কোনার্ক থেকে ফিরছি। সারাদিনের ট্রেন। গায়ে ‘সুপারফাস্ট’ লেখা, কিন্তু কাজ করে না। চেয়ার-কার। পিঠ সোজা করে ঢুলুনি। রিজার্ভেশন ব্যাপারটা কারুর কাছেই খুব স্পষ্ট নয়। অনেকেই এসে ক্লেম করছে ২০ নং সিটটা তার, কিন্তু ওটা আসলে আমার। ফিরছি, আমি আর আমার বন্ধু।
এমনিতেই দূরপাল্লার ট্রেনে বাঙালী সহযাত্রীর সান্নিধ্য আমি খুব একটা উপভোগ করি না, যদি না একেবারেই আত্মীয়-পরিজন গোত্রের হন তাঁরা। কারণ, বাঙালী মূলতঃ পরিবার-পালিত পশু। তাই, ট্রেনে করে দূরে যাওয়ার পথে, এবং দূর থেকে ট্রেনে করে ঘরে ফেরার পথে তাঁর মধ্যে একটা অবিশ্বাস্য সেন্ট্রিপেটাল ফোর্স কাজ করে পরিবারের প্রতি, ঘরের প্রতি। তখন, ট্রেনে, বাঙালী ভাষা দিয়ে পরিবার বিচার করে। আপনারা দু’জন এক ভাষায় কথা বলেন মানে হয়ে গেল। প্যান্ট্রি কারের ভাত, মিষ্টি এবং সবশেষে বাঙালী খিস্তি দিয়ে কাছে টানে। এ’সব আমার ভালো লাগে না। তাই ট্রেনে উঠলে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়ি, নয়তো উইন্ডো সিট পেলে বোবা হয়ে যাই।
এই ট্রেনে উঠে আমি আর নীলাঞ্জন ভারি খুশি হলাম, আমাদের মুখোমুখি কোনও বাঙালী নেই। পিছনের ক্যুপ থেকে বাংলা কথাবার্তা আসছিল, মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিলাম, ৩ জন-৩ জন করে দুটি বাঙালী পার্টি, প্রত্যেকেই পঞ্চাশের ঘরে (দেখে মনে হয়), এবং তাঁরা এরই মধ্যে একে অপরকে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে ধরতে শুরু করেছেন। আমরা আবার ফিরে নিজেদের মতো রইলাম।
একটা বয়স ছিল, যখন ট্রেনে উঠলেই মনে হত, আহা উল্টোদিকের সিটে যদি কোনও সুন্দরী এসে বসে! তখন এসে বসতো পাকা বাচ্চা, কানে ট্রানজিস্টর লাগানো দাদু, এরা। দু’এক বার আমাকে পরিহাস করতে সন্ন্যাসীও এসে বসেছে। তারপর ট্রেনে যাওয়া-আসা বাড়তে লাগলো, আর আমিও বুঝলাম, সুন্দরী মেয়ে আসলে ইয়েতির মতো একটা ব্যাপার। স্লীপার ক্লাসে তাকে খোঁজা বৃথা; তার চেয়ে পিএইচডি করা ভালো। স্লীপার ক্লাসে একমাত্র একধরণের সহযাত্রী পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি থাকে, সে হল বাঙালী। এঁদের মধ্যে কোনও সুন্দরী মেয়ে, অকলুষ শিশু পাওয়া যায় না। এরা শুধু ট্রেনের সিটে ফেলা-ছড়া করে ভাত খেয়ে সিটটাকে নোংরা করে, তারপর “মনা খেয়ে নে খেয়ে নে” করে পেপসির মতো জেলুসিল খায়, খেয়ে গর্জন করে “ঘাউ” শব্দে ঢেঁকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়ে, এবং তার মাঝে যাবতীয় বখেড়া, ঢপের আলাপ-পরিচয়, “আপনি তো আমার ভাইয়ের মতো”, ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁদের আপনার উল্টোদিকে না-পাওয়াই কাম্য।
আমাদের পিছনের ক্যুপে শুনছি একের পর এক খাবার নেওয়া হচ্ছে। যে অর্ডারে শুনেছি, এখানে লিখছি – চিকেন বিরিয়ানি, এগ চপ, পেঁয়াজি, শিঙাড়া, রাবড়ি। সবার জন্য। এদিকে আমরা রুটি-আলুজিরের প্যাকেট ধরে বসে আছি। কটক এলে খাব। আরও অনেকটা পথ। বেশি তাড়াতাড়ি খেলে খিদে পেয়ে যাবে পরে। ওদিকে, বিরিয়ানি-চপ-পেঁয়াজি-শিঙাড়া-রাবড়ি একসঙ্গে খেলে যা হয় আর কি! একটু পর বায়ু মাথায় উঠে বাজে বকা শুরু। শুনলাম এক ভদ্রলোক উল্টোদিকের ভদ্রমহিলাকে বলছেন, “পা-টা ঠিক করে বসুন। আমার ব্যাগে লেগে যাবে!” মহিলা বললেন, “হুহ্! আমার কি পায়ের ওপর কন্ট্রোল নেই নাকি? আমি লাথি মারব না!” আবার পুরুষকণ্ঠ, একটু জোরে, “আবার বলছি কিন্তু, আপনি বড্ড পা দোলাচ্ছেন!”
এত অব্দি দেখে, আমি কানে গান দিয়ে বোবা হয়ে গেলাম। বাইরে ধু-ধু মাঠ পেরিয়ে যেতে লাগলো একের পর এক। ভাবলাম, এ’সব বাঙালীর আদরের ঝগড়া, উড়িষ্যা পেরোলে ঠিক হয়ে যাবে। কোনার্ক যাওয়ার আগেই ‘সমান্তরাল’ দেখেছিলাম, রূপঙ্করের “এত মন এত জন মিলে স্বপ্ন দেখায়” গানটার ভারি প্রেমে পড়েছি, লুপে শুনছি। কতক্ষণ গেছে জানি না, হঠাৎ খেয়াল করলাম রূপঙ্করের পিছনে কারা সব জোরে জোরে কথা বলছে। গানটা বন্ধ করতেই কানে এল, পিছনের ক্যুপ থেকে –
-আপনি একটা শুয়োরের বাচ্চা!
-না! আপনি একটা শুয়োরের বাচ্চা!
-আপনি এখানেও আমার ওপর দিয়ে কথা বলবেন?? আপনি একটা নন-সেন্স!
-আপনি একটা শুয়োরের বাচ্চা!
-চোপ! ব্যাগে খালি লাথি মারে!
-শুয়োরের বাচ্চাই তো! নাহলে আপনি বললেন কেন আমি পাতা খাই?
এদিকে আমি তো পুরো ভোম্বল! শুয়োরের বাচ্চা, ব্যাগে লাথি, পাতা খায় – একবর্ণ রিলেট করতে পারছি না! শেষে গালাগালি এমন চরমে উঠলো যে আশেপাশে যত অবাঙালী ছিল, তারাও দু’ দলে ভাগ হয়ে সাইড নিয়ে “সহি হ্যায়, সহি হ্যায়” বলতে লাগলো। অথচ এখনও অব্দি কিন্তু যা বুঝলাম, ব্যাগে পা লাগেনি। অ্যানটিসিপেশনেই কুরুক্ষেত্র!
কটকে কপালটা পুরোপুরি পুড়ল। উল্টোদিকের সিটের লোকজন নেমে যাওয়ায় একটু পা ছড়াতে গিয়েছিলাম, সে জায়গায় এলেন পাঁচজন বাঙালী। এরা আরও বয়স্ক, ষাট-পঁয়ষট্টি তো হবেই। দু’ জন পুরুষ, তিনজন মহিলা। এঁদের মধ্যে দুটি জোড়া, এবং একজন মহিলা অবিবাহিতা বা একা। তিনি আবার বাকি দুই মহিলার একজনের বোন। আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে এরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে নাটকের এক্সপোজিশনের মতো এতকিছু স্পষ্ট করে দিলেন। এই দুই পুরুষের একজন, বিশালাকৃতি, আমার পাশে এসে “এই তো সিট” বলে প্রায় আমার ওপরেই বসে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমোচ্ছেন, হয়তো বা স্বপ্ন দেখছেন, আর সেই স্বপ্নে হয়তো বা তিনি মাঝে মাঝেই আছাড় খাচ্ছেন বা কেউ এসে তাঁকে “ধাপ্পা” বলে ভড়কে দিচ্ছে, যার ফলস্বরূপ তিনি ঘুমের মধ্যেই আমাকে শুদ্ধু চমকে দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছেন। অন্য ভদ্রলোক অপেক্ষাকৃত শান্ত। তিনি চশমার নিচ দিয়ে কাগজ পড়েন, আর ওপর দিয়ে এই জগত-সংসার দেখেন। মাঝখানে চশমাটাকে কেন চোখের হেলমেট বানিয়ে রেখেছেন, কে জানে! কিছুক্ষণ পর এরাও ঝালমুড়ি নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেন। ঘুমন্ত মানুষটি জানালেন, তিনি খাবেন না, তাই চার প্যাকেট ঝালমুড়ি নেওয়া হল, তারপর ভদ্রতার খাতিরে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে আরেকবার অফার করায় “বললাম তো আমি এসব খাই না” বলে তিনি চোখ বুজেই গোটা দু’হাত পেতে বসে রইলেন। প্রত্যেকেই তাদের প্যাকেট থেকে কিছুটা করে মুড়ি সেই অঞ্জলিতে ঢালতে শুরু করলো, শেষে দেখা গেল তাঁরা কম মুড়ি পেয়েছেন এবং ঘুমন্ত মানুষটি বেশি, এবং সবশেষে ঘুমন্ত মানুষটিকে আবার ধাক্কা মেরে বলা হল তাঁর হাতে মুড়ি, সেই শুনে তিনি প্রচণ্ড চমকে আদ্ধেক মুড়ি ছড়িয়ে ফেলে বাকি আদ্ধেক খেতে খেতে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
একটু পর চা-ওয়ালা এল। পুরাকালে কৃষ্ণকে দেখে গোপিনীরা যেমন একে অন্যের কানে “শ্যাম, শ্যাম” বলে ফিসফিসিয়ে চারদিক মুখর করে তুলত, এই তিন ভদ্রমহিলাও চা-ওয়ালাকে দেখে “চা-চা” রবে আমাদের একেবারে অতিষ্ঠ করে তুললেন। শেষে, বাঙালী চা-ওয়ালা কাছে আসায় দূরপাল্লার ট্রেনে হিন্দি বলার অদম্য ইচ্ছা চরিতার্থ করতে তাদের একজন বললেন, “চায়ে কেতনা?” চা-ওয়ালা বলল, “মাসিমা, ১০ টাকা।” মাসিমাঃ “তো খিলাও।”
১০ মিনিটের মধ্যে চা-ওয়ালা ফ্যাকাসে। এমনিতেই চা নিয়ে বাঙালীর হাজার একখান ফ্যাকড়া! মহিলারা জিজ্ঞেস করলেন, “লিকার আর দুধ-চা, দুইই আছে তো?”
-আছে।
-তাহলে আমাদের শুধু দুধ-চা দাও!
তাহলে লিকারের কথাটা তুই জিজ্ঞেস করলি কেন, অ্যাট দ্য ফার্স্ট প্লেস? তারপর চিনি নিয়ে শুরু হল! আমাকে এক চামচ! আমাকে আধ চামচ! আমাকে এইটুকু – বলে ভদ্রমহিলা নিজের নখের সামান্য অংশ দেখাতে গিয়ে বুঝলেন নেলপলিশের জন্য তিনি নখটাকে এতই বড় রেখেছেন যে অতটা চিনি দিলে মিষ্টি বেশি হয়ে যাবে! তাই অতটা দেখিয়ে আবার মুখে বললেন “এর একটু কম!” এদিকে চশমার ওপর দিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন “এটা কি হাফ-ডাস্ট?” শুনে চা-ওয়ালা প্রায় পাথর হয়ে যাচ্ছিল। একজন মহিলা এক কাপ চায়ে দুটো ডিপ নিলেন, তারপর গল্প করতে করতে সেগুলোকে তুলতে ভুলে গেলেন, এবং তারপর মুখে দিয়ে “ব্যাব্যাগ্যো কি কড়া!” এর মাঝে ঘুমন্ত মানুষটিকে আবার ডাকা হল, জানতে চাওয়া হল চা খাবেন কিনা। তিনি “আমি ট্রেনে একদম চা খাইনা” বলে হাতের আঙুলগুলোকে চায়ের কাপ ধরার পজিশনে রেখে বসে রইলেন। তাঁর হাতে কাপ ধরানো হল। খেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলার সময় হয়তো খেয়াল ছিল না যে ট্রেনের জানলায় হাওয়া দেয়। তাই আলতো করে কাপটা ছেড়ে দিয়ে চশমাধারীর গায়ে একপ্রস্থ চা ছিটে আরেক বিপত্তি। আরও কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রী “ঠাণ্ডা লাগছে, কাঁচটা নামিয়ে দাও” বলায় তিনি ঘুম থেকে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে “কই কাঁচ” বলে ট্রেনের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে।
অবশেষে ট্রেন খড়গপুর পেরোনোর পর ঘুমন্ত মানুষটি জাগলেন, এবং দাবী করলেন, “কলকাতা আরও সাড়ে তিন ঘণ্টা!” চশমাধারী চশমার ওপর দিয়ে বাইরের সন্ধে মেপে বললেন, “না, তিন ঘণ্টা কুড়ি মিনিট!” অতঃপর তাঁরা এই বিষয়ে একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং ভয়ানক রেগে গেলেন। আমি জানলার ধারে বসেছিলাম, ঘুমন্ত মানুষটি রাগের মাথায় আমাকে “দেখি একটু চাপুন তো দাদা!” বলে প্রায় জানলার বাইরে বার করে দিচ্ছিলেন। ট্রেন ছুটছে তখনও শহরের দিকে। আরও অনেকক্ষণ। আর আমরা? আমাদের কথা না হয় থাক। কলকাতা পৌঁছে গে’ছিলাম সেদিন। নাহলে আর এ’সব লিখছি কি করে, বলুন!
:)
দূর্দান্ত লেখা। ১০/১০। এক্কেবারে এই কিসিমের কত পাবলিক যে কত দেখেছি ট্রেনে সফরকালে।
:) :)
উপরের বার্থে শুয়ে থাকা ভালো। ঘুমিয়ে পার করে দেওয়া যায়। :-)
সে অবশ্য তিনথাকওয়ালা ক্যুপের গাড়ি, মানে আরো দূরপাল্লার। দিন দুই বা আড়াই মতন যেখানে লাগে।
ব্যাপক লেখা হয়েছে। ঠিক এই কারনেই আমি বাঙালিদের এড়িয়ে চলি।
আর আমি চেষ্টা করি প্লেনে ভারতীয়দের এড়িয়ে চলতে। একবার এক দেশি জনতা আমাকে বলতে এসেছিল - উই জাস্ট গট ম্যারেড - আমি থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম - দ্যাট ইস নট মাই ফল্ট।
প্লেনে, ট্রেনে, জলে, স্থলে, সর্বত্র বাঙালিদের এড়িয়ে চলি।
ধন্যবাদ সকলকে, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য। :)