পনের বছর ধরে সিংগুর নীতি আঁকড়ে থেকে, নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতার ভার 'নিচুতলার' একশ্রেণির কর্মীর ঘাড়ে ঠেলে দিয়ে সিপিএম ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন এবং পরে বাংলার রাজনীতিতে অকিঞ্চিৎকর হয়ে উঠল। এই নির্বাচনে একঝাঁক তরুণ মুখ তুলে আনলেও, তাদের প্রায় সকলেই সিপিএমেরই নেতা-কর্মীরই বাড়ির সন্তান। তার বাইরে নতুন প্রজন্মের কাছে সিপিএমের গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। এমন কী নতুন করে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এরকম কোনও দিশাও দেখাতে পারে নি দল। এই নির্বাচনে সিপিএমের সম্পূর্ণ ডেসিমেশন বিভিন্ন সামাজিক পরিসর ও মিডিয়াতেও তাদের গুরুত্বহীন করে তুলবে। এই প্রেক্ষাপটে আশি বছরের বামপন্থী, কমিউনিস্ট রাজনীতির পরিসরে এক বিশাল শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যদি ধরে নিই বিভিন্ন কারণে দেশের গরিব মানুষের সংকট বাড়ছে, স্থায়ী পেশায় কর্মহীনতা বাড়ছে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, তাহলে অবশ্যই বাম রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা আজও বাড়ছে। তাই, বাংলায় বাম রাজনীতি কীভাবে বিকশিত হবে এই আলোচনার দরকার আছে। এই বিষয়ে কিছু পয়েন্ট যা মনে হচ্ছে
১) বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবীতে, মানুষের ব্যক্তিগত অ্যাস্পিরেশনের জায়গাটা এতটা বেড়ে গেছে যে বামপন্থী পার্টি কেন, একটা লিটল ম্যাগাজিন বা গ্রুপ থিয়েটারের জন্য নিষ্ঠ কর্মী, যিনি গোষ্ঠীর স্বার্থকে নিজের স্বার্থ বিদায় কাজ করবেন, জোটা দুষ্কর হয়ে গেছে।
২) সোভিয়েত পতন, চিনের ধারাবদল এবং প্রযুক্তি ও যোগাযোগের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাম রাজনীতির চিন্তাধারার নতুন বিকাশ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। পরিবার জাতি এবং পাড়া কাঠামো ভেঙে যাওয়া মানুষের চিন্তাভাবনাতেও অনেক পরিবর্তন এনেছে।
৩) এই দুটি সমস্যা মিলিয়ে বাম রাজনীতির ভিন্নতর চেহারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল, যা অনেকমাত্রায় কংগ্রেসি সমাজবাদী আদর্শে পরিচালিত হয়, অনেক বামপন্থী ইন্ডিভিজুয়াল সেই দল অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসে কাজ করতে চাইছেন। কিন্তু তা স্বত্তেও শ্রেণি রাজনীতি প্রভৃতি ধ্রুপদী প্রশ্ন ধরে পৃথক ভাবে বাম রাজনীতির অবশ্যই পরিসর রয়েছে। বাংলার বিভিন্ন বামপন্থী পার্টি ও গ্রুপ সেই পরিসরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবেন।
৪) ২০২৪ এর ভোট যদি তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ্যে থাকে, তাহলে তাকে সমাজবাদী বামঘেঁষা অবস্থান নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বামদলগুলি শাসকের থেকে আপাত সহযোগী ব্যবহার পেতে পারে। যা তাদের রাজনৈতিক বিকাশে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে লিবারেশন নামক দলটির বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান আছে। প্রথমতঃ তাঁদের সর্বভারতীয় উপস্থিতি এবং সংসদীয় রাজনীতির অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয়তঃ নো ভোট টু বিজেপি আন্দোলনে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং তৃতীয়তঃ ও খুব গুরুত্বপূর্ণ, দিল্লিতে আইসার উপস্থিতি, জাতীয় মিডিয়া হাউসের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার জন্য তৃণমূল জাতীয় রাজনীতির অভিযানে তাঁদের সাহায্য নিতে বাধ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।
৫) বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবি, যা স্থানীয় স্তরে নয় বরং সরকারি স্তরে আলোচিত হতে পারে, যেমন বন্দিমুক্তি, পরিবেশ, শ্রম আইন সংক্রান্ত দাবি, সেইগুলির ক্ষেত্রে বামপন্থীরা তৃণমূলকে সহজের আপোসের জায়গায় আনতে পারবেন।
৬) এইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, অতীতে বিভিন্ন বামগ্রুপ গুলিকে এক ছাতার তলায় আনার প্রয়াস বা বৃহৎ বাম ঐক্যের ডাক কিম্বা দুই পার্টির মার্জার, একটি দুটি ব্যতিক্রম ব্যতীত খুব স্বস্তিদায়ক হয় নি। দুটি পার্টির বিভাজনে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি থাকে, যা দুম করে মিটিয়ে ফেলা যায় না। এ ছাড়া বামফ্রণ্টের ইতিহাস দেখিয়েছে যে কীভাবে বড় শরিক ছোট শরিকদের সংগঠনকে সীমাবদ্ধ করে দেয়, তাকে নিজের উপর নির্ভরশীল করে দেয়। তাই বাম ঐক্যের পিছনে সময় অপচয় না করে প্রত্যেকে নিজের সংগঠন ও রাজনীতি নিয়ে আন্দোলনগত ও ইস্যুভিত্তিক মঞ্চে আসতে পারেন। কিন্তু নিজস্বতা বজায় রেখেই সকলের বিকাশের চেষ্টা করা উচিৎ।
৭) এক্ষেত্রে দলগুলি ভৌগোলিক বিভাজন মেনে নিতে পারেন। একের এলাকায় অপরে নাক গলাবেন না। এর ফলে নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাত কমবে এবং যার রাজনৈতিক পদক্ষেপ বেশি সফল হবে তার উঠে আসার সম্ভাবনা তত বেশি হবে।
আলোচনা হোল
টইয়ে তুললাম
এর মধ্যে কয়েকটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। এই লেখায় এল। এস এফ আইয়ের যে তরুণ মুখ এরাজ্যে এবার এল তারা মূলত এস এফ আই। সাধারণ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর বাস্তবিক এস এফ আই তার জায়গায়ই আছে। এখনও সিপিএম বহু জায়গায় শ্লোগান দেয় দ্বিতীয় সিঙ্গুর হতে দেবনা।
বিশ্বায়নোত্তর পৃথিবী 'পালিত বড়োর' ব্যুরক্রেটিক সেন্ট্রালিজম মানবে না। সুতরাং বামপন্থী শক্তির সাংগঠনিক কাঠামো ও চিন্তার আপডেট দরকার। আর একটা প্রবণতা, উৎকট ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রে নায়ক নির্বাচন, প্রধান মুখ এসব ফ্যক্টর কাজ করছে। যেই মুখ বামপন্থী সংগঠনে নেই। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে এসেও বড় শক্তিগুলির ছায়ায় ছোটরা ঢেকে যায়। ফলত ক্ষমতার বাইনারি থাকছে। সঙ্ঘাতের জায়গাতেও ছোট শক্তি থাকছে না।