ঝিমপাহাড় আর সবুজ বনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। দূর থেকে দেখলে 'হ্যামলেট' কথাটাই মনে আসে প্রথমে। গ্রামের এক প্রান্তে অতলস্পর্শী খাদ, সেখানে অতিকায় বৃক্ষরা জড়ামড়ি করে নেমে গেছে অরণ্যের বুকে। অন্যদিকে সবুজের সিড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে বরফাচ্ছাদিত চুড়ার উদ্দেশে।
ইজারায়েলের ব্যাকপ্যাকাররা বছর চল্লিশ আগে খুঁজে বের করেছিল এই রত্ন, চার দশকের শত হাঙ্গামাতেও তার ঔজ্জ্বল্য একফোঁটাও মলিন হয়নি। হয়নি যে, সেটা সত্যি আশ্চর্য! মাত্র ঘন্টা চারেকের দূরত্বে অবস্থিত পার্বতী নদীর ধারে একটা কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে উঠেছে প্রায়। পার্টি ক্রাউডের জ্বালায় গ্রামের মানুষ তো বটেই, বনের পাখিরাও অস্থির। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্যভাবে এই গোপন গ্রামটা বেঁচে গেছে।
ভাগ্যিস! এই অচিনপুরের ডাকে সাড়া না দিলে সত্যি আফসোস থেকে যেত। বৃষ্টির ছাঁট মাথায় নিয়ে হারিয়ে যাওয়া হত না মেঘেদের দেশে, সবুজে গা ডোবানোর অভিজ্ঞতাও রয়ে যেত অধরা। অথচ এখানে যাওয়া প্রায় ছেলেখেলা। ট্রেকিং প্রায় করতে হয় না বললেই চলে, হাইকিং ট্রেলও ঘন্টাখানেকের চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু নির্ভেদ্য অরণ্য এখানে এখনও একইরকম সচল, একইরকম জীবন্ত।
জংলি নালা পিছু ছাড়ে না মুহুর্তের জন্য, কাটাকুটি করে জলের সোঁতা এগিয়ে গিয়েছে বন কেটে। পাখির ডাক আর ভ্রমরের গুঞ্জন শুনতে শুনতে হাঁটা। ক্রমে সবুজের প্রলেপ ঘন হয়ে আসে। এমন সময় আমাদের চমকে দিয়ে উন্মোচিত হয় একটা ঝরনা। আমাকে আর পায় কে? সটান জুতো খুলে পাহাড়ি নদীর জলে পা ডুবিয়ে দিই, তারপর জলপ্রপাতের ধারে পাথরের উপর গা এলিয়ে দিই। ঠান্ডা জলের ছিঁটে মুখে এসে লাগছে, ততক্ষণে আমার মনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা ক্যাওড়া কবি একটা কবিতার বইয়ের নাম ভেবে ফেলেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে'; আমি না হয় লিখব 'জলপ্রপাতের ধারে ঘুমাবো বলে!'
ওঠার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু উঠতেই হয়। দুপুর হতে না হতেই পাহাড়ে আকাশের মুখভার হয়। বৃষ্টি হলে এই হাইকিং রুটে এগোতেই পা পিছলে আলুর দম হতে হবে। ফিরতি মেঘের পানসে মুখ দেখে পাহাড়ে ওঠা শুরু হয়। এইবার একটু চড়াই এসেছে বটে! শুকনো ফুল মাড়িয়ে ঝোপঝাড় ঠেলে এগোচ্ছি, মাঝেমাঝে রাস্তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। সুঁড়িপথগুলো সযত্নে এড়িয়ে মেইন ট্রেলে এগোচ্ছি তখন। বাকিগুলো কাঠুরিয়া আর ঘোড়ার চলার রাস্তা। এই বনে আরো কিছু ছোটছোট গ্রাম আছে, সেখানেও যাওয়া যায় ইচ্ছে হলে। কিন্তু পথ না জানলে হয়রানি হতে পারে।
বিকেলের আগেই গন্তব্যে এসে উপস্থিত হলাম। সবুজের ঘনঘটা থেকে তখন মনের ভিতর লাবডুব লাবডুব শব্দ হচ্ছে। এই সবুজের রঙ লিখে বোঝানো যায় না। এত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি, কিন্তু অন্তত দিন তিনেকের পায়ে হাঁটা পথ না হাঁটলে এমন মারদাঙ্গা সবুজের সঙ্গম তেমন চোখে পড়ে কই! ভাগ্য ভালো হলে বেদেনি বুগিয়াল বা কাশ্মীরের বেতাব ভ্যালিতে কাছাকাছি মশলা পেতে পারেন, না'হলে আল্পস ছাড়া গতি নেই। অবশ্য পাহাড়ের মায়া না থাকলে কেরলের পালক্কড়, সাইলেন্ট ভ্যালি আর মুনরো আইল্যান্ডের সবুজও মগজদখল করতে পারে, কিন্তু তার মেজাজ একদম আলাদা।
যাই হোক, লাফাতে লাফাতে চললাম। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। খাদের ধারে কাঠের বাড়ি, ঢালু জমিতে গমের খেত, সবজি বাগান। হিমাচলি মহিলারা মাথায় কাপড় বেঁধে খেতে কাজ করছে। কিছুটা দূরে ঢেউয়ের মতো ঘাসের মাঠ, সেখানে ঘোড়া চরছে। দু'টো পাহাড়ে ভাগাভাগি করে কয়েকটি বাড়ি, মাঝখানে দিয়ে বয়ে গেছে নালাটা। নালার উপরের কাঠের সাঁকো পেরিয়ে অন্যদিকে চলে এলাম। খুঁজেপেতে একটা হোমস্টে নেওয়া হল। যতটা না বাড়ি, তার চেয়ে বেশি বাগান। রকমারি ফুল ফুটে আছে, তাছাড়া বাঁধাকপি, বেগুন, টম্যাটো, লঙ্কা তো আছেই।
স্থানীয় খাবার খেয়ে চাঙ্গা হয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলাম। একপশলা বৃষ্টি হয়ে সবুজের রঙ আরো গাঢ় হয়েছে, তার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। বাহুল্য নেই, কিন্তু যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
ফুলকাটা বারান্দা, জানলা, রেলিংকাঠ, খড়ের গাদা, গোয়ালের গরুর ঘণ্টি....ছাড়া ছাড়া কয়েকটা হোমস্টে। লাল রোয়াক আর খোলা বারান্দা থেকে ভেসে আসা পুরোনো গানের সুর। রেডিও বাজছে। হঠাৎই এক ভালো লাগা মনখারাপ জড়িয়ে ধরে, দলছুট মন পথ হারিয়ে ছুটে যায় অতীতে। এরকম কোনঠাসা দুপুর অথবা টিউশনি সন্ধ্যের ভিজে মরশুমে রেডিও শোনার অভ্যেস আমার বহুদিনের, সে সব দিন এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। 'ছায়াগীত' আর 'আপকি ফরমাইশ' এর মায়াজাল ছিঁড়ে জোর করে হাঁটা দিই, কানে লেগে থাকে সেই বাগানসুরের মূর্ছনা...
এক চিলতে গ্রাম। গ্রামের পর খেত। খেতের পর পাহাড়। গম থেকে আলু, কপি থেকে সরষে... প্রায় সব কিছুর ফলন হয় এই গ্রামে। দেখতে গেলে একেবারে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট, শহরের উপর কোনও নির্ভরশীলতা নেই। আগে বিদ্যুৎও ছিল না, বছরকয়েক হল এসেছে। মোবাইল কভারেজ নেই, কিন্তু মোবাইল আছে সকলের কাছেই। সেই মোবাইলে আকাশবাণীও বাজে, আবার বাদশাও বাজে। মার্ফির পুরোনো রেডিওর স্মৃতিভেজা অনুষ্ঠান আর সরগম আমাদের নস্টালজিয়ার জগতেই বেঁচে থাক।
সবুজে গা ভিজিয়ে একটা জায়গায় বসলাম। চা খেতে হবে। চা, পাহাড় আর বৃষ্টির সঙ্গম বড় একটা হয় না, তাই আমি যে আহ্লাদে আটখানা সে কথা আলাদা করে বলার নেই। গ্রিন টি না হয়েও চায়ের রঙ সবুজ দেখায় আমার চোখে। সেই ক্লোরোফিল ভাসা চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আলো কমছে, সন্ধ্যের আসর নেমেছে জঙ্গলের বুকে। আড্ডার আড়ালে যে কথোপকথন চলছে, তার নাগাল পাওয়া কঠিন। আমরা শুধু চিন্তাজলের সলতে হাতে অপেক্ষা করে থাকি, ছবিঘর বাঁধি মনে মনে।
রাত নামে। মুর্গির ধোঁয়া ওঠা মাংস আর রুটি নিয়ে ততক্ষণে আমরা পুরোদস্তুর টুরিস্ট। হিমরাত জাগে চিকচিক পাথরে, চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আদিম বনের উপর।
পরদিন ফিরে এসেছিলাম। আমার দলছুট মন অবশ্য প্রতিবারের মতো ফিরে আসতে নারাজ। আজও সে সবুজে গা ডুবিয়ে বসে রেডিও শুনছে।
কী যে ভাল
কী ভাল। কোথায় কী নাম আর জিগেশ করলাম না, এই যে লেখেননি এই ভাল।
তবে সবুজই বললে, পশ্চিমঘাটের সবুজও নেশা ধরানোর মত।
আপনার লেখা খুব সুন্দর। ছবিও। চিরকালের জন্য এই জায়গাটায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
ধন্যবাদ