২১শে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফেসবুকে বড়সড় হ্যাজ নামাব...
এঃ! দেখেছ? ফের 'হ্যাজ নামাব'!! আজকের দিনেও? ছিঃ! শেম অন মি...
হ্যাঁ, যতই চেষ্টা করি, আমাদের আবেগ-টাবেগ সব এখন হিন্দি কিম্বা ইংরেজিতেই প্রথমে আসে। দরকারে- অদরকারে বাঙালী এখন হিন্দি কিম্বা ইংরেজীতেই গ্ল্যামার খোঁজে।
কিন্তু, তাতে দোষের কী? ছেলেপুলেরা হিন্দিতে কথা বলুক, ইংরেজিতে ভাবনাচিন্তা করুক, ফরাসী কায়দায় হাঁচুক-কাশুক, অসুবিধে কী? ভাষাই তো। একটার জায়গায় পাঁচটা শিখলেই-বা ক্ষতি কী?
ক্ষতি নেই। কিন্তু, বাংলাটা পড়তে পারাটা যে বড্ড জরুরী। বাংলা সাহিত্যের মত ধনী সাহিত্য খুব কম ভাষায় আছে।
আমি নিজে চেষ্টা করে চলি, বাচ্চাদের বাংলা গল্প-উপন্যাস-নাটক পড়ে শোনাতে। সপ্তাহে একটা ক্লাস অফ করেও ওদের দিয়ে কবিতা পড়াতে, নাটক করাতে। বাবা-মায়েরা খুব পছন্দ করেন না। 'সময় নষ্ট' হয় এতে। অথচ, 'বাংলাটা ঠিক আসেনা' আবৃত্তি করিয়ে বাচ্চাদের দিয়ে হাততালি কুড়োতে ভালবাসেন।
তাঁরাই-বা কী করবেন? চাকরি পেতে গেলে হিন্দি-ইংরেজীতে সড়গড় হতেই হবে। তাই বাংলার পেছনে সময় নষ্ট করে কী লাভ?
এই খাস কোলকাতাতেই শপিংমল কিম্বা বড় রেস্তোরাঁয় বাঙালী বিক্রেতা বাঙালী ক্রেতার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেন(কেন কে জানে!)। ওঁদের নিশ্চয়ই চাকরির প্রথম শর্ত থাকে, হিন্দি-ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলতে পারা।
এবার বলবেন, বাঙালীর টাকাপয়সা নেই, তারা ব্যবসাজীবি নয়, চাকুরীজীবি। তাই বাংলার কথা কেউ শোনে না।
কিন্তু, সে তো ভাই, কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু, পৃষ্ঠপোষক তো ছিলেন। বাবা-মায়েরা বাংলা গল্পের বই পড়াটাকে অন্ততঃ 'সময় নষ্ট' মনে করতেন না। নিয়মিত সাময়িক পত্রিকা আসত ঘরে। নিজেরাও পড়তেন। এখনকার বচ্চারা সাময়িক পত্রিকার নামই শোনে নি।
ওদের কাছে 'টুম্পা সোনা'ই আদর্শ হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কী?
'টুম্পা সোনা'র প্যারডি দিয়ে ব্রিগেড ভরানোর চেষ্টা দেখে অনেকে নাক সিঁটকোচ্ছেন। সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুতার জায়গায় 'টুম্পা সোনা'!!
সেখানেও কিন্তু গোড়াতেই গোলমাল। সে সময়ে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের বিভাজন ছিল মারাত্মক। কমিউনিস্ট ভাবনাচিন্তা করা লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ট্রটস্কি, গোর্কি আওড়াতেন, যা আমজনতার কাছে 'শিশি-বোতলের' মতই শক্ত মনে হত। এরপর হু হু করে চলে এল ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল। কষ্টেসৃষ্টে ভর্তি করে দিলে চাকরি পাবে ভবিষ্যতে। ফলে, পরবর্তী সময় হয়ে উঠেছে সেই 'অর্ধশিক্ষিতের প্রতিশোধের' সময়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, অন্য রাজ্য থেকে অন্য কোনো সংস্কৃতি হয়তো উড়ে এসে জুড়ে বসতেই পারে। কিন্তু, আমাদের সংস্কৃতি দিয়ে তাদের প্রভাবিত না করে, তাদের সংস্কৃতির দ্বারাই নিজেরা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছি, এটাই ভাবনার।
বিদেশে থাকি । ইংরেজি অনেক শুনি। কলকাতার শপার স্টপে গিয়েও শুনলাম। বাংলায় প্রশ্ন করলে ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে একটা বিচিত্র ভাষায় জবাব পেলাম। আবার বাংলায় বলেছি আমি তো বাংলায় কথা বলছি ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছেন কেন? আমতা আমতা জবাব হল, সার এখানে বাংলা তেমন চলে না । ধরণি দ্বিধা হও ।
"বাংলা সাহিত্যের মত ধনী সাহিত্য খুব কম ভাষায় আছে।" - এই আপ্তবাক্যটা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত একটা প্রশ্ন ঃ খুব কম ভাষা মানে আর কী কী ভাষা যেগুলো বাংলার মত ধনী?
স্বিতীয় অংশটা বেশী সমস্যাজনক। খুব কম সাহিত্যে আছে এই কথাটার ভিত্তি কী? ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যকীর্তি বাংলায় অনুবাদ হিসেবে বেশ কম পাওয়া যায়। কাগজে পত্রে ফেসবুকের বইয়ের গ্রুপগুলোতে আলোচনা আরো কম প্রায় নেই বললেই চলে। স্প্যানিশ আর ইংরিজি থেকে প্রচুর অনুবাদ হয়, হয়েও চলেছে। একসময় রাশিয়ান থেকেও হত। কিন্তু মারাঠী , কন্নড়, ওড়িয়া, মালয়ালম ইত্যাদি থেকে খুবই সামান্য। তো সেখানে সাহিত্যের বিচারে ধনী গরীব কী ভাবে বলছেন সেটা জানতে ইচ্ছুক।
এছাড়াও ২১শে ফেব মাতৃভাষা দিবস, এতে সকলের মাতৃভাষাকেই সম্মান করার কথা বলা হয়েছে। সব ভাষাকে সম্মান না করতে পারলে তো 'মাতৃভাষা দিবস' এর কোনও তাৎপর্য্যই থাকে না। আমার ধর্ম ভাল ওর ধর্ম খারাপ এ যেমন গোঁড়ামি সেই একইরকম গোঁড়ামি আমার ভাষা ভাল ওর ভাষা খারাপ। এই গোঁড়ামি থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপরে উর্দু চাপাতে চেয়েছিল, তারই প্রতিবাদে রক্ত ঝরানো।
কোনও ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ভাষাটার বিরুদ্ধেই বলার বোধহয় খুব একটা দরকার হয় না।
সহমত