এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নদী আপন বেগে পাগলপারা ……

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৫৮২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • নদী আপন বেগে পাগলপারা ……

    আজ বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার, সারা বিশ্বে এই দিনটিকে নদীর কথা মাথায় রেখে উদযাপন করা হয়। নদীকে ঘিরে আমাদের এমন উচ্ছ্বাস কেন? আসলে নদীকে ঘিরেই আবর্তিত হয় আমাদের জীবন, আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংস্কার, সার্বিক লোকজীবন। এই আন্তরিক যাপন যে কেবল ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো নদীকে ঘিরেই এমন আবেগ, এমন অনুভব প্রত্যক্ষ করা যায়। নদী যে আমাদের বহমান জীবনের আশ্চর্য উজ্জ্বল প্রতিরূপ,আর তাই নদীর সঙ্গে মানুষের এমন নিবিড় সখ্যতা। নদীর কাছে মানুষের অন্তহীন ঋণ। আজ এই বিশেষ দিনে নদীকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যই হলো সেই অকৃপণ ঋণের সুদ কিছু পরিমাণে শোধ করার জন্য অঙ্গীকার করা। 

    প্রতি বছর একটি বিশেষ ভাবনার কথা মাথায় রেখে এই দিনটিকে পালন করা হয়।  এই বছরের ভাবনা হলো – Rights of Rivers বা নদীর অধিকার। কেন এমন বিষয় ভাবনার প্রয়োজন হলো আজ? নদীর অধিকার কি তাহলে সুরক্ষিত নয়? আমরা কি তার অধিকারকে খর্ব করেছি বা নদীর মুক্তধারাকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত করে নদীর স্বাধীনতার সীমাকে নিয়ত সংকুচিত করে চলেছি? এই বিশেষ মুহূর্তে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তধারা নাটকের কথা। সেই কোন কালে (১৯২২) নদীকে যন্ত্রশৃঙ্খলে বেঁধে ফেলার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি কলম তুলে নিয়েছিলেন। ধনঞ্জয় বৈরাগীর একতারার ঝঙ্কারে বেঁধে দিয়েছিলেন প্রতিবাদে গর্জে ওঠার সুর। 

    আমরা কিছুই শিখি নি, শেখার চেষ্টাই করি নি। তাই আজ পৃথিবীর সর্বত্রই নদীর বুকফাটা হাহাকারের ক্রন্দন ধ্বনিত হচ্ছে। আমাদের দেশের নদীগুলোর হাল দেখলে গভীর অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হয়। কি হাল করেছি আমরা নদীগুলোর? জিস্ দেশমে গঙ্গা বহতী হায় সেই দেশের নদীর দিকে তাকালে লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা মেলে না। আজ বিপন্ন হৃদয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে এতো লাঞ্ছনা, এতো উপেক্ষা, এতো অনাদর সহ্য করেও – ও গঙ্গা ব‌ইছো কেন? নদী যে আমাদের সমস্ত অপকর্মের বিষ বয়ে নিয়ে চলে। আমাদের প্রাণের পবিত্রতমা নদী আজ দেশের দীর্ঘতম পয়:প্রণালি। এ পাপ তোমার আমার পাপ। রাম তেরি গঙ্গা ময়লী হো গয়ী, পাপীও কী পাপ ধোতে ধোতে। নদী তাঁর হৃত স্বাস্থ্য ফিরে পায় না, অথচ পাপীদের সংখ্যা বেড়েই চলে চক্রবৃদ্ধি হারে। এ এক প্রহসনের পালা চলছে। আমরা সবাই যেন সবকিছু মেনে নিয়ে নিরাসক্ত চিত্তে নির্বিকল্প সমাধিতে মগ্ন রয়েছি। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়ে যায়, কিন্তু হাল বদলায় না, নদীর চেহারা ফেরে না।

    তাই যখন দেখি নদী কুলপ্লাবী হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার দুপাশে গড়ে ওঠা শহর, নগর, জনপদকে, কিংবা কূল ভেঙ্গে প্রবল আস্ফালনে গ্রাস করে নেয় আমাদের সুখের সংসার, সাজানো বাগান তখন বুঝতে পারি নদীর অধিকার হরণ করে আমরা তাঁকে আরাধনার ছলনায় কেবল অনাদর, অপমান‌ই করে গেছি। আজ তাই নদীর প্রত্যাঘাত করার পালা শুরু হয়েছে। নদী তাঁর আপন খেয়ালেই এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে। নদী একদিকে যেমন অনেক অনেক কীর্তি গড়ার খেলায় কূলচরা মানুষকে মাতিয়ে রাখে, তেমন‌ই অন্যদিকে সেই নদীই যে কীর্তিনাশা। কোন্ খেলা সে খেলবে তা যে নির্ভর করছে আমাদের কাজের ওপর, নদীর প্রতি আমাদের ভালোবাসার ওপর, আমাদের সংবেদনশীল আচরণের ওপর।

    ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে নদী দিবস উদযাপনের আহ্বান জানানো হয়। এই ভাবনার প্রধান পরিকল্পক ও সঞ্চালক হলেন মার্ক এঞ্জেলো, একজন মার্কিন নদী পরিবেশবাদী বিজ্ঞানী। তাঁর মনে হয়েছিল, পৃথিবীর নদীরা নিতান্তই অবহেলিত। মানুষ নদী থেকে সব সুবিধাই গ্রহণ করছে, অথচ প্রতিদানে নদীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে অবহেলা আর উপেক্ষা। নদীর সমস্যা নিয়ে আমরা কেউই খুব গভীর আন্তরিক ভাবনা ভাবছি না। আজ নদীরা বিশ্ব রাজনীতির অংশীদার হয়ে উঠেছে। সাঙ্পোতে বাঁধ দিয়ে প্রতিবেশী দেশকে শিক্ষা দিতে চাইছে কেউ‌‌; গঙ্গার জলের ভাগ নিয়ে চলছে দুই দেশের কূটনৈতিক আলোচনা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন; দুই প্রতিবেশী রাজ্য আজ জলের ভাগ চেয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। এই উষ্মা, এই দখলদারি মানসিকতা, এমন বিশ্বাসহীনতা শেষ পর্যন্ত আমাদের কোথায় টেনে নিয়ে যাবে তা কারোরই জানা নেই। সবাই জল ঘোলা করতেই ব্যস্ত। এগুলোর কোনটাই নদীর মুক্ত বহমান যাপনের শিক্ষা নয়। এ আমাদের ব্যর্থতা।

    আজ বিশ্ব নদী দিবস উদযাপনের অবসরে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই ভাবনা আমাদের নতুন প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য খুব জরুরি। একবার নিজের দিকে তাকিয়ে আজ প্রশ্ন করি – কী রেখে যাচ্ছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য? এক বিষময়, ক্লেদাক্ত গতিহীন জলধারা উত্তরসূরীদের হাতে সঁপে দেবার আগে আমরা ভাববো না? আজ বিশ্ব নদী দিবস সেই সদর্থক ভাবনা ও কর্মের সম্মিলনের আহ্বান জানায়। আমরা সাড়া দিতে প্রস্তুত তো?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অনির্বাণ রায় | 2409:4061:2d48:84c4:beb9:3270:e638:***:*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:২৫523874
  • বেশ ভালো লাগল। গ্রাম বাংলার ছোট ছোট অনেক নদী বেমালুম হারিয়েই গেছে। সেগুলো আলোচনা করলেও মন্দ হয় না।
  • চৈতালি দত্ত | 2405:201:8000:b1a1:11a7:2687:e22c:***:*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৫523876
  • লেখক আবারও আমাদের ভাববার কথা বললেন। আমাদের অসচেতনতা আমাদের‌ই বিপন্ন করছে। অথচ আমরা নির্বিকার। লেখককে ধন্যবাদ। তিনি অন্তত একদিনের জন্য হলেও আমাদের নদীর কথা শোনার সুযোগ করে দিলেন।
  • Piyali Mukherjee | 103.252.***.*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:২৭523885
  • খুব ভালো লাগলো।
  • ritabrata gupta | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:২৩523891
  • অপূর্ব লাগলো লেখাটি অসাধারণ
  • উন্মেষ | 45.64.***.*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:৩৮523894
  • খুব ভালো লাগল। নদীদের মৃত্যুতে বাঁধ (Dam) কতটা দায়ী সে নিয়ে লেখকের কাছে একটি সবিস্তর লেখা আশা করছি। 
  • দীপঙ্কর দাশগুপ্ত | 2409:40e0:3a:7578:8000::***:*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:০৯523897
  • খুব প্রয়োজনীয় লেখা। নদীর পর নদী চুরি হয়ে যায়। কত নদীর ধারা হারিয়ে যায়। নদী মাতৃক সভ্যতা এই বিপন্নতাকে আমল দেয় না। নদীর সঙ্গে বিপন্ন হয়ে চলে জীবন জীবিকা। আমাদের টনক নড়ে না। একেই কি বলে সভ্যতা! 
  • সৌম্যদীপ সাহা রায় | 49.37.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৬523952
  • কি অসাধারণ আর সময়োপযোগী এই লেখাটি। এমন বলিষ্ঠ লেখা পড়তে পড়তে নদীর জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে। হাতে গোনা কিছু মানুষের উদ্যোগে নদী বাঁচাও কমিটি তৈরি হয়, কিন্তু সরকারি সাহায্য না থাকায় বড়ই মৃয়মান লাগে তাদের কন্ঠস্বর। আমাদের ইচ্ছামতী, চূর্নীর অবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। এমন লেখা বারংবার উঠে আসুক, মানুষ আরও শিক্ষিত হোক। বাঁচুক নদীগুলো। 
  • পৌলমী | 2409:4060:98:b5f3:5586:d69f:526a:***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:০৫524309
  • টানটান গদ্যে নদী কথা পড়তে ভালোই লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন