ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে এখনও। সকাল বিকেল অফিসের অনলাইন মিটিং করছি। অফিস মানে মিটিং তো ছিলই, ইদানিং মিটিং মানেই অনলাইন হয়েছে।
মিটিং-এর আলোচ্য বিষয়বস্তু অবশ্য কোনোদিনই আমার মাথায় ঢোকে না। অফিসে বসে মিটিং করলে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর অনলাইনে ইয়ার প্লাগ বেয়ে এ কানে ঢুকে ও কান দিয়ে বেরিয়ে সার্কিট কমপ্লিট করে। একটু কান কটকট করলেও মাথাটা বেশ হালকা থাকে সারাদিন। ব্যান্ডউইড্থ না কি একটা কারণে ক্যামেরা বন্ধ থাকায় মিটিংগুলো খুব আরামের হয়।
সে যাইহোক, কয়েকদিন আগে নতুন করে লকডাউন ঘোষণা হল এখানে। পরদিনের মিটিং-এ অফিসের এক গুরুজন সঠিক পরিকল্পনা, সময় আর সম্পদের সদ্ব্যবহার, খরচ কমানো, দক্ষতা বৃদ্ধি, 'ওয়ার ফুটিং'-এ কাজ করা নিয়ে গভীর জ্ঞানদান করলেন। মাইরি বলছি, এই কথাগুলো কিন্তু কোনও অজানা কারণে আমার ঘিলুতে ঠিকঠাক সেঁধিয়ে শিকড় গেড়ে বসে থাকে। অতঃপর তৎপর হয়ে চেষ্টা করি প্রাপ্ত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে।
যেমন কাল সকালের মিটিং-এ ছুরিটুরি নিয়েই বসেছিলাম। খুনোখুনি নয়, আনাজ কাটার জন্য। আমি 'লিঙ্গান্তরিত প্রেষিতভর্তৃকা’, ‘সংসারবিমুখ’, একদিন রান্না করলে তিনদিন চলে। তিনদিনের কাজ একদিনে হওয়ায় দক্ষতা যেমন বাড়ে, খরচও কমে। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে মিটিংয়ের মধ্যেই ডুমো ডুমো আলু কেটে ফেললাম, ফুলকপিও। টমেটো নিয়ে বসতে ভুলে গিয়েছিলাম, টুক করে উঠে গিয়ে আনলাম ফ্রিজ থেকে। পেঁয়াজ কাটলাম, লঙ্কা কুচোনো হয়ে গেল। মিটিং তখন শেষের মাথায়, টমেটোটা কাটব বলে হাতে নিলাম। বাম হাতে থালার ওপর টমেটোটা সোজা করে ধরে সবে ছুরিটা বাগিয়ে ধরেছি ডান হাতে, সবাই ‘বাই’ ‘সি ইউ’ ‘গুড ডে’ করতে শুরু করল। কিছু বলব কি না ভাবতে গিয়ে এক পলকের জন্য মনটা দুলে গেল। ফ্রিজ থেকে একটু আগে বার করা ঘেমো টমেটোটা তিড়িং করে লাফ মেরে হাত ছাড়িয়ে গড়িয়ে গেল মেঝেতে। আর ছুরিটা গিয়ে বসল আমার বামহাতের মধ্যমার ডগায়। দুর্ঘটনা এভাবেই ঘটে। ঘটলও, রক্তারক্তি কান্ড একেবারে।
আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চেপে ধরলাম। লোকে বলে, এতে নাকি রক্ত পড়া বন্ধ হয়, থুতু নাকি ভালো এন্টিসেপটিক। কিন্তু কেউ বলেনা, কাজটা লংকা কাটার পর করা উচিত নয়। সেটা আমি বুঝলাম ঠোঁটে মুখে জ্বালা ধরায়। যাইহোক তখনকার মতো সামলে নিলাম। বামহাতে কাপড়ের ফালি জড়িয়ে রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া করলাম।
অফিসের গুরুজনেরা বলেন সমস্যা হওয়ার আগে তার সম্ভাবনার অনুমান করা জরুরি। সেটা করতে গিয়ে বিকেল নাগাদ মনে চিন্তার মেঘ জমা হতে শুরু করল। বাম হাত অকেজো। পরের দিন কি হবে! ভাড়াবাড়ির শুদ্ধ ভারতীয় পরিমণ্ডলে ‘প্রিভি’তে কাগজ ‘আনপ্রিভিলেজড’। ওসব ব্যবস্থা নেই। অভ্যেসেরও তো একটা ব্যাপার থাকে। কার্যসূত্রে দেশ বিদেশের দুচারটে বড় হোটেলে থেকেছি। সেখানেও হয় টেলিফোন শাওয়ার পেয়েছি নয় তো মগ, ম্যানেজ হয়ে গেছে। একজায়গাতেই শুধু ওসব কিছু ছিল না। কিন্তু ঘরের টেবিলে বেশ বড়সড় একটা ইলেকট্রিক কেটলি ছিল। একদম মগের মতোই দেখতে, অসুবিধে হয়নি। উল্টে সেই দূর বিদেশেও গাড়ু নিয়ে মাঠে যাওয়ার নস্টালজিয়া উপভোগ করেছি। যাকগে সে অন্য গল্প।
এদিকে ঘরে তো খবরের কাগজ নেই, থাকেও না। কাগজে পড়বই বা কি! স্থান কাল পাত্র বদলে ঘুরেফিরে সেই একই খবর। এখন আবার শুধুই কোভিড নিয়ে কচকচানি। বরাবর অফিসেই টুকটাক চোখ বুলিয়ে নিতাম। সময়ের সদ্ব্যবহার হয়, পয়সাও বাঁচে। বাড়িতে অবশ্য দু চার টুকরো আছে, পেতে খাওয়া বা আনাজ কাটার জন্য। তাতে কিছু লাভ নেই, কাজ হবে না।
গুরুজনেরা বলেন, দুনিয়াতে সমাধানহীন সমস্যা হয় না। নানান সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে ভাবনাচিন্তা করলে সবই সম্ভব।
সুতরাং নেট সাগরে ঝাঁপ দিলাম জিওনকাঠি খুঁজতে। দেখলাম সাদা-রঙিন-সাদামাটা-নকশাকাটা সবরকমের কাগজই আছে। যুগ যুগ জিও। কিন্তু জিও বললেই তো জীবন সুন্দর হয় না। জিনিসটা আমার হাতে আসতে দিন পাঁচেক লাগবে বলে বাতিল করলাম। হাত দিলাম বড় বাক্সে। এখানে সাতদিন পরে পেতে পারি। অভিযান চালালাম আমাজনের জঙ্গলে। কিন্তু অমন গহীন জঙ্গল থেকে জিনিসটা আমার হাতে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় পনেরো দিন। দরকার তো পরদিন সকালেই, তাই এও বাতিল করতে হল।
বাসার আশেপাশে দুখানা বড় দোকান আছে। কিন্তু লকডাউন চলছে। তাই সে সব দোকানে ঢুকতে গেলে আগে থেকে কুপন নিয়ে সময়মতো পৌঁছতে হয়। ছোটখাটো যে দোকানগুলোয় কাগজাদি পাওয়া যেতে পারে, সেগুলো ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। লকডাউনের বাজারে দুপুরবেলাতেই সব বন্ধ হয়ে যায়। ওষুধ দোকান দু'একটা খোলা থাকতে পারে। কিন্তু এজিনিস কি ওখানে পাওয়া যায়! তাছাড়া এই সন্ধের মুখে বেরোলে পুলিশ ধরতে পারে। প্রেসক্রিপসন থাকলে নাহয় বেঁচে যেতাম। কিন্তু এ জিনিস প্রেসক্রিপসনে লিখে দেওয়ার মতো ডাক্তার কোথায় পাই এখন। ডাক্তার পেলে গোটা দুয়েক প্রেসক্রিপশান জোগাড় করতে পারলে আর দোকান খোঁজার দরকার হবে না। আসলে সমস্যা যখন আসে একসঙ্গে জোট বেঁধে আসে।
বিকেলের মিটিং শেষ হওয়ার পর আমার 'ওয়ার ফুটিং' শুরু হল। শোবার ঘরের এমাথা থেকে বসার ঘরের ওমাথা পর্যন্ত বিশ বাইশ পা হয়, শ'তিনেক পাক মেরে নিলাম। ঘামটাম দিল অনেকখানি। পাক কে পা দিয়ে গুণভাগ করতে করতে আসল চিন্তা থেকে কিছুক্ষণের রেহাই পাওয়া গেল।
তবে দুঃশ্চিন্তা ঠিকই ফিরে ফিরে আসে। সারা সন্ধ্যে হাজারো ভেবেও কূল পেলাম না। রাতে ঘুম এল না। একবার ভাবলাম, ফাইল থেকে স্কুল কলেজের মার্কশিট বা চাকরির কাগজপত্র ইত্যাদি বের করে হাতের কাছে রাখি। আবার ভাবলাম ডুপ্লিকেট কাগজপত্র তৈরী করা খুব মুশকিল। সারারাত বিভিন্ন সম্ভাব্য সমাধান আর তাদের ভালোমন্দ ভেবে এপাশ ওপাশ করে কাটালাম।
তারপর বোধহয় ভোরের দিকে ঘুম ধরে গিয়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ি দেখারও সময় নেই। ভগবানের নাম করে কাজে বসলাম।
নাহ, ম্যানেজ হয়ে গেল। অর্ধেক রিসোর্স নিয়ে পুরো কাজ করার শিক্ষা কাজে লাগল। আপাতত নিশ্চিন্ত। আত্মবিশ্বাসও ফিরে পেয়েছি, সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব। সত্যিই তো চেষ্টায় কি না হয়! শুধু ইচ্ছেটা থাকা চাই। অফিসের গুরুজনদের মুখে বারবার শোনা কথাগুলো আজ হৃদয়ঙ্গম করলাম।
তাড়াতাড়ি একটু ময়দা মাখিয়ে পরোটা ভেজে ফেললাম। ক্ষত সারাতে পুষ্টি দরকার শরীরের। খিদেও পেয়েছে জবরদস্ত, পেট চুঁই চুঁই করছে। ভয় পেয়ে কাল রাতে খাইনি বললেই চলে। সমস্যা সমাধানের আনন্দে খিদে যেন চতুর্গুণ বেড়ে গেছে।
আপাতত দেখছি পরোটার বাদামি রংটা বেশ খোলতাই হয়েছে। কাঁচালংকা জিরে ফোড়ন দিয়ে আলুর চচ্চড়ির অপূর্ব গন্ধটাও পাচ্ছি। আমি জানি স্বাদও ভালো হবে। নিজহাতে সমস্যার সমাধান করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে সবই ভালো হয়। অথবা সকাল থেকে পুরোপুরি 'ডানপন্থী' হয়ে যাওয়ার জন্যও হতে পারে।
নিজের রান্না নিজেই ভালো বললেন।
ভালো লেখা।