আমি আগে কোনোদিন পাকা রাস্তা দেখিনি,
আজ যখন গ্রাম ছেড়ে এলাম,
বর্ষার কাদায় আমার পা দুখানা হাঁটু পর্যন্ত বুট দিয়ে ঢাকা,
রাস্তার ধারে লয়ানে পা ধুয়ে যখন রাস্তায় উঠলাম-
মনে যে কি বিশাল স্বস্তি পেলাম সে বলে বোঝানোর নয়।
আমি বুঝতে পারলাম আমি কত কষ্টে ছিলাম।
আমার গ্রামে ইস্কুল ছিল না,
প্রতিদিন চোদ্দ কিলোমিটার হেঁটে গেলে বন দিয়ে,
তবে ইস্কুল ছিল একটা,
তাও তাতে একটি মাত্র মাস্টার,
সে সর্বহাটের কাঁঠালি কলা,
জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করে।
এখানে এসে দেখলাম ঘরের গাঙ দেয়ালে স্কুল,
সকাল বেলা গাড়ি যায় আনতে ছেলেদের,
আবার দিয়ে আসে পড়া হলে,
আমি বুঝতে পেরেছিলাম,
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মানে কী।
এখানে ঘরের গায়ে ঘর,
সব পাকার।
কত কামরা,
লোকশূণ্য পড়ে আছে,
কেউ থাকে না।
ঘরের নীচে দোকান,তবু নাকি সব্জিও ঘরে দিয়ে যায়।
খাবার রাঁধতেও হয় না।
ঘরে কলের জল,
রান্না হয়,হাঁড়ি কালি হয় না।
এসব আমার কাছে স্বপ্ন।
আমি মাধ্যমিক দেওয়ার আগে বাস দেখিনি,
যখন দেখলাম পনের কিলোমিটার দশ মিনিটে যাওয়া যায়,
বুঝতে পারলাম আমি কত সময় নষ্ট করেছি।
বড় শহরের এসে দেখি,
এখানে মিনিটে মিনিটে বাস,
তবু লোকে ছটফট করে।
যখন গ্রামে ছিলাম,
বুঝতেও পারিনি কাকে সুবিধা বলে।
সবই স্বাভাবিক মনে হত।
ভোটের সময় বাবুরা এসে মদ মাংস দিয়ে বলে যেত,"ভোট আমাকেই দিবি কিন্তু!"
বিশ্বস্ত কুকুরের মতো লেজ নেড়ে হাসিমুখে বলতাম,"হ্যাঁ বাবু।"
তখন জানতাম না ভোটের বদলে-
ঘরের কাছে ইস্কুল,
চওড়া রাস্তা,
ইস্কুলে মাস্টার
সব পাওয়া যায়।
ভাবতাম,"ভোটের সময় যদি বন ভেঙে গাড়ি আমার ঘরের উঠোনে আসতে পারে,
তাহলে হাসপাতালে কেন বলে রাস্তা খারাপ তাই এম্বুলেন্স যাবে না?"
আমি সব স্বাভাবিক ভাবতাম।
ভাগ্যকে দোষ দিতাম রোজ,
ভগবানকে শাপ,শাপান্ত করত আমার ঠাকুমা,
আমার মা চুপচাপ গোরু-গাধার মতো খাটত।
আমি বুঝতে পারতাম না,
বাবুরা এসে বন সাফ করে দিলেও কেউ কিচ্ছু বলে না,
কিন্তু আমি সেবারে কাঠ কুড়াতে গেলে কেন পুলিশ নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে রেখেছিল,
পিটিয়ে আমার পা ভেঙে দিয়েছিল?
আমি এখনো ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারি না।
আমি ভেবেছি জিজ্ঞেস করব,
আমারই কি তাহলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক?
সবার ভোটের যদি সমান মূল্য হয়,
তাহলে সবাই সমান সুবিধা পাবে না কেন?
কিন্তু বাবুরা ধমক দেয় যে!
ভয় লাগে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।