[সকালের ঝলমলে রোদে জানালার পাশের নিমগাছটা যেন নবজীবন পেয়েছে। কাঠবেড়ালির খেলা দেখতে দেখতে আলোর মুখে ফুটে ওঠে এক অপার্থিব সুন্দর হাসি। তমিস্রা একটি পুজোসংখ্যা পড়া অর্ধসমাপ্ত রেখে উঠে দাঁড়ালো।]
তমিস্রা : বৃষ্টির যন্ত্রণা বোধহয় কিছুটা কমলো, রোদ উঠেছে।
আলো : আপাততঃ। এবার দেখা যাক পুজোয় ভাসাবে কিনা! মনে তো হচ্ছে এই রোদ ক্ষণস্থায়ী, আমাদের ক্ষণিক উৎসাহের মতো।
তমিস্রা : সেদিন তুমি কী বলছিলে? স্বাভাবিকতা ও ভারসাম্যহীনতা নিয়ে?
আলো : প্রশ্ন করছিলাম তোমাকে, যে স্বাভাবিক বলতে ঠিক কী বোঝায়?
তমিস্রা : সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সাযুজ্য। অর্থাৎ যা দেখে আমরা অভ্যস্ত, তার মতোই। এবার জীবনে আমার উচ্চাশার সঙ্গে যদি আবেগের সংঘাত বাঁধে, তবে আচরণে কিছু অসংগতি প্রকাশ পেতে পারে কি? যার জন্য আমার অন্তরের অবসাদের ঝড়ে কল্পনার বিহঙ্গ নীড়হারা হবে? তারপর ঝড়ের পাখির মতো চিন্তার আশ্রয়ের খোঁজে নির্লজ্জের মতো প্রবেশাধিকার চাইবে তোমার খোলা জানালা দিয়ে?
[ আলো হাসতে হাসতে ঘুরে দাঁড়ায়]
আলো : জীবনে মেথডিক্যাল হওয়া ভীষণভাবে প্রয়োজন, বুঝলে? এটা অনেকটা ওই রিসার্চ মেথডোলজির মতোই। Qualitative বা quantative -- দুটো পদ্ধতির একটা বেছে নিতে হবে বিশেষভাবে। কিন্তু দুটোকেই আবার একইসঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তুমি হয়তো জানো, Qualitative methodology হলো অনেকাংশে subjective অপরদিকে Quantitative হলো objective পদ্ধতি।
তমিস্রা : ব্যাস, ব্যাস...মাথা খারাপ হয়ে যাবে এবার! তোমার সঙ্গে বিতর্কে যাওয়ার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই, আলো। শুধু এটা বলে দাও, জীবন ও ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে সেটা কীভাবে প্রয়োগ করবো?
আলো : দ্যাখো, জীবন শুধু সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে চলে না যেমন, তেমনই কেবল আবেগেও চলে না। ক্যারিয়ার, সময়ের নিখুঁত হিসেব, কঠিন চর্চা আয়ত্ত করা যান্ত্রিকতার জন্য একান্ত প্রয়োজন। এটাকে আমরা quantitative পদ্ধতি বলতে পারি। আবার মূল্যবোধ, সচেতন আবেগকে ঠিক দিকে সূচিমুখ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা গেলে সেটা হলো qualitative পদ্ধতি। অর্থাৎ দুটি ধারণারই একীভূত হওয়া প্রয়োজন।
তমিস্রা : মানে বলা যায়,
"অতএব এসো আমরা সন্ধি করি
প্রত্যুপকারে বিরোধী-স্বার্থ সাধি
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি।
আলো : এরপর যদি আমি 'উটপাখি' বলে ডাকি, রাগ দ্যাখাতে আসবে না কিন্তু।
তমিস্রা : বুঝলাম। রাগ করার প্রসঙ্গ নেই। কিন্তু বলো তো জীবনের প্রয়োগে কখন কোনটা দরকার কীভাবে বুঝবো?
আলো : বলা কঠিন। এটার নেপথ্যে কাজ করে এক বিশাল জিনিস যার নাম ধারণা গঠন (concept) এ বড়ো ঝামেলার জিনিস। কিন্তু ধারণা দ্বারা একবার পরিচালিত হলে নিজেই বুঝে যাবে কী করবে, কেন ও কখন করবে।
তমিস্রা : ধারণা কেমন?
আলো : এই ধরো, গাড়ি। একটা চারচাকার অটোমোবাইল যানবাহন--
তমিস্রা : এরকম যান্ত্রিক, কাঠকাঠ উদাহরণ কেন? প্রেমও তো হতে পারে!
আলো : আচ্ছা, কথাটা শেষ করি আগে। একটা গাড়ির নির্দিষ্ট ওজন আছে, তার গতিবেগ আছে, গাড়িটার আয়তন আছে। এগুলো হচ্ছে মূর্ত ধারণা। যেগুলি পরিমাপযোগ্য, এককসাপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ। কিন্তু যদি এখানে বসে উচ্চারণ করি 'গাড়ি', তবে মনশ্চক্ষে একটা চারচাকা যানবাহনের ছবি ফুটে উঠলো। এটা কেবল বিমূর্ত ধারণা। অর্থাৎ গাড়িটার ওজন, গতিবেগ ইত্যাদি সংখ্যা দ্বারা নির্ণেয় ও পরিমাপযোগ্য। কিন্তু সেসব হবে গাড়িটা চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার পর। আর 'গাড়ি' শব্দটা itself একটা ধারণা। যা আমাদের মনে প্রোথিত আছে।যদি এই পেনটা দেখিয়ে বলি, 'দ্যাখো একটা গাড়ি'। নিশ্চয়ই হাসবে?
তমিস্রা : হ্যাঁ।
আলো : কিন্তু কেন হাসবে? কেন মানবে না? কারণ গাড়ির অবয়ব আর পেনের অবয়ব আলাদা। সেটা আমাদের বহু-পূর্বগঠিত ধারণা। তাই গাড়ি বললে গাড়িই বুঝবো, আর পেন বললে পেন।
তমিস্রা : তাহলে এবার প্রেমের ধারণার বিবর্তনে আসি? বৈষ্ণব পদাবলীতে চিরন্তন নর ও নারীর অভিসারগাথা চিত্রিত হয়েছে। সেখানে কোনো পদকর্তা রাধিকার অভিসারযাত্রার প্রস্তুতিপর্বকে বর্ণনা করছেন,
'কন্টক গারি কমলসম পদতল
মঞ্জির চিরহী ঝাঁপি
গাগরী বারি ঢারি করি পিছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।'
আবার আধুনিক ধারণায় কবি মন্দাক্রান্তা সেন লিখলেন,
"নুপূর বেজে উঠলো শুনে কদমতলায় ছুটলো চটুল বালা
সাইকেলে ঠেস, দাঁড়িয়েছিলো কালা।"
এখানে দুটি ধারণার গুণগত পার্থক্য তো নেই। শুধু ধ্রুপদী প্রেমের নবরূপে আবাহন। কী বলবে এটা নিয়ে?
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।