একজন শিল্পী, অর্থাৎ সংস্কৃতি জগতের মানুষ, তা তিনি কবি হতে পারেন, লেখক হতে পারেন, সংস্কৃতি জগতের যে কোনো শাখার প্রতিনিধি হতে পারেন, তিনি তাঁর শিল্পের মাধ্যমে সমাজের সামনে সবসময় তাত্বিক দিক থেকে সঠিক বিষয়টিই তুলে ধরবেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করবেন সমকালীন সমাজে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা বা দুর্ঘটনা থেকে। আবার ঘটনাক্রম বা দুর্ঘটনাক্রমকে সমাজের কাছে তুলে ধরেই তিনি ক্ষান্ত হবেন না, যদি তাঁর শিল্পের মাধ্যমে সম্ভব হয় তিনি সেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে তাঁর নিজস্ব ধারা বা ঘরানা অনুযায়ী প্রতিবাদও করবেন। এটাই শিল্পকলা বা সংস্কৃতির মূলমন্ত্র বা গোড়ার কথা। একজন চিত্রশিল্পীর বা ভাস্করের হয়তো এই স্বাধীনতার পরিধিটা বেশী নয়, কিন্তু একজন কবি বা নাট্যকর্মী বা সিনেকর্মী বা লেখকের এই স্বাধীনতার পরিধিটা অনেকটাই ব্যাপ্ত।
আবার অন্যভাবে বললে বলা যায়, একজন শিল্পী সমাজের কাছে আয়নার মতো। সমাজের প্রতিটি মানুষ শিল্পীর কাজের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে এবং নিজের ভুলকে অনুধাবন করতে পারবে। একজন শিল্পী মানে একজন সমাজ সংস্কারক, প্রতিটি মানুষের বিবেক। সমাজের দুর্ঘটনা বা ঘটনাক্রম যেহেতু একজন শিল্পীর রসদ, তাই তাঁর নিত্য বিরোধ ঘটবে সমাজের শাসকের সাথে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এই ধারা বহমান। শিল্পীর সাথে শাসকের সখ্যতা তেল আর জলের মতো, তাই শাসকবর্গ চিরকালই চেষ্টা করে এসেছে শিল্প বা শিল্পীর মর্যাদার নাম করে, বিভিন্ন পুরস্কারের আড়ালে শিল্পীকে নিজের দিকে টানার, বিরোধীতার ক্ষেত্রকে কমাতে। অনেক ক্ষেত্রে শাসকবর্গের সফলতা এসেছে আবার অনেকক্ষেত্রে আসেনি। এককথায় বলতে গেলে, শাসকের ব্যর্থতা শিল্পীর রসদ।
শিল্পী বা সংস্কৃতি জগতের মানুষদের প্রতিবাদকে শাসককুল কোনোকালেই ভালো চোখে দেখেনি, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই একথা সত্য। বহু শিল্পীকে প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে হয়েছে শাসককুলের রোষে পড়ে। বহুক্ষেত্রে শিল্পীর বাক রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন রকমের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে শিল্পীর ওপর। উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না এইসব ঘটনার। তবুও সংস্কৃতি জগৎকে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ করা যায়নি বা নিজের বশে আনতে পারেনি শাসককুল। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু আছে, সেই সমস্ত দেশে শুধুমাত্র শিল্প বা শিল্পী নয়, সমস্ত কিছুকেই সরকার বা সেই রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে সেখানে শাসককুল ঠিক করে একজন শিল্পীর শিল্প কিরকমের হবে। কিন্তু আমাদের দেশের মত বহুদলীয় শাসনব্যবস্থায় শাসককুল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যায়, কখনও সফলতা আসে আবার কখনও আসেনা। আবার কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়না বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই। আবার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিক থেকে দেখলে অর্থাৎ রাজ্যগুলিকে আলাদাভাবে বিচার করলে বিভিন্ন রাজ্যের সফলতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের। এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে, তা হলো কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেই রাজ্যের সরকারে কোন রাজনৈতিক দল আছে। একই রাজনৈতিক দল হলে সফলতার মাত্রা অনেকবেশী, অর্থাৎ সেই রাজ্যে শাসককুলের সফলতার মাত্রা বেশী এবং নিয়ন্ত্রণের স্থায়িত্বও বেশী। কিন্তু রাজনৈতিক দল ভিন্ন হলে সফলতার মাত্রাও কম হয় আবার নিয়ন্ত্রণের স্থায়িত্বও কম হয়।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসককুল এই তত্ত্বকে খারিজ করতে সমর্থ হয়েছে। ২০১১ সালের আগে সাংস্কৃতিক জগতের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, এটা বলা যাবে না। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল, নিয়ন্ত্রণও ছিল, কিন্তু সেটা তত্ব অনুযায়ীই ছিল। সফলতার মাত্রা কম আবার স্থায়িত্বও কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাসককুল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাম - শাসনের শেষের দিকে সাংস্কৃতিক জগতের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না বা তারা সেটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। সাংস্কৃতিক জগৎ বাম - আমলের শেষের দিকে তাদের নিজেদের ভূমিকা পালন করেছিল। বাম আমলের অবসানের পরে অবশ্য পুরো সাংস্কৃতিক জগতটাই শাসকদলের দিকে ভীড়ে যায়। কারণটা অবশ্যই স্পষ্ট, শিল্পীর মর্যাদা এবং পুরস্কারের আকর্ষণ। বাম আমলে সমমনোভাবাপন্ন শিল্পীদেরকেও কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া বা পুরস্কৃত করা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে দু - একজনকে বিধানসভার প্রার্থীপদ দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু গোটা সাংস্কৃতিক জগৎকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো পদক্ষেপ বাম আমলে দেখা যায়নি। নতুন শাসক গদিতে বসেই বিভিন্ন শিল্পীদের বিভিন্ন কমিটির শীর্ষে বসিয়ে দেয়, ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, আমার দিকে থাকলে তুমি তোমার পরিধির বাইরেও পরিচিতি পাওয়ার সুযোগ পাবে, সমাজের জন্য কিছু করার অনেকবেশী সুযোগ পাবে যা তোমার পেশায় পাবে না। কিছুদিন পর থেকেই নতুন নতুন পুরস্কারের প্রচলন করে নতুন শাসকদল, এখানেও ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, বাম আমলে তোমাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, কিন্তু আমরা তোমাদের স্বীকৃতি দেবো। আবার নির্বাচনে দেখা যায় সাংস্কৃতিক জগতের মানুষেরা প্রার্থীপদ পেয়েছে এবং তাঁদের জিতিয়ে আনা হয়েছে বিধানসভা বা লোকসভায়। সাংস্কৃতিক জগতের লোকেদের এতখানি স্বীকৃতি বা সন্মান কোনো রাজনৈতিক দল দিয়েছে এমন উদাহরণ ভারতবর্ষে নেই। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রার্থীপদ দিয়েছে তাও শুধু সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের। আর দক্ষিণে দেখা যায় সিনেমার অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা রাজনৈতিক দল তৈরী করে নির্বাচনে জিতে শাসককুল হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে সাংস্কৃতিক জগৎকে নিয়ন্ত্রণের এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি বা ভালো উদাহরণ আর নেই।
তত্ব আর বাস্তব চিরকালই ভিন্নপথে যাত্রা করে। তাই সাংস্কৃতিক জগৎকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শাসককুলের কপালের ভাঁজ কিছু কমে না। সাংস্কৃতিক জগত যেমন শাসককুল ঘনিষ্ঠ হয়েছে বিগত বছরগুলোতে, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক দলেও অনেকেই নাম লিখিয়েছেন। কিছু কিছু বাম মনোভাবাপন্ন শিল্পী এখনও নিজেদের সমর্থন পাল্টান নি। শাসককুলের বিভিন্ন লবির উপস্থিতিও চোখে পড়ে। ফলে সাংস্কৃতিক জগৎ এখন বলতে গেলে পুরোটাই চেহারা বদলে রাজনৈতিক জগৎ হয়ে গিয়েছে, যাঁদের মূল কাজ রাজনীতি আর অতিরিক্ত সময়ে তাঁরা নিজেদের পেশাটা একটু ঝালিয়ে নেন। রাজনৈতিক জগৎ হলে তার যা যা বৈশিষ্ট্য থাকার কথা, সবকিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি সাংস্কৃতিক জগতে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে, শাসককুলের ব্যর্থতা তুলে ধরার লোক এবং মাধ্যম দুটোরই অভাব প্রকট। কবিতা, গল্প বা উপন্যাস, নাটক - পথনাটিকা, সিনেমা, শাসককুলের ব্যর্থতা বা শোষণের চিত্র রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমগুলো উবে গিয়েছে এই রাজ্য থেকে। এটা শাসককুলের কাছে নতুন কোনো সূর্যোদয়ের আলো এনে দেবে না সূর্যাস্তের, তা ভবিষ্যত বলবে। কিন্তু এখন স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই রাজ্যে সাংস্কৃতিক জগতের মেরুদন্ডটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বাঁধা পড়েছে পাকাপাকিভাবে কারণ এই বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা কৈলাস জয়ের মতোই দুঃসাধ্য (হাতের কাছেই উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শিক্ষককুল। বাম জমানায় শিক্ষকদের রাজনীতির আঙিনায় পা দেওয়ার পর থেকে তারা আজ অব্দি সেই আঙিনা থেকে বেরোতে পারেনি অথবা চায়নি)। কাল সরকারে রাজনৈতিক দলের বদল এলে সাংস্কৃতিক জগতের মানুষেরা রাজনীতি ছেড়ে শিল্প নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই ভাবনা নিতান্তই বাতুলতা। হীরক রাজ্যে উদয়ন পণ্ডিতের টোল তুলে দেওয়ার মতোই রাজ্যের বর্তমান শাসককুল সাংস্কৃতিক জগতটাকেই তুলে দিয়ে বিরোধীতার মূল ক্ষেত্রটিকেই নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং স্পষ্টভাবেই বলা যায় এই রাজ্যে শিল্পকলায় 'শিল্প' পুরোপুরি উবে গিয়ে রাজ্যবাসীর হাতে শুধুমাত্র 'কলা' রয়ে গেছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।