২০ মে দিনটি সারা দুনিয়া জুড়ে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে এই ডানাওয়ালা ছোট্ট নায়কের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে । এই নিবন্ধটি সেই সমস্ত আন সাঙ্ হিরোদের উদ্দেশ্যে এক বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কোথা যাও নাচি নাচি
ওপরের লাইনটা আজ সকালে হঠাৎই মনটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই স্কুলবেলায় পড়া কবিতা। বেশ মনে পড়ে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এই ছড়াটির নৃত্যরূপ দিয়ে পরিবেশন করেছিল স্কুলের একদম কচিকাঁচারা। আমি তখন একটু
উঁচু ক্লাসে।
পরের কথায় যাবার আগে আসুন কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর লেখা ছড়াটির প্রাসঙ্গিক অংশটুকু একবার দেখে নিই। ছয় স্তবকের মূল কবিতার প্রথম দুটি স্তবক হলো এরকম –
মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও,নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই ।
ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।
প্রতিবছর মে মাসের ২০ তারিখটি উদযাপিত হয় বিশ্ব মধুমক্ষিকা দিবস হিসেবে। মনে মনে হয়তো ভাবছেন, সামান্য এক ষটপদীর জন্য এমন আয়োজন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো আমরা আলোচ্য নিবন্ধে।
আপনাদের কি এই বিষয়টি জানা আছে যে আগামী দিনে আমাদের বর্তমান পরিচিত শস্য ভাণ্ডার থেকে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফসল চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে? ভাবছেন তো কোন্ কোন্ ফসল? লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ এন্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষণা সূত্রে জানা গেছে যে বেশ কিছু মূল্যবান ক্রান্তীয় অঞ্চলের ফল ও ফসলের উৎপাদন অত্যন্ত দ্রুত হারে কমছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে বিশ্ববাজারে আম, তরমুজ, কফি এবং কোকোর মত উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক ফসলের জোগান একেবারে শূন্য অংকে হয়তো পৌঁছে যাবে। এমনটা হলে পৃথিবী আরও আরও রিক্ত হবে তার প্রাকৃতিক সম্পদের নিরিখে এবং আমরা বঞ্চিত হব এদের আস্বাদ গ্রহণের আনন্দময় সুযোগ থেকে।
ভাবছেন তো, কেন এমন হবে? আসলে এ কথাটাও আমাদের প্রায় সকলেরই জানা যে উদ্ভিদের ফুল থেকে ফল, ফল থেকে বীজ, বীজ থেকে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মোদ্দা কথাটা হলো, যে এইটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা পৃথিবীর উদ্ভিদের প্রাণচক্রকে নিয়ত বহমান রেখেছে সৃষ্টির একদম সূচনা পর্ব থেকে। এই চক্রের সক্রিয়তা নির্ভর করে ফুলের পরাগায়ন বা পলিনেশনের ওপর। উদ্ভিদবিজ্ঞানের সাধারণ শিক্ষার্থী মাত্রেই জানে , যে উদ্ভিদের একটি ফুলের পরাগধানী থেকে অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পরাগরেণুর স্থানান্তর প্রক্রিয়াকেই বলা হয় পরাগায়ন বা পরাগমিলন। লক্ষ করে দেখা গেছে যে প্রধানত দুই ভাবে উদ্ভিদের পরাগায়ন হয় । শিম, টমেটো, সন্ধ্যামালতী, সর্ষে, ধুতরা ইত্যাদি উদ্ভিদের পরাগায়ন ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে অপর কারও সহায়তা ছাড়াই। বাকিদের বেলায় এই কাজটি বহিরাগত অতিথি যেমন কীট পতঙ্গ, পাখি, বাদুড় ইত্যাদির দ্বারা সম্পন্ন হয়।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ করে দেখেছেন যে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ সপুষ্পক উদ্ভিদ তাদের ফুলের পরাগায়নের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে অথবা আংশিক ভাবে বহিরাগত অতিথিদের ওপর নির্ভর করে।
প্রশ্ন হলো এই তথাকথিত বহিরাগত অতিথি কারা? এই অতিথিদের মধ্যে বিশিষ্টতম হলো মৌমাছি বা মধুমক্ষিকা। বাকিদের মধ্যে রয়েছে অন্যান্য ষটপদীরা এবং আরও কিছু প্রাণি। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর ৭৫ %খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং প্রায় ৪০ % বৈশ্বিক কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা এই পরাগায়নের ওপর নির্ভর করে।
পরাগায়নের ক্ষেত্রে মৌমাছিদের ভূমিকা অতুলনীয়। পৃথিবীতে প্রায় ২০০০০ প্রজাতির মৌমাছির মধ্যে তুলনামূলক ভাবে নগণ্য সংখ্যক মৌমাছিই চাক বেঁধে মধু সংগ্রহ করে। তবে পরাগায়নে তাদের ভূমিকা উজ্জ্বল। মধুর টানে যখন তারা ফুলের ওপর বসে তখন পা ঘষতে থাকে যার ফলে ফুলের পরাগ তাদের পায়ে লেগে যায়। এরপর পরের ফুলে বসলেই আগের ফুলের পরাগ ঝরে পড়ে এবং পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়ন উদ্ভিদ প্রজননের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মিথষ্ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত মৌমাছি সহ অন্যান্য ষটপদীরা আজ ক্রমহ্রাসমান। দ্রুতগতিতে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই কমে যাওয়া আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলছে। কমছে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন, সংকটে পড়ছে কৃষির সঙ্গে যুক্ত কৃষিজীবী সমাজের মানুষেরা, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্যের এক আশ্চর্য সম্পদ।
কেন এমন পরিণতি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আঙ্গুল উঠবে আমাদের দিকে, মান আর হুঁশের গরিমায় আপাদমস্তক জড়িয়ে থাকা মানুষের দিকে। শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর প্রাকৃতিক আবরণীর বদল হয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। কৃষির সম্প্রসারণ,বন কেটে বসত স্থাপন, উৎপাদন বৃদ্ধির তাড়নায় রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের অপরিণামদর্শী প্রয়োগ, অপরিকল্পিত ভাবে চারণভূমির প্রসার - এ সবেরই প্রতিফল হিসেবে কমেছে কীট পতঙ্গের সংখ্যা। শষ্যের জন্য অপকারী কীট পতঙ্গ মারতে গিয়ে মানুষ নিকেশ করেছে যুগ যুগ ধরে তার পাশে থাকা উপকারী পতঙ্গ মৌমাছিদের। বছরের পর বছর এক জমিতে এক ফসলের মনোকালচার ধরিত্রীর বৈচিত্র্যময়তার স্বতঃস্ফূর্ত নীতিকেই নস্যাৎ করেছে,যার প্রভাব পড়েছে পতঙ্গদের ব্যবহারিক জীবনে, আচরণগত বৈশিষ্ট্যে। আর এই সব কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরেই বিলকুল বদলে গেছে পৃথিবীর আবহমানকালের চেনা বাতাবরণ।
এই পরিবর্তন সংকটাপন্ন করেছে মৌমাছি ও মানুষের টিকে থাকার লড়াইকে।
অবশ্য একদল গবেষক মনে করেন এমন সংকট নাকি সাময়িক। একটি শ্রমিক মৌমাছি গ্রীষ্ম কালে বাঁচে মাত্র দেড় সপ্তাহ, আর শীতকালে তার আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক মাস। বসন্ত এবং গ্রীষ্ম ঋতু হলো মৌমাছির প্রজননের সময়। এই সময়ে মৌমাছির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় আবার শীতের সময় কমে যায়। ফলে শীতকালে মৌমাছির সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অবশ্য বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে যে বিশেষ ক্ষেত্রে সংখ্যা হ্রাসের পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। এটাকে নিছকই সাময়িক পতন বলা যায় কি? অধিকাংশ বিজ্ঞানী অবশ্য এই সাময়িক পতনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নন। তাঁদের মতে পৃথিবীর পরিবেশ এতটাই বদলে গেছে যে সনাতনী জীবনচক্রের ছন্দ আর অক্ষুন্ন নেই। ফলে আশঙ্কার মেঘ থাকছেই।
মৌমাছির সামাজিক জীবনকে মাথায় রেখে আজ সারা বিশ্বেই কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছির প্রতিপালন করা হয়। তবে এর প্রভাব বৃহত্তর কৃষিক্ষেত্রে কতটা ফলদায়ক তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা পৃথিবীর পটভূমি থেকে মৌমাছিদের ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া লক্ষ করেই জনমানসে সচেতনতা বাড়াতে ২০ মে তারিখটিকে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে পালন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । কেন এই তারিখের নির্বাচন? এই দিনটি হলো অষ্টাদশ শতকে স্লোভানিয়ার বিখ্যাত মৌমাছি পালক আন্তন জানসার জন্মদিন। মুখ্যত জানসার হাত ধরেই মৌমাছি পালনের বিষয়ে বিশ্ব জুড়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তাই স্লোভানিয়া সরকারের আন্তরিক আহ্বানে সারা দিয়ে জাতিসংঘ ২০১৮ সাল থেকে ২০ মে তারিখে এই দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের মতে , আমাদের ছোট্ট ডানাওয়ালা ষটপদী বন্ধুরা আজ এক গভীর সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। তাই মৌমাছিদের সামনে রেখে এই দিনটিতে মৌমাছি সহ সকল উপকারী পতঙ্গকে সংরক্ষণ করার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে বিশ্বময় পালন করা হয়।
২০১৮ সাল থেকে একটি বিশেষ থিমকে সামনে রেখে এই দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বছরের ভাবনা হলো- মৌমাছি পালন ও সংরক্ষণের জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা , কেননা আগামী দিনে পৃথিবীর পরিচালনার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। তারাই হবে পৃথিবীর সকল ক্রিয়াকর্মের পরিকল্পক ও সঞ্চালক। একটা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে যদি এই প্রজন্মের নবীন নাগরিকদের চিন্তা ভাবনার অভিমুখটাকে একটু পরিবেশানুগ করে তোলা যায়, তাদের উদ্ভাবন ভাবনাকে যদি ভোগবাদী জীবনের আস্ফালন থেকে সরিয়ে এনে খানিকটা টেকসই যাপনের পথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই হবে পরম সাফল্য। কাজটা কঠিন, তবে হাল ছাড়লে চলবে না। মৌমাছিরা যেমন তিলতিল করে মধু সংগ্রহ করে আমাদেরও তেমন একটু একটু করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কেননা আমরা নিজেদের স্বার্থেই পৃথিবীকে অনেক অনেক নিঃস্ব, মুমুর্ষু করে ফেলেছি।
*লেখাটির সঙ্গে কয়েকটি ছবি দিতে পারলে হয়তো বিষয়টি আরও খানিকটা আকর্ষণীয় করে তোলা যেত, কিন্তু বেশ কিছুদিন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে সম্ভবত গুরুর পোর্টালের কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য।এই বিষয়ে পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।