গেছেন, বললেই তো শেষ হয় না, তিনি আরো অধিক রয়ে গেছেন তাঁর না-থাকা জুড়ে। তিনি বাঙলার পাঠকের হৃদয়ে আর বাঙলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Manali Moulik | ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ০০:১৪735375
  • ওনার ইন্টারভিউ পড়েছিলাম। কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও শতভিষা গোষ্ঠী থেকে কীভাবে হাংরি আন্দোলন পৃথক ও ঔপনিবেশিক সাহিত‍্যচর্চার ধারাটিকে অনন‍্যসাধারণভাবে তুলে ধরেছিলেন। শ্রদ্ধেয় দেবী রায়, হারাধন ধাড়া এবং কবি মলয় রায়চৌধুরির সঙ্গে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তো একদা এই আন্দ‍োলনের শরিক ছিলেন।
  • কালনিমে | 114.29.***.*** | ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:০৩735381
  • তা হলে অধ‍্যাপক নন্দিনী ধর এর এই মূল্যায়ন টুকুও পড়ে নিন সঙ্গে -
     "It is, therefore, not surprising that what provided the Hungryalist poets their critical edge – the unabashed and repetitive writing of middle-class male alienation and rage – becomes the most institutionalized voice of Bengali poetry in the period following 1977. "
     
     'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' এর সঙ্গে আজকের Incel Culture এ খুব একটা প্রভেদ আছে বলে তো মনে হয় না -  fringe হলেই তা avant-garde তাই বা কে বললো?
    Link: 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন