দুপুরের খাবার ট্রেনে কিছু খেয়েছি, কোঁচড়ে করে স্যান্ডুইচ ফলমূল কিছু নিয়ে বেরিয়েছিলাম। এই স্টেশন টেক্কা দেয় রাবাটকে। প্রচুর দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট। একটা কেএফসি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, সেখানেই কফি এবং চিংড়িভাজা খেয়ে বাইরে বেরিয়ে পা পিছলে যাবার জোগাড়। এমন চকচকে করে সব মার্বেলের মেঝে বাঁধিয়ে রেখেছে, আর তেমনি সর্বক্ষণ মুছে যাচ্ছে যে কী বলব! সিগারেট খেতেও লজ্জা করে, পাছে ছাই পড়ে সেই বিশাল চত্বরটা ময়লা হয়ে যায়। কিন্তু লাল ট্যাক্সি কোথায়? যেদিকে দুচোখ যায় সব রঙের গাড়ি চলছে, লাল গাড়ি একটাও নেই। একপাশে গোটা পঞ্চাশ সাদা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। ড্রাইভারেরা গুলতানি করছে আর আড়চোখে আমাদের দুজনকে দেখছে, কীসব বলছে নিজেদের মধ্যে। ওদের মধ্যেই একজন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। — কোথায় যাবেন?
— পুরোন শহর, রাস্তার নাম রামিলা।
— চলুন চলুন, ঐ তো গাড়ি
— ভাড়া কত নেবেন?
কথাবারতা আমিই চালাচ্ছি যেহেতু আমার ফরাসী জ্ঞানটুকুই সম্বল।
— দুশো দিরহাম
— ক্কীইইই? দুশো!
জীবনসঙ্গী পাশ থেকে আমাকে উসকে দেয়, লাল ট্যাক্সি কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করো না!
— লাল ট্যাক্সি কোথায়?
ওরা নিপাট ভালোমানুষের মত মুখ করে আমাদের দিকে তাকায়, যেন জীবনে প্রথম এরকম অদ্ভূত কথা শুনছে।
কিছুক্ষণ কথা চালাচালির পর বুঝলাম এদের সঙ্গে পেরে উঠব না। শেষে একশোয় রফা হয়। তারপর ট্যাক্সি চালক আমাদের সোজা বেশ কিছুটা নিয়ে যায়, তারপর নব্বই ডিগ্রি বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা, তারপর আবার নব্বই ডিগ্রি বাঁদিকে চলতে শুরু করলে আমি হাঁ হাঁ করে তাকে দুকথা শুনিয়ে দিই, এত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটুকু পথ নিয়ে যাবার মানে কী?
যাই হোক পুরোন শহরের রামিল্লায় পৌঁছে গন্তব্যের কাছাকাছি এলে আমরা নেমে যাই।
এটা হোটেলও বটে বাড়িও বটে, গোটা তিনতলাটা ছাদসহ বুকিং করেছি। এদের ম্যানেজার করিমের সঙ্গে হোয়াটস্যাপে কথাও বলেছিলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলেন করিম। অমায়িক ভদ্রলোক।
বাড়ির উঠোনে চেয়ার টেবিল পাতা, সেখানে একটু জিরিয়ে তারপর উঠব ওপরে, এ বাড়িতে লিফট নেই।
— করিম, তোমার সঙ্গে ফোনে আলোচনা করে আমাদের মেরজুগা ট্রিপ ক্যানসেল করে দিয়েছি মনে আছে তো?
— বিলক্ষণ। ওরা অনেক বেশি দাম নিচ্ছিল, আমি এক তৃতীয়াংশ কম দামে ব্যবস্থা করে দেব।
— তিন দিনের ট্রিপ তো?
— অবশ্যই
— সাহারা মরুভূমির মধ্যে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা?
— থাকবে থাকবে
— আর কীসব যেন, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই যেখানে সিনেমার শুটিং হয়
— সব থাকবে, চিন্তা নেই
আমরা তিনতলায় চলে যাই। করিম ঘর দেখায়, ছাদ দেখায়।
—করিম আমরা একটু পরে বাইরে বের হবো। কোথায় যাব বলো তো রাতের খাবার খেতে?
করিম কাগজ এনে এঁকে এঁকে বুঝিয়ে দেয় এই মেদিনা মার্রাকেশের রাস্তা ঘাট।
— আর যদি হারিয়ে যাই আমরা?
— হারিয়ে গেলে ভয় নেই, এল কুতুবিয়া যে মিনারটা আছে ওর কাছেই এই রামিল্লা।
— রাতের বেলায় নিরাপদ তো?
করিম হেসে ফেলে।
— রাত একটা অবধি গমগম করে এই মেদিনা।
করিম চলে যাচ্ছিল, আবার ডাকি।
করিম ব্যাংক কখন খুলবে কাল? টাকা ভাঙাবো।
— ব্যাংকে কেন টাকা ভাঙাবে? ব্যাংক অনেক কমিশন নিয়ে নেবে। এল কুতুবিয়ার কাছেই আছে আলি হোটেল, চব্বিশ ঘন্টা খোলা, ওরা কমিশন কাটে না। ওখানে ভাঙিয়ে নেবে।
— আলি হোটেল?
— জামা-এল-ফ্নার পাশেই।
বিদ্যুতের ঝলকের মত মনে পড়ে যায় এই নাম। জামা এল ফ্না। মার্রাকেশের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
আমরা অল্প বিশ্রাম এবং স্নান করেই বেরিয়ে পড়ি সেই দিকে। পথে অনেক দোকান পাট, হোটেল রেস্টুরেন্ট, কিন্তু আমাকে ডাকছে জামা-এল-ফ্না।
এমন করে ডাকছে যেটা আমি কারোকে বোঝাতে পারব না। নিশির ডাকের মতো।