গাছগুলো বাঁচবে তো?
কাল থেকে এ'শহরের সহনাগরিকদের দুশ্চিন্তা একটাই। গাছগুলো বাঁচবে তো?
কোন গাছগুলো?
যে বটগাছগুলোকে মালদার ন্যাশনাল হাইওয়ের সামনে থেকে ট্রান্সলোকেট করা হচ্ছে। যে গাছগুলোর ছায়ার সাথে ঐ এলাকার মানুষদের চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আত্মীয়তা। যারা আপাতত নিশ্চিন্ত, বছর খানেক পরে ছায়াটুকু আবার ফিরে আসবে। ওদের এলাকায় না হলেও, এ শহরের অন্য কোনো রাস্তার ধারে।
সবার আগে বলে রাখি। আমি এই কর্মকান্ডের কিম্বা পরিবেশ আন্দোলনের কেউ নই। তবে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত সবাইকেই অল্প বেশি চিনি। আর জানি, এরা কেউ আমাদের মতো শখের পরিবেশপ্রেমী না। গরম পড়ল আর ফেসবুকে গাছ লাগালাম, তারপর ব্যলকনির অ্যালোভেরা আর পাতাবাহারে জল দিতে দিতে ভাবলাম —হু হু বাওয়া, কেমন গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমিয়ে দিলাম। এরকমটা নয়।
যদি দেখতে পান, নেতাজি মোড়ের ব্যস্ত রাস্তায় গাঁইতি দিয়ে পিচ রাস্তা খুড়ে একটা গাছ কেউ লাগিয়ে দিয়ে গেছে, তাহলে জানবেন এটা ওদের মধ্যে একজন। যদি দেখতে পান উন্নয়ন এগোতে এগোতে একটা পূর্ণবয়স্ক গাছের গোড়ায় পৌঁছে গেছে, আর কোনো এক অফিসযাত্রী রাস্তায় নেমে এসে সন্ধ্যা অব্দি গাছটাকে আগলে রেখেছে, তাহলে জানবেন যে ও ওদের একজন। যদি দেখতে পান নদীর কাদার মধ্যে নেমে একদল ছেলে মেয়ে আবর্জনা পরিস্কার করছে, যাদের গায়ের পোশাক বেশ পরিষ্কার তাহলেও জেনে রাখুন ওরাও ওদেরই দলের।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাছ কেউ লাগাতে চাইলে নিশ্চয়ই তা প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু আজকে গাছ লাগানো হল, আর পাঁচ বছর পরে মালদার তাপমাত্রা হু হু করে নেমে এলো ব্যপারটা এতটা সোজা নয়।
What-s-in-it-for-me
একটা দুর্দান্ত ভিডিও দেখেছিলাম। যেখানে স্কুলের মধ্যে অভিভাবকদের আঁকার কম্পিটিশন হচ্ছিল। একটু অভিনব ভাবে। প্রত্যেক প্রতিযোগীকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পছন্দের দুটো রঙ তুলে নিয়ে পরিবেশের ছবি আঁকতে হবে। আঁকা হয়ে গেলে রঙগুলো আর ফেরত রাখা যাবেনা । এরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রত্যেক অভিভাবকের সন্তানরাও একই প্রতিযোগিতায় উপস্থিত হল। ঐ পুরনো রঙের বাক্স থেকেই ওদের রঙ পছন্দ করতে হবে। প্রতিযোগিতা শেষ হলে দ্যাখা গেল, অভিভাবকের নীল, সবুজ, আকাশি রঙের ছবি আর বাচ্চাদের ছবিতে শুধুই কালো আর ধূসর রঙ। তারপরে একটা ছোট্ট লাইন
— সব সবুজ আমরাই শেষ করে দিলে , ওদের জন্য কী থাকবে?
এই যে গরম পড়তে না পড়তেই সবাই গাছ লাগানোর জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে, আমাদের পাঁচশ কোটি গাছ লাগাতে হবে বলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তার কারণ বেশিরভাগ মানুষই হয়তো বিশ্বাস করে পাঁচ সাত বছরেই শষ্য শ্যামলা দেশটা হিমশীতল হয়ে উঠবে। WIIFM What's in it for me র উত্তরটা নিজের মতো করে মিলিয়ে নেয়।
শুনতে খারাপ লাগলেও, তাদের জীবদ্দশায় WIIFM এর উত্তরটা মিলবে না। যা কিছু করছেন তার যদি কোনো সুফল হয়, সেটা আগামী প্রজন্মের জন্য। আর শুধু গাছ লাগিয়েই উষ্ণতার মোকাবিলা করা যাবেনা। যদি বিশ্বাস না হয় ফরেস্ট প্যারাডক্স নিয়ে একটু পড়াশোনা করে দেখতে পারেন। যারা রেনফরেস্টে গরমের দিনে দুপুররোদে ঘুরে বেরিয়েছেন, তারা আলবাত জানেন কী বিচ্ছিরি গরম লাগে জঙ্গলের ভেতরে। আর পাঁচশ কোটির একটু হিসেব দেখা যাক।
পৃথিবীতে মানুষ পিছু আনুমানিক ৪০০ টা গাছ আছে। ক্যানাডাতে : ৮৯০০, রাশিয়ায় ৪৪০০ ইউনাইটেড স্টেটস ৭০০, চিন ১০০ আর আমাদের দেশে ২৮ টা গাছ রয়েছে। তার মানে নিকটবর্তী দেশের কাছে পৌঁছতে গেলেও (1.4bn x 72) ১০,০০০ কোটিরও বেশি গাছ লাগাতে হবে। তার থেকে অনেক বেশি কাজের কাজ হবে, যদি গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। আজকাল একটা বক্তব্য প্রায়ই দেখতে পাই—
"সবকিছু সরকারের ভরসায় ছেড়ে দিবেন না, নিজের পরিবেশ নিজেই ঠিক করে নিন।"
বিশ্বাস করুন, পারবেন না। আপনি দশটা গাছ লাগাবেন। সাত আট বছরে সেগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হবে। আর এই মুহূর্তে আপনি জানতে পারলেন, গত তিরিশ বছরে দেশের 668,400 hectares বনসম্পদ কেটে ফেলা হয়েছে। যতক্ষণে আপনি বুঝতে পারবেন গত তিরিশ বছরে আপনার পছন্দ আর অপছন্দের পার্টির সরকার দুজনেই দায়িত্ব নিয়ে বনজঙ্গল সাফ করেছে, ততক্ষণে হয়তো আপনার শহরেই তিনশ' গাছ কাটা হয়ে গেল। দু চারটে ঘরের খেয়ে বুনো মোষতাড়ানো মানুষ সাধ্যমত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। আর তখন আপনি বীজ সংগ্রহ করছেন, পৃথিবীকে উষ্ণায়নের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন বলে।
ও নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন কী করে, আপনার মাথায় এখন এসি চলছে, এসি চালিয়ে আপনি কী মারাত্মক অপরাধ করতে চলেছেন। কেননা বিগত কয়েক দশক ধরে আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আপনি যে এসিটা কিনেছেন, সেটাই আসলে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সবথেকে বড় কারণ। আপনি এসি বন্ধ করলেই গ্রিন হাউস গ্যাস দুমদাম করে কমতে থাকবে। আর ওদিকে গবাদি পশুদের যদি ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলা যায়, তাহলে ওরাও মিথেন ছড়ানো বন্ধ করে দেবে। এই রে, আবার সিলেবাসের বাইরে চলে গেছি। গবাদি পশুরা আবার কখন স্টেকহোল্ডার হল?
মোটামোটি ৩০% গ্রিনহাউস গ্যাস ছেড়ে, ওরাও আপনার বাড়ির এসির থেকে অন্তত পাঁচগুন বেশি মিথেন ছড়াচ্ছে।
আমরা আবার গ্রিন ভেহিক্যাল ব্যবহার করছি। আমাদের গাড়ির নম্বর প্লেট 'গ্রিন' । আমরা ফসিল ফুয়েল জ্বালিয়ে ব্যাটারি চালিত গাড়ি চার্জ করে যুগান্তকারী বিপ্লব করে ফেলেছি।
এইখান থেকেই শুরু হল, গাছগুলো বাঁচবে তো? - র মতো দুশ্চিন্তা। যেটুকু আমরা দেখতে পাই সেখানেই আমাদের চিন্তা, বাকি সব বহাল তবিয়তে আছে। সব চাঙ্গা সি।
এই গরমে গাছগুলো ট্রান্সলোকেট হচ্ছে। আবহাওয়া প্রতিকূল। এ'সব কী যারা সারা বছর লড়াই করছে জানেনা? আলবাত জানে।
অপারেশন করার আগে প্রোটোকল হচ্ছে, রোগীর ভাইটাল প্যারামিটার স্টেবল করে তারপর অপারেশন শুরু করতে হবে। কিন্তু যদি ট্রমা পেশেন্ট হয়। হঠাও প্রোটোকল। আগে অপারেশন।
জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তার মাঝে পরিবেশযোদ্ধারা গাছগুলোকে বাঁচানোর দাবি জানালো। বিকল্প কীভাবে, গাছগুলোর নূন্যতম ক্ষতি করে রাস্তার কাজ করা যায় তার জোরালো দাবি তোলা হল। অনেক বাদ বিবাদের পর বেশ কয়েকটা গাছকে কোনোরকম ক্ষতি না করে রাস্তার নতুন রুট তৈরি হল। আর পাঁচটা পূর্ণবয়স্ক গাছকে ট্রান্সলোকেট করার সিদ্ধান্ত হল। এরপর শুধু সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগল গাছটাকে ছেঁটে উপযুক্ত অবস্থায় নিয়ে আসতে। যেখানে গাছটা রুট বল সমেত নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হবে, সেখানে কয়েক হাজার লিটার জল এবং এক গাড়ি গোবর সারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে । বিগত একমাস ধরে, পুরো প্রক্রিয়াটার সময় স্থানীয় মানুষকে ওয়াকিবহাল করা, গাছগুলোর তলায় যে অস্থায়ী দোকানগুলো ছিল, তাদের বোঝানো, একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং শেষমেশ কাধে কাধ লাগিয়ে ঐ বিশাল গাছটাকে অক্ষত অবস্থায় গাড়িতে তোলা এইসব সামান্য কাজগুলো করতে হয়েছে।
এগুলো সবই নিশ্চয়ই বর্ষাকালে করলেই ভালো হতো। আর যে সংস্থাটি রাস্তা সম্প্রসারণের বরাত পেয়েছে তারাও অপেক্ষা করত, বর্ষা আসুক তিন মাস পরে। ততদিন ওরাও কাজ বন্ধ করে বসে থাকতো।
যে সংস্থা টেন্ডারটা নিয়েছে গাছ বাঁচলে তবেই তারা টাকা পাবে। এরপরেও যদি ট্রান্সলোকেট করতে গিয়ে এই একটা গাছও যদি না বাঁচে, ( তা নিয়ে অবশ্য কারো বিরাট কোনো মাথা ব্যথা না থাকারই কথা। কারণ এর মধ্যেই এই শহরে তিনশ' গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আর যেদিন প্রুনিং হচ্ছিল সেইদিনই শহরের বুকে একটা পূর্ণাঙ্গ বটগাছ কেটে ফেলা হয়েছে) তাও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ (মালদা) , সহকার, ম্যাজিক, আর ওদের সহযোগী সংঘটন, পি ডাব্লিউ ডি, দমকল, বিদ্যুৎ বিভাগ, পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, শ্রমিক আর স্থানীয় বাসিন্দারা মালদার মতো জায়গায় যে অভূতপূর্ব ঘটনাটা ঘটাতে পারলো সেটাই দিনের শেষে সবথেকে বড় পাওনা। আর কাল মাঝ রাত অব্দি সতেরো থেকে সত্তরের যে ভিড়টা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, ভোর অব্দি যারা গাছটার নতুন ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে দিল, ওটাই ভরসা।
এরপর যতবার গাছ কেটে রাস্তা তৈরির কথা উঠবে, ততবার translocation এর কথা উঠবে।
They've set a precedent
#Few_trees_find_a_new_home
— অভিষেক
২০শে মে, ২০২৪ মালদা
ফেসবুকের পোস্ট
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।