"আর আমার রূপকথায় একটু নারীশক্তির প্রকাশ আছে। রাজা, রাজপুত্তুরেরা আর নায়ক নন, ভুল ভ্রান্তি ভরা সাধারণ মানুষ। রানিরা আর রাজকন্যেরা দুর্বল নন, অসহায় নন, তাঁরাই সক্ষম । বিপন্ন হলে উদ্ধারের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারেন। নিঃসন্দেহে তাঁরাই নায়ক। তাঁরা নিজেরা শত্রুজয় করেন, কিন্তু বাহুবলে নয় বুদ্ধিবলে। রাজ্য উদ্ধার করেন, সুবুদ্ধির বলে। নারী-পুরুষের সামাজিক অসাম্য ঘোচাতে,নারীর আত্মনির্ভরতার প্রতি সম্মান জাগাতে এই দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। আমরা চাইব সমাজে ছেলেমেয়েরা সমান সম্মান, সমান সুযোগ পাক। নতুন যুগের মূল্যবোধগুলি এই নতুন যুগের ভাবনায় গোড়া থেকেই বুনে দেওয়া দরকার। রূপকথার দ্বারা তা সহজেই সম্ভব। আর আমরা, মা-বাবারা চাইব, তারা স্বপ্ন দেখতে শিখুক। রূপকথা সকলের হাতেই এই সোনার কাঠিটি তুলে দিতে পারে, কেউ নেয় কেউ নেয় না।"
নবনীতা দেবসেনের 'রূপকথা সমগ্র' পড়ে আগাগোড়া রূপকথাকারের এই কথাগুলোর অনুরণন অনুভব করেছি। বইটি হাতে নিয়ে এমন অন্যধারার ভাবনা দেখে আর হাত থেকে নামিয়ে রাখতে পারলাম না। একশ্বাসে পড়ে নিলাম এই বইয়ের একষট্টিখানা রূপকথার গল্প। আর পড়তে পড়তে যত এগিয়ে গেলাম, তত রূপকথার ময়ূরপঙ্খী ভেলায় চড়ে পাড়ি জমালাম রাজকন্যের দেশে। টাইম মেশিনটাকে এ্যাণ্টি ক্লক ওয়াইজ ঘুরিয়ে দিয়ে লাজুকলতা, হিয়ামন-দিয়ামন, চাষির বউ চম্পাকলি, জ্যোছনাবুড়ি, শুক্তিমতী, নীল সায়রের সবুজ মেয়ে এরা সবাই নাকখত কানখত দেওয়াতে দেওয়াতে নিয়ে চলল আমার শেষ শৈশবে। আমার উঠতি কৈশোরে।
কৈশোরের কচি লাউডগা জীবনে যখন একই ভেলায় ভেসে আমার মনপোতায় নোঙর ফেলছে কুমড়ো ফুলের আঁশের মত সজীব ভালবাসা আর শান দেওয়া অস্তর, যা দিয়ে এক্কেবারে যাকে বলে 'লড়কে লেঙ্গে' সব কিছু। ফিরে গেলাম সেই সময়ে। এই ভালোলাগায় কোনো ক্লেদ নেই। কোনো ফারাক নেই। নেই কোনো মিথ্যে বাহাদুরি। শুধুই সব অপ্রাপ্তি মুছে ফেলে নিজের দিকে ফিরে তাকানো! আর পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে চলে যাওয়া সেই আধো কৈশোরে।যখন শিউলি ফুল কুড়োতে গিয়ে কলেজ টিলায় সঙ্গী পিঙ্কিকে কোলে তুলে বিচ্ছিরি রকমের আদর করার চেষ্টা করেছিল একটা হাড় গিলগিলে কাকু। খুব কেঁদেছিল পিঙ্কি। পেছনে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলাম ওদের দুজনকে। তারপর কোনোক্রমে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে সে কী দৌড়। ভেবেছিলাম হাত দুটো ভেঙে দেব লোকটার। কিন্তু সাহস জোটাতে পারিনি। পালিয়ে এসেছিলাম। সেই বয়সে 'রূপকথা সমগ্র' পড়ে নিলে বোধহয় মনের জোর দশগুণ বেশি হোত। ডাণ্ডা মেরে ব্যাটাকে ঠাণ্ডা করে দিতাম।
তা এই বুড়ো বয়সে যখন বইটি পড়লাম, প্রতিটি গল্পে নিজেকে খুঁজলাম। আমার মন ভালো হয়ে যায় যখন দেখি 'চাষির বউ চম্পাকলি' রূপকথার নায়ক। "আর চম্পাকলির মনখোলা হাসি থেকে ছড়িয়ে পড়া চাঁপাফুলের সুগন্ধে কী যেন একটা ম্যাজিক আছে। মন্দ লোকের মন আপনাআপনি বদল হয়ে ভালো লোকের মন হয়ে যায়। সেই থেকে মন্দ জমিদারের মনমেজাজ ভালো হয়ে গেল,সে আর অত্যাচারী রইল না। উলটে উপকারি জমিদার হয়ে গেল। গরীব চাষীদের জমি বিলি করে দিয়ে তাদের দৈন্য ঘুচিয়ে, নতুন করে জীবন শুরু করল।" আহা-হা-হা!! কেমন যেন সাধারণের হাতে ক্ষমতা। ছোট ছোট দুঃখ ব্যথাওয়ালা লোকগুলোও পাল্টে দেবার সাহস দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সব বদলে দিয়ে নতুনদের পথ করে দেয়।
'গুগলিরানি আর শামুককুমার' গল্পে জলদত্যি পদ্মফুল তুলতে যাওয়া ভাইবোনকে টেনে নিয়ে গেল জলের তলায়। তবে 'ভগবান' তাদের দুটির কাতর ডাক শুনে মেয়েটিকে গুগলি আর ছেলেটিকে শামুকের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে দিলেন। এই গল্পে ভাই বোনের মিষ্টি ভালোবাসার বয়ান পড়ে চোখে জল ধরে রাখা যায় না। বলছিলাম, রূপকথার রূপ রস গন্ধ সব আছে এতে। তবে তফাত তো আছে । 'নীলমণিয়া' তে সাহসী শঙ্খিনী সর্পকুমারী নীলমণি পাথরটা হারিয়ে যখন কান্নায় আকুল, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল নেউল কুমার। ক্যামন সাপে-নেউলের সংসার। ওদের বিয়েও হল। রাজকন্যের বেশে দেখে নেউল তো ওকে বিয়ে করল। আবার নীলমণি পাথরটার জাদুতে নিজেও হয়ে গেল মানুষ বর। তবু সর্পকুমারীর ভয় তো কাটে না। সে " পূর্ণিমার রাত্তির হলেই চমৎকার পায়েস রান্না করে, তার সঙ্গে একটা ঘুমপাড়ানি ফুলের মধু মিশিয়ে দেয়। নেউল ঘুমিয়ে পড়লে, সে সর্পকুমারীর রূপ ধরে সর্পরাজ্যে চলে যায়। ভোর হতে না হতে ফের ফিরে এসে রাজকন্যের রূপ নিয়ে খাটে ঘুমিয়ে থাকে।" সংসার করতে গিয়ে কত না চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় মেয়েদের। এই লুকোচুরি খেলা ধরা পড়ল একদিন। তখন কী দৃপ্ত অবস্থান আমাদের রূপকথার নায়ক শঙ্খিনীর। সে বলছে, "এবারে শোনো। নিজে থেকে আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি, তুমিই জোর করে আমাকে বিয়ে করেছ। আমি তখন যদি তোমাকে বলতুম যে আমি শঙ্খিনী সর্পকন্যা, তুমি তাহলে আমার নীলমণিও খুঁজে দিতে না, আমাকে মেরে ফেলতে। অন্তত যুদ্ধ করতে। আপন প্রাণরক্ষার অধিকার সব জীবেরই আছে। তাই আমি মিথ্যা বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমাকে বিয়ে করার শর্ত করিয়ে নিয়ে তবে মণি খুঁজে দিলে, সেটাও কি ঠিক? পরোপকার যদি শর্ত বেঁধে করা হয় তবে আমারও রাজকন্যে সাজায় দোষ নেই। আমি তো সত্যি রাজকন্যে। সর্পরাজের কন্যা।" এই স্পষ্টবাদী, সাবেক ভাবনার বাইরে এসে যুক্তিনিষ্ঠ বিচারের ক্ষমতা রাখা অতি সাধারণ মেয়েরাই নবনীতার রূপকথার প্রোটাগনিস্ট।
'টুলটুল, ফুলফুল আর বুলবুল' এক অদ্ভুত মায়াময় মায়েদের গল্প। বাঘিনী মা আর মানুষ মায়ের সন্তানকে একযোগে মাতৃস্নেহ দানের কী ভয়ানক সুন্দর গল্প। "টুলটুল ফুলফুলের জন্যই ডাইনির ফুসমন্তর ঘুচে গেল।" আবার এক জায়গায় বলা হয়েছে, " আমার দুধের বাছারা, দেখি তো আমাকে চিনতে পারো কিনা! বলে একটা রূপোর থালায় সোনার বাটিতে ভরতি চির বাটি সুগন্ধী ক্ষীর আর স্ফটিকের গেলাসে চার গেলাস গোলাপি শরবত নিয়ে এগিয়ে এলেন যিনি, তার চোখের মিষ্টি হাসিটা ঠিক বাঘিনী মাসির মমতামাখা চোখের মতন। ওরা বললে---'তুমি আমাদের বাঘিনী মাসি!' তিনি হেসে বললেন, হ্যাঁ গো, আসলে কিন্তু তোমাদের ধাই-মা হই!" তথাকথিত নারীবাদ, নারীশক্তির জয়জয়কার, নারী সশক্তিকরণ দেখানোর জন্য বিশেষ কোনো প্রয়াস গল্পগুলোতে নেই। চিরন্তন মাতৃসত্তা, প্রাণের ধনকে যখের মত আগলে রাখার যে মানবিক গুণাবলী, তা রূপকথার জাদুকাঠির ছোঁয়া লেগে একটুও ফুলে ফেঁপে ওঠেনি। বরং মাটির প্রলেপ পড়ে সেই মৃন্ময়ীরা যেন আরো বেশি করে চিন্ময়ী রূপে ধরা দিয়েছেন।
'চুমকির মা পদ্মমণি' আরেক তপস্যার কাহিনী। পদ্মমণির তপস্যা। " চুমকি যখন খুব ছোট মেয়ে, আরো ছোট্ট, এই আ্যাত্তোটুকুনি, তখন চুমকির মা পদ্মপুকুরে ফুল তুলতে গিয়ে আর ফেরেননি।" যেখানে 'মানুষের সাত বছরে যক্ষের একদিন' সে--ই যক্ষপুরী থেকে ধৈর্যের ও বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে পদ্মমণি ফিরে এল মেয়ের কাছে। পরিবারের কাছে।
"জলের ধারে, পদ্মাসনে,
'মা' জপবে একটি মনে।"
জপেছে ছোট্ট চুমকি। ছোট বড় সব বয়সের মেয়েদের নিজেদের মত করে লড়ে জিতে যাওয়ার স্বপ্নময় অধ্যায় ছড়ানো এক প্রাণবন্ত গল্প সংগ্রহ এই রূপকথা সমগ্র।
আর রূপকথায় আধুনিকতার ছোঁয়া ! পড়লেই আনন্দে নেত্য করতে ইচ্ছে করে। 'তিনপরির দুষ্টুমি' গল্পে দারুণ সব ব্যাপার স্যাপার পরিদের। "তাদের রান্না করতে হয় না, বাজার করতে হয় না, কাপড় কাচতে হয় না, এমনকী দাঁত মাজতে, চান করতেও হয় না। তাদের কাপড়গুলি প্রত্যেকদিন আপনি নতুন হয়ে যায়,......... তাদের পেট ভরে যায় ফুলের মধুতে, আর ঘাসের শিশিরে তেষ্টা মেটে।.... তাদের ইস্কুল নেই, লেখাপড়া শিখতে হয় না, টিকে নেওয়া নেই, ইঞ্জেকশন নেওয়া নেই, ওষুধ খাওয়া নেই।" সবই ভীষণ চেনা তথ্য। জানা সত্যি ঘটনা। তবু ছাপার অক্ষরে দেখলে সে--ই যে কচি মন, ফেলে আসা একটুকরো শৈশব যেন আনন্দে দুবাহু তুলে নেত্য করে। লেখক নিজেও বইখানির শুরুতে বলে রেখেছেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন রয়েছে।" তাই তো গল্পটিতে তিনি জুড়ে দেন- "সন্ধ্যাপরি রোজ আঁধারপরির সঙ্গে খেলা করে, গান করে, গল্প করে, তারপর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। তখন আসেন চাঁদবুড়ি। তিনি এসে পরিদের মাথায় মেঘবালিশটা ঠিক করে দেন, গায়ে কুয়াশার চাদরটা টেনে দেন, আদর কর গালে চুমি খেয়ে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে যান।" এরমত উপাদেয় ঘুমপাড়ানি পরিবেশ আর কী হতে পারে! আহা! আজো এই হাফ সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই জীবনেও বড্ড হিংসে হয়। এমন একখান স্বপ্ন কেন দেখলাম না আমার শৈশবে ! দূরছাই! ভাল্লাগে না!
রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি কী নেই এই রূপকথার দেশে। যত পড়ি, তত ভাবি, আর অবাক হই । গল্পের নাম ' নেই-বুড়োর দেশ'। নচিকেতার 'আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম'! আমরা নাজেহাল বুড়োবুড়িদের নিয়ে। নবনীতার হয়ে দেবদত্ত বলছেন, "মহারাজ। আমি আমার দাদুকে খাদে ফেলতে পারিনি। নিয়ে গিয়েও ফেরত এনেছি।আর চিলেকোঠাতে লুকিয়ে রেখেছি। আমার দাদুভাই-ই তো ছাইয়ের দড়ি তৈরি করবার বুদ্ধি দিয়েছেন, আমার দাদুভাই-ই তো শাঁখে সুতো পরানোর বুদ্ধি দিয়েছেন। পাকা মাথা ছাড়া এসব কখনও পাওয়া যায়?" 'ভালো রাজার দেশ' গল্পে দারুণ এক ইউটোপিয়ার ছবি ! "সে-দেশে ঠগ নেই, জোচ্চোর নেই, চোর নেই, ডাকাত নেই। এমনকী, থানা নেই, পুলিশ নেই, জল্লাদ নেই।....ফলে, সেই দেশে বাঘসিংগির সঙ্গে মানুষের কোনও শত্রুতা নেই। বনের বাঘ বনেই থাকে, তারও সেখানে খাবারদাবারের অভাব নেই, সে মানুষ ধরে খায় না। মানুষও তাই ফলমূল, কাঠ, মধু আনতে বনে যেতে ভয় পায় না।" এই লাইনগুলোতে কি নেই বলুনতো! বর্তমানের অস্থির সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যার কী সহজ সমাধানসূত্র।
একষট্টিখানা গল্প। সবগুলো যদি এখানেই স্পয়েল করে দিই তবে চমক আর রইল কোথায়! তাই বলছি, পত্রভারতী প্রকাশনা সংস্থার থেকে প্রকাশিত নবনীতা দেবসেনের 'রূপকথা সমগ্র' বইটি ঘরে না থাকলে সংগ্রহ করে একবারটি পড়ুন। আর ফিরে যান নিজের শৈশবে। সমসাময়িক সময়ের নিরিখেও যে ওমন ফ্যাণ্টাসি ওয়ার্ল্ড গড়ে তোলা যায়, তা এই বই না পড়লে ভাবতে কষ্ট হোত। আর বিশেষ করে মেয়েদের বলছি, আমরা সবাই অতি সাধারণ। তবু পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সব বিপদ জয় করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যেতে এই বইটি কিন্তু অবশ্যপাঠ্য করে রাখুন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।