আস্তে আস্তে সমস্ত পোশাক খুলে রাখবো একদিন। সব আবরণ একে একে ছেড়ে বেরিয়ে আসবো। এই পরিচয়ের ঢ্যারা বয়ে বেড়ানো অসম্ভব ক্লান্তিকর। যা কিছু দিয়ে দাগিয়ে নিচ্ছি নিজেকে, বা আশেপাশের মানুষ চিনে নিচ্ছে আমায়, আমি আসলে তা নই মোটেই। হলেও, শুধু সেটুকুই নই।
এই যে পড়ি, পড়াই, লিখি, এর কোনোকিছুতেই নিজেকে পুরো খুঁজে পাই না। আমি যে আছি, নিজের কাছে এগুলো তার প্রমাণমাত্র। আমি নই। এর বাইরে, একে ছাড়িয়ে আমার মাথার উপর প্রবহমান আকাশ, তার মেঘ আমার পরিচয়ের একাংশ। সেই অংশের ভিতরে আবার গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ এমনভাবে আরও পরিচয়, তারও মধ্যে শুধু বর্ষাতেই হাজারখানেক পরিচয় আমার জড়িয়ে আছে মেঘের অবস্থানে, উপস্থিতিতে। একইভাবে, সূর্য, চাঁদ, তারা, পান্থপাদপ গাছ, দুই রাস্তার জুড়ে এক হয়ে যাওয়া, আবার ভেঙে তিন হওয়া, প্রতিটি বইয়ের পাতার অক্ষরসমূহ, হাতে লেখা চিঠি, সুর, প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বরের যে জমি, নুয়ে থাকা ধানক্ষেত, রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়', বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক', ভাতের সাদা রঙ, ঘুঘু পাখির ডাক, সন্ধের আলোয় মাছের রুপোলি আঁশ, কান্না, প্রতিবাদের স্বর, ভীতি, হেরে যাওয়ার পর নিজের সঙ্গে বেপরোয়া প্রেস কনফারেন্স, এই সব ভেঙে চলেছে আমায়, আমার পরিচয়কে। আমি এই সব; বস্তুত আমি এর কিছুই নই।
প্রতিটা মুহূর্ত, পল কী কৌতুকভরে আলাপ করে নিচ্ছে আমার সঙ্গে! সাংঘাতিক ভেঙে পড়ার ক্ষণে সে কেমন আমার ভিতর বসে বসে পা দোলায় নির্লিপ্তভাবে, আবার কোনও কারণ ছাড়াই "কাল ছিল ডাল খালি/ আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই, মালী/ হয় সে কেমন করে" ভেবে একেবারে বিহ্বল, অভিভূত হয়ে পড়ি। কী কৌতুকভরে প্রতিটা মুহূর্ত আমার সঙ্গে আলাপ সেরে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে, বা আমি চলে যাচ্ছি, আর তা দিয়ে আমরা কেমন সুন্দর মেপে নিচ্ছি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ। আমার যা কিছু প্রাপ্তি বস্তুগত, সে আমাকে জীবনধারণ করাচ্ছে ঠিকই --- পেটে দানাপানি পড়ছে, তরল পদার্থ পড়ছে, গায়ে জামা চড়িয়ে বেরোচ্ছি সভ্য সমাজে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি, অসুখ হলে ওষুধ কিনছি, খাতা কলম কিনে লিখছি, উৎসবে সাজছি, উপহারে বই পাচ্ছি বা দিচ্ছি --- কিন্তু তাতে আমার স্থায়িত্ব বাড়ছে না এতটুকু মোটে, তাতে আমি কিছু বেশি জোর দিয়ে বলতে পারছি না, এই হলাম আমি! বা এইটা আরও বেশি করে আমি।
আমি যা, আমি সেটুকুই। যাকে স্থায়িত্ব বলছি, সে আসলে আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভেঙে যাওয়া। আমরা মানুষেরা বড় আশ্চর্য এক জীব --- আমরা ভাঙার ধনে ধনী। প্রাপ্তিতে আমরা যা পাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি পাই অপ্রাপ্তিতে। এই সমস্ত কিছুই যে আমারই পরিচয়, অথচ এর একটির উপরেও যে আমার তিলমাত্র অধিকার বর্তায় না, এর মাঝে নাকি আমি শুভংকর! আমি নাকি পুরুষ! আমার নাকি ধর্ম, কর্ম, ঠিকানা, দলগত আদর্শ, শিক্ষাগত যোগ্যতা (হিহি), গাদাগুচ্ছের সম্পর্কের সাতমহলা বাড়ি! বাপ রে, উফ, দরজা জানলা সব খুলে দেবো! একদিন ভেঙে দেবো সব জানলার কাঁচ, যাতে কেউ বন্ধ করে দিলেও বাতাস, বৃষ্টি সবই ঢুকতে থাকে। একদিন সমস্ত জামা, আবরণ খুলে রেখে দেবো। যদি খুলতে না-ও পারি, এটুকু স্মরণে রাখবো যে পারিনি। বলবো, পারিনি। আবার চেষ্টা করবো। স্থায়িত্বই নেই যেখানে, ভেঙে চলা ছাড়া দ্বিতীয় পথও নেই কোনও। একান্তই যদি কোনও রূপ দিতে হয় নিজেকে, আমি না হয় 'পথের পাঁচালী'র শেষের সেই পথ হবো, যে চলতে থাকে কেবল; বা গঙ্গায় ভেসে থাকা কচুরিপানা, যে উজানে যায় আর ভাটায় আসে, কিন্তু কূল পায় না।
ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে, যদুবাবু।