এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  •  ক্রনিক অসুখ 

    Subhamoy Misra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ অক্টোবর ২০২০ | ১৭৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৫ জন)
  • তখন সদ্য চাকরি করতে শুরু করেছি। পার্কস্ট্রিটে অফিস।

    অফিসের কাজে একবার বিলাসপুর যেতে হল। প্ল্যান ছকে নিলাম। সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় ট্রেন। অফিস থেকে বেরিয়ে কোনো একটা রেষ্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি প্যাক করে নেব। তারপর ট্যাক্সি ধরে সোজা হাওড়া স্টেশন। ট্রেন ছাড়লে আরামসে খেয়ে দেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম দেব। তখনও সংসারী হই নি, ভাড়ার বাসায় নিজেই ভাত ফুটিয়ে খেতাম। বিছানার চাদর মাসে একবার কাচা হত কিনা সন্দেহ। তাই অফিসের কাজে এদিক ওদিক যাওয়া মানে আমার কাছে রাজার হালে থাকা। সুতরাং রাজকীয় প্ল্যান এ কোনো ফাঁক রাখিনি।

    কিন্তু ওপরওয়ালা জল ঢেলে দিলেন আমার নিখুঁত প্ল্যানে, আক্ষরিক অর্থেই। বিকেল হতেই শুরু হল ঝড়বৃষ্টি। ছ’টা নাগাদ বৃষ্টি একটু কমলে আমি ব্যাগ কাঁধে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি জলে থৈথৈ করছে চারদিক। গাড়ি-ট্যাক্সি-মানুষ-প্যাঁপোঁ হর্ন-ধাক্কাধাক্কি-গালাগালি সব মিলিয়ে পার্কস্ট্রিট পুরো খিঁচুড়ি পাকিয়ে গেছে। দু' মিনিটেই বুঝে গেলাম হাওড়া গমনেচ্ছু খালি ট্যাক্সি পাওয়ার কোনও আশা নেই। অগত্যা হাঁটা লাগালাম।

    হাঁটাও কি আর যায়! পাঁচ মিনিটের রাস্তা পনেরো মিনিটে হেঁটে মোড়ের মাথায় পৌঁছে দেখলাম চৌরঙ্গী রোডের অবস্থা আরও খারাপ। এখানের খিঁচুড়িতে বাস-মিনিবাসও আছে। শুধু খালি ট্যাক্সি নেই। সন্ধ্যের মুখে হাওড়ার বাসে এমনিতেই ওঠা দুঃসাধ্য, তার ওপর বৃষ্টির কারণে ভিড় কয়েকগুন বেশি। বাসে ওঠার চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ দেখে কন্ডাক্টর তেড়ে মারতে এল।

    এর মধ্যেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল আবার। ভিজতে বাধ্য হলাম কিছুক্ষণ। শেষে বাবুঘাটের একটু ফাঁকা একটা বাসে উঠে লঞ্চ ধরে হাওড়া পৌঁছলাম। ততক্ষণে ভিজে জামাকাপড় শুকোতে শুরু করেছে। ব্যাগটাও বিচ্ছিরি ভাবে ভিজে গেছে। ভেতরের জামাকাপড় শুকনো থাকার আশা নেই। অবশ্য শুকনো থাকলেও পাল্টানোর জায়গা ছিল না।

    হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে আরেক দফা দুর্ভোগ। জল জমেছে রেললাইনে। আমার ট্রেন দশটা নাগাদ ছাড়বে। ঝড়বৃষ্টির দিনে “ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত” হলে হাওড়া স্টেশনের কি অবস্থা হয়, সে সবার জানা। খিদে, তেষ্টা, কোমর টনটন, হাঁটু কনকন সব অনুভূতি হারিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদা, থৈথৈ জল আর ভিড়ে ভিড়াক্কার স্টেশনে ঘন্টা তিনেক ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

    সব ফিরে এল ট্রেনে ওঠার পর। সঙ্গে নিয়ে এল নাক বন্ধ, চোখ জ্বালা, মাথা টিপটিপ। অসময়ের বৃষ্টিতে চুপচুপে ভেজা জামাকাপড় গায়ে শুকোনোর ফল। কিছু কেক বিস্কুট আর জলের বোতল কিনেছিলাম। তাই দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। কোথায় বিরিয়ানি আর কোথায় শুকনো কেক বিস্কুট!

    কিস্যু করার ছিল না। পেছনে ঠেস দিয়ে, হাঁটুর ওপর কনুই রেখে, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দু আঙুলে কপালের দুপাশ টিপে ধরে বসে রইলাম যতক্ষণ পারি। মাঝেমাঝে রুমাল বের করে নাকচোখ মুছলাম। একসময় বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। ঘুম কি আর আসে? মাথা ধরাটা বেড়েছে। এসির হাওয়াটা অস্বস্তিকর লাগছে। এপাশ ফিরে শুলে ওপাশের নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ওপাশ ফিরলে এপাশের। এরকম কতক্ষন কেটেছে জানিনা, একসময় ঘুম ধরে গেল। কোথায় রাজার হালে ঘুম আর কোথায় এই ছেঁদো সর্দির অস্বস্তি!

    সকালে ঘুম ভাঙল। বাইরে প্রচুর গাছগাছালি আর ঝকঝকে রোদ্দুর দেখা যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে আসার পর বেশ ঝরঝরে লাগছে। কামরার মোটা কাঁচের মধ্যে দিয়ে অল্প হলেও রোদ আসছে ভেতরে। আরাম করে জানালায় ঠেস দিয়ে বসলাম। একটু চা হলে ভাল হত।

    উল্টোদিকের সিটে বসা প্রৌঢ়া হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন।

    - কোথায় যাবেন আপনি?

    - বিলাসপুর

    - ওখানেই থাকেন?

    - না, চাকরির কাজে যাচ্ছি।

    একটু চুপ থেকে ভদ্রমহিলা কথা বলতে শুরু করলেন, এবার আপনি নয় তুমি দিয়ে।

    - বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে মন খারাপ লাগছে?

    বক্তব্যটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, তাই হাসলাম।

    - বাড়ি-ঘর বাবা-মা ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কি করবে বল ‘বেটা’, চাকরিবাকরি কাজকর্ম তো করতেই হবে। শুরুতে ওরকম একটু হয়। ধীরে ধীরে সব সয়ে যাবে।

    আমি অবাক হয়ে শুনলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

    - কালকেই দেখেছি, ট্রেনে ওঠার পর মুখে হাত চাপা দিয়ে তুমি কাঁদছিলে। তোমার মুখচোখ লাল হয়ে ছিল, চোখ ছলছল করছিল। তুমি ‘বেটা’ নিজের কষ্ট চেপে রাখতে পারছিলে না।

    এবার বুঝেছি, কি দেখে কি ভেবেছেন। বৃষ্টিতে ভেজার কথা, ‘জুখাম’ এর কথা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। উনি বিশ্বাসই করলেন না। বোধহয় ভাবলেন স্মার্ট সাজার চেষ্টা করছি। তাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে একতরফা বলেই চললেন।

    - রাতেও তুমি ঠিকমতো ঘুমাও নি। এপাশ ওপাশ করছিলে। কম্বলের ভেতর থেকে তোমার কান্নার শব্দ আসছিল। মন শক্ত কর ‘বেটা’। কত দায়িত্ব বল তো তোমার।

    তারপর নিজের ব্যাগ খুলে খাবার বার করলেন। একটা কাগজের প্লেটে সাজিয়ে আমাকে বাড়িয়ে দিলেন। কোনও আপত্তি শুনলেন না। কাল রাত্রে কেক বিস্কুট খেয়ে কাটানোটা ওনার নজর এড়ায় নি। সে কথা উল্লেখ করে ভালো করে খাওয়া দাওয়া আর শরীরের যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি চুপ করে কথা শুনতে শুনতে খেতে শুরু করলাম। চা খাওয়াও হল। যদিও শুরু একটা ভুল ধারণা থেকে, তবু গল্প চালিয়ে যেতে খারাপ লাগছিল না।

    গল্পে গল্পে বিলাসপুর এসে গেল। আমি ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ালাম। ভবিষ্যতের দায়দায়িত্বের কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা পইপই করে মন খারাপ করতে বারণ করলেন।

    মাত্র বারো তেরো ঘন্টার সফরসঙ্গী, আলাপ ঘন্টা তিনেকের। তাও ভদ্রমহিলা কত আপন করে নিলেন আমায়। প্লাটফর্ম দিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চোখটা করকর করে উঠল। লোকে বলে, বিলাসপুরের বাতাসে কয়লার গুঁড়ো ওড়ে। তাই হবে নিশ্চই। প্যাটফর্মের কল থেকে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে হাঁটা দিলাম।

    *******

    বাইশ বছর পরের কথা। ২০২০ সাল, মে মাস।

    দুনিয়া জুড়ে থাবা বসিয়েছে এক মারণ ভাইরাস। চারদিকে আতঙ্ক। সমস্ত মিডিয়ায় বারবার সাবধান করছে মানুষকে। হাজারটা বিধি নিষেধ মেনে চলতে হচ্ছে। কান পাতলেই করোনা নিয়ে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। এখন চাকরিসূত্রে কলকাতার বাইরেই থাকি। লকডাউনের ঠিক আগে দুদিনের ছুটিতে বাড়ি এসে দুমাস আটকে পড়েছি। ওদিকে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। অফিস থেকে বারংবার তলব আসছে। ট্রেন প্লেন সব বন্ধ ছিল, এই সবে চালু হয়েছে। এবার যেতেই হয়। তিনদিন চেষ্টার পর ট্রেনের টিকিট পেলাম। ভিড় এড়ানোর জন্য এসি ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট নিলাম। যাওয়ার আগের দিন কলকাতায় ভয়ঙ্কর সাইক্লোন আছড়ে পড়ল। লন্ডভণ্ড করে দিল চারদিক। টিভিতে সে ছবি দেখে শিউরে উঠলাম।

    যাওয়ার দিন ঘন্টা চারেক ট্রেন লেট। সে অবশ্য আগে থেকেই জানা ছিল। এবারে হাওড়া স্টেশন একদন ফাঁকা। ইতিউতি দুচারটে লাইট জ্বলছে। কুলি নেই, হকার নেই, ভিড়ভাট্টা নেই, চেঁচামেচি হাঁকডাক কিছুই নেই। যেন ভূতের সিনেমায় দেখা পরিত্যক্ত স্টেশন।

    একটা শিরশিরে অনুভূতি আর চাপা আতঙ্ক নিয়ে সোজা নিজের সিটে গিয়ে বসলাম। কামরার মধ্যে জীবাণুনাশকের একটা উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে আছে। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করলাম। মাস্কের জন্য চশমার কাঁচটা বারবার ঝাপসা হয়ে যায়, মুছলাম। উল্টোদিকের সিটে এক বছর পঁচিশের ছোকরা বসে আছে। সহযাত্রীকে মাপার চেষ্টা করলাম। ছোকরার চেহারা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। পরিযায়ী শ্রমিক না হলেও সাদা কলারের চাকরিবাকরি করে বলে মনে হল না। থ্রি টিয়ারে মানিয়ে যায়, ফার্স্ট ক্লাসে নয়। মুখটা থমথম করছে, চোখদুটো লাল। ব্যাটা ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে না তো! কোত্থেকে জোটে সব! মনে মনে দুটো সিটের দূরত্ব মেপে নিলাম। তিনফুট কোনোমতেই হবে না। দুটো বার্থ তখনো খালি, একটু নিশ্চিন্ত। ওর মতো আরও দুজন এসে পড়লে করোনা থেকে আমার বাঁচার রাস্তা থাকবে না। প্রচন্ড অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে বসে রইলাম।

    ট্রেন ছাড়ল। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বার করে খেয়ে নিলাম। রাতের খাবার, সকালের জলখাবার সব আলাদা আলাদা প্যাকেটে ভরে এনেছি। একবার বার করলে যেন আর ব্যাগে ঢোকাতে না হয়। খাওয়ার পর জঞ্জাল ফেলে, বাথরুম সেরে, ভালো করে হাত ধুয়ে স্যানিটাইজার ঘষতে ঘষতে ক্যুপে ফিরে দেখি ছোকরা রুমাল বের করে নাক মুছছে। হয়ে গেল, নির্ঘাত ব্যাটা মাইল্ড সিম্পটোম্যাটিক। চারদিকে এত প্রচার চলছে, তবুও ব্যাটা বাইরে বেরিয়েছে। স্টেশনের গেটে বসা মেডিক্যাল টিমকে নিশ্চই কাঁদুনি গেয়ে ম্যানেজ করেছে। অথবা গান্ধীছাপ কাগজ দিয়ে। এসব এদেশেই সম্ভব। কিস্যু হবে না দেশটার। সিটটা পাল্টাতে পারলে ভালো হত। বাইরে কোনো টিটিই বা পুলিশের দেখা পাইনি। পেলে ব্যাটাকে ঘাড় ধরে ট্রেন থেকে নামাতাম। অন্তত একটা অভিযোগ জানিয়ে রাখতাম।

    বেডরোল দেওয়া বন্ধ। সিটের ব্যাকরেস্ট নামিয়ে স্প্রে করে দিলাম। তারপর ব্যাগ থেকে চাদর বার করে মাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম পাশ ফিরে।

    শান্তিতে একটু ঘুমানোর কি যো আছে! ছোকরা ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস টানছে। নাক বন্ধ হয়ে আছে। একবার খুক করে একটু কাশল। শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল চাপার। আমার কপালেই এরকম সহযাত্রী জুটল! ব্যাটা বাথরুমে যাবে; দরজার হাতল, ট্যাপ, ফ্ল্যাশ সবে হাত লাগাবে। একটা স্যানিটাইজারের বোতল হাতে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু কি কোম্পানির কে জানে। আজকাল রাস্তার ধারেও সস্তার স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে। সেরকমই কিছু হবে। ওসবে কাজের কাজ কিস্যু হয় না। হাতে আরেকপ্রস্থ অনলাইনে কেনা স্যানিটাইজার লাগিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

    কিছুক্ষণ পরে চাদরটা একটু ফাঁক করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলাম। ফোল্ডিং টেবিলের ওপর একটা আধ খাওয়া কেক রাখা আছে। ছোকরা ফোনে খুটখুট করছে আর কেক চিবোচ্ছে। সেই বাইরের খাবার খাচ্ছে। ওই কেকের প্যাকেটে কোভিড কিলবিল করছে সে হুঁশ নেই। কবে বুঝবে এরা! কবে একটু সচেতন হবে! বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুলাম আবার।

    আবার কিছুক্ষণ পরে চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম। ছোকরা এখনো ঘুমায় নি। ফোনটা চার্জে লাগিয়েছে। মরণ, সকালে আমার ফোনটা চার্জে বসানোর সময় মনে রাখতে হবে ডান দিকের প্লাগটায় লাগানোর কথা। ও বামদিকেরটায় লাগিয়েছে। নাহয় একবার স্প্রে করে নেব সুইচে। আশঙ্কা আর বিরক্তির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল।

    সকালে উঠে অতি সাবধানে বাথরুম থেকে ঘুরে এলাম। এসে হাতে স্যানিটাইজার ঘষতে ঘষতে দেখি ব্যাটা কাকে ফোন করছে, বাড়িতে হবে হয়তো।

    “না না ঠিক আছি।”

    ডাহা মিথ্যে কথা। যদিও এখন আর নাক টানছে না, কিন্তু ‘এসিম্পটোম্যাটিক’ কথাটা কি এমনি এসেছে বাজারে!

    “বলছি তো ঠিক আছি।”

    তুই খারাপ থাকলেও এমনিতে কিস্যু যায় আসে না আমার। কিন্তু রোগটা ছোঁয়াচে, তাই আমার যায় আসছে এখন।

    “জল কমেছে?”

    কাল থেকে কত ভাইরাস ছড়ালিরে ছোকরা, সে হিসেব আছে? হাতের স্মার্ট ফোনটায় সাইক্লোন পরবর্তী কলকাতার সব খবর আছে। বকবক না করে দেখ না খুলে। যত কথা বলবি তত ভাইরাস ছড়াবে সে জ্ঞানটুকু নেই!

    এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। ফালতু কথা সব। কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে জানালার ভাঙা কাঁচ পাল্টানোর জন্য মিস্ত্রি ডাকতে। আরে এই অবস্থায় কেউ মিস্ত্রি ঘরে ঢোকায়! মরবে সব মরবে! এদের জন্যই শ্মশান হয়ে যাবে দেশটা!

    কাকে যেন কয়েকদিন মেঝেতে বসতে শুতে মানা করল। ড্যাম্প কমলে তারপর নাকি ভাবা যাবে। ঠিক ধরেছি, তেমন ভালো ঘরের ছেলে নয়। বুড়ো বাপমাকে হয়তো মেঝেতে শুয়ে রাখে।

    কাউকে প্রবোধ দিল, অফিসে জয়েন করেই আবার ছুটি নিয়ে চলে আসবে। তখন নাকি ঘরের কাজকর্ম করাবে।

    একটি টিপিক্যাল ‘হোমসিক’ বাঙালি। তার চেয়েও বড় কথা হিল্লি দিল্লি যেখানেই তোর অফিস হোক, সেখান থেকে আবার ভাইরাস বয়ে আনবি ‘বেঙ্গলে’। তারপর তোর ঘরে কাজ করা মিস্ত্রি মজুর হয়ে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাস। সবুজ থেকে কমলা, তারপর লাল করে ছাড়বি এলাকাটাকে। এতদূর ভেবেই আমার মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠল। সেকেন্ড ওয়েভ এভাবেই আসবে।

    হটাৎ মনে হল, ফোনের ওপারে সত্যিই কেউ আছে তো! ভগবান জানে। হয়তো ওর সর্দিকাশিটা করোনা নয় বোঝাতে এসব গল্প শোনাচ্ছে। যাকগে বাবা, নিজে বাঁচলে বাবার নাম। উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। হাতে সময় আছে।

    যত চালাকি দেখাও বাপু, করোনা কাউকে ছাড়বে না। সারা দুনিয়ার স্ট্যাটিস্টিক্স আমার মুখস্ত। এ দুমাস ঘরে বসে খুব স্টাডি করেছি ইন্টারনেটে। টিভি তো আছেই। হুঁ হুঁ বাবা, ইউরোপ আমেরিকা পর্যন্ত বোমকে গেছে, আর তুমি স্মার্ট সাজতে চেষ্টা করছ! দিল্লিতে নেমে ‘হেলথ স্ক্রিনিং’ পেরোবে কি করে তাই ভাব বাবা। ওখানে ফাঁকি দিতে পারবে না। ধরে সোজা হাসপাতালে পাঠাবে। তাই হওয়াই উচিত। জোর না খাটালে এদের শিক্ষা হবে না।

    আমাকে সেই দু যুগ আগের গায়ে পড়া বুড়ি পাওনি যে ছলছলে চোখ দেখে গপ্পো জুড়ে দেব। সে যুগের ওই গায়ে পড়া মানসিকতা আজকের যুগে অচল। দু কুড়ি সাত হল, অভিজ্ঞতা তো কম নয়। কিসে কি হয়, কত ধানে কত চাল সব আমার নখদর্পনে। করোনা তো এই সেদিন এসেছে। তার আগে কত ভাইরাস বাসা বেঁধেছে মনে, এই দু যুগে। ক্রনিক মানবিক অসুখের ভাইরাস সে সব, করোনার মত সাবান জলে হাত ধুলে বা হাজার স্যানিটাইজার মাখলেও মরবে না।

    ************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৯ অক্টোবর ২০২০ ২৩:১৭98640
  • দ্বিতীয় পর্বটিই মোক্ষম। মনেরও স্যানিটাইজার চাই। 


    আরও লিখুন 

  • Jaydip Jana | ২০ অক্টোবর ২০২০ ১০:০১98658
  • আমরা বদলে গেছি, নাকি বদলাতে বাধ্য হয়েছি, তা ভগাই জানে, এটাই জীবন

  • ঝর্না বিশ্বাস | ৩০ নভেম্বর ২০২০ ২৩:৩৩100801
  • দুটি সহযাত্রীর বদলটা  খুব চোখে পড়ল। দ্বিতীয়তে এত সতর্কতা অবশ্যই করোনার জন্য জানি তাও 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন