এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • গন্ডোয়ানা দিদু, ভারতমাতা এবং ভূমিকম্প

    Moumita Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১৩ এপ্রিল ২০২০ | ২৭৪৩ বার পঠিত
  • গন্ডোয়ানা দিদু, ভারতমাতা এবং ভূমিকম্প
    তামিমৌ ত্রমি

    কি,
    কেঁপে গেছেন তো?
    একে করোনা, তায় আবার ভূমিকম্পের খাঁড়ার ঘা?
    না, আপনি হয়তো কাঁপেননি। কিন্তু পূর্ব দিল্লিতে থাকা আপনার পিসতুতো দাদা বৌদি বা রাঙ্গা জেঠুর মেয়ে - জামাইরা হয়তো টের পেয়েছেন জলে স্থলে বনতলে একটা ঘোরতর দোল অর্থাৎ দুলুনি। সিনহা মেশামশাইয়ের আরামকেদারা হয়তো উল্টে গেছে। রান্নাঘরে ছত্রাকার ছড়িয়ে  গেছে কাচ-কৌটোর ঘোমটা ভাঙ্গা চিনি । কিংবা হয়তো এতটা হয়নি। কারণ ৩.৫ মাত্রা রিখটার স্কেলে অত কাঁপন ধরায় না। কিন্তু সেরকম কাঁপন ধরলে তার প্রলয়নাচন যে কী হতে পারে, তা  মাঝে মধ্যেই আমাদের টের টনক উজিয়ে তোলে সভ্যতার আস্তিত্বিক সঙ্কটের প্রান্তসীমায় পিঠ ঠেকিয়ে।
    এখন এই যে দুলুনি'- এর  পোষাকি নাম ভূমিকম্প। কিন্তু সত্যিই কি এই ভূমিকম্পে ভূমি কাঁপে।আজ্ঞে না। যেটা হয়, সেটা হল, ভূমি বা মাটি সমুদ্রের মতো তরঙ্গিত হয় বা ঢেউ খেলিয়ে বেড়ায়।
    মনে করুণ সেই দিনটার কথা, যেদিন কোচিং ক্লাসের সবচেয়ে  সুন্দরী মেয়েটি আপনার হাতে অম্লানবদনে রাখী পরিয়ে দিল, সেদিন মন মাতাল সাঁঝ সকালে আপনি কী করেছিলেন? আপনার সমস্ত অনুরাগের ছোঁয়া,  অন্তরের ভালবাসা, অভিমান একটা ঢিলের মধ্যে জট পাকিয়ে পারাবত প্রিয়ারূপী পুকুরের হৃদয়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন তো?। তাতে মোচ্ছবটা কী হয়েছিল? না  ঢিলটা নিক্ষিপ্ত হওয়ামাত্রই একটা জার্ক বা ধাক্কা ' র সৃষ্টি হয়েছিল; ফলতঃ জল তৎক্ষণাৎ তরঙ্গিত হয়ে উঠেছিল। সেই জলতরঙ্গে আপনার অশ্রুর নোনতা কতখানি মিশেছিল,  সে কিসসা  আপনার একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু কথাটা হচ্ছে,  এইরকম এক একটা জার্কের ফলে আমাদের পায়ের তলার মাটিও জলের মতো কল্লোল তুলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ঐ জার্ক টাকেই আমরা 'লাগল যে দোল' বা ভূমিকম্প বলি।
    এখন কথা হল, পুকুর বা সমুদ্রের তরঙ্গ আপনি চর্মচক্ষে দেখতে পান, মাটির কল্লোল দেখতে পান না কেন? কারণ,  সমুদ্রের কল্লোল দেখতে গেলে আপনাকে সমুদ্রের তীরে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সমুদ্রের মাছেদের পক্ষে কী দেখা সম্ভব সেই তরঙ্গোচ্ছ্বাস?  তারা শুধু অনুভব করে আর আতঙ্কিত হয়।
    ঠিক তেমনই মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার পক্ষে এই ভূমিকল্লোল দেখা সম্ভব নয়। তাই আপনি দেখেন না। টের পান।

    তা, এই জার্কটা আসেই বা  কেন? আর আমাদের সিন্দুকে রাখা প্রাণগুলিকে ধ্বংসের বন্দুক দেখায়ই বা কেন?

    আসলে আমরা যেমন  আমাদের খাবার প্লেটে রাখি, তেমন একেকটা প্লেটের উপর এক একটা মহাদেশ রাখা থাকে। ইন্ডিয়ান প্লেটের উপর ইন্ডিয়া, নর্থ আমেরিকান প্লেটের উপর নর্থ আমেরিকা- এইরকম আর কি। এই প্লেটগুলো থাকে সমুদ্রের তলায়। জলহস্তির নাকের পাটার মতো শুধু মহাদেশগুলো জলের উপর জেগে থাকে।

    তবে কি জানেন, এই প্লেটগুলো খাবারের প্লেটের মতো সরল সাদাসিধে নয়। বরং একটা চকোলোভা কেকের মতো। ধরুণ, চকোলোভা কেকের উপর একটা চেরি রাখা আছে। ঐটা হল কন্টিনেন্ট বা মহাদেশ। তার নীচে যে শক্ত চকোলেটের জমি, এই কঠিন শিলাময় জমিটাকে বলে লিথোস্ফিয়ার। তার নীচে আছে লোভা।  ঘন,  খুবই ঘন তরল একটি  শিলীভূত স্তর।  লোভার তারল্যের সঙ্গে এর কোন তুলনা হয়না। অত্যন্ত ঘন মধু' সঙ্গে তা-ও চলতে পারে। লিথোস্ফিয়ার এই তরলের উপর ভেসে থাকে।
    তা, এই যে আমাদের রকোলোভা বা ঘন তরল স্তরটি - আসলে এটিই নড়ন চড়ন ঘটায়।  আমাদের মহাদেশীয় পাতগুলির ঝোটন ধরে নাড়ায়। এবার প্রশ্ন, কি করে নাড়ায়?

    আপনি একটা বদ্ধ ঘরে হিটার চালান। কী হবে? বাতাস গরম হলেই হালকা হয়ে যায় আর টং করে উপরে উঠে যায়, ( যেমন আপনার মাথা গরম হলে টং করে রক্ত মাথায় উঠে যায় আর কি,)। কিন্তু চলি চলি পথের যে নাই শ্যাষ বলার তো উপায় নেই সেই উত্তপ্ত বাতাসের। কারণ, বদ্ধ ঘর। ছাদ অব্দি উঠে গেলে সে আর উপরে না যেতে পেরে আশেপাশে ছড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে ঠান্ডা মেরে যায়। আবার ভারী হয়ে নীচে নেমে আসে।  তাপ্পর মাটিতে যেই হামাগুড়ি দিতে যায়, অমনি হিটারের সংস্পর্শে আবার তাপিত হয় এবং টং করে পুনরায় উপরে উঠিয়া যায়.. তারপর চলে পূর্ববর্ণিত প্রক্রিয়া। এই যে একটি চক্রাকার স্রোতময় প্রক্রিয়া- একে বলে 'কনভেকশান কারেন্ট' ( বাহ, রকোলোভা থাকবে, কনভেকশন মোড থাকবে না, তা কি হয়?)
    এখন কথা হল, শুধু আমাদের পেটেই নয়, পৃথিবীর পেটেও আগুন আছে। রাক্ষস রাণীর দেশের আয়ী বুড়ি মার্কা আগুন। চব্বিশ ঘন্টা আগ্নেয় জিভ তার লকলক আর সকসক।সেই আগুন হিটারের জ্বলুনিতে যে কনভেকশান কারেন্ট তৈরি হয়, তাতেই আমাদের রকোলোভা অস্থির হয়ে পড়ে এবং প্লেটগুলো এদিক ওদিক পানে ছুটতে থাকে। শুধু এই ছোটার সময়সীমা আঠেরো মিলিয়নে বছর আর কি।

    এই যেমন ধরুণ, আজ থেকে একশা পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে ইন্ডিয়া ছিল আফ্রিকা  মাদাগাস্কার সাউথ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া আন্টার্ক্টিকার সঙ্গে আঠা দিয়ে জোড়া। এদের সক্কলের মিলিজুলি নাম ছিল 'গন্ডোয়ানা'। তারপর কালে কালে গন্ডোয়ানা দিদুর নাড়ি ছিঁড়ে ভারতমাতা, অস্ট্রেলিয়া,  আফ্রিকা ও অন্যান্য মাসিগণ বেরিয়ে পড়ল যে যার নিজের ঠিকানায়।

    তার মধ্যে ইন্ডিয়ান প্লেট ক্রমশ উঁচুতে উঠতে উঠতে করল কি, ছোট্ট করে ইউরেশিয়ান প্লেটের তলায় গিয়ে পা সেঁধিয়ে দিল একদিন, তাতে কী হল? কিচ্ছু না, স্রেফ ঐ ছোট্ট জার্কের ঠেলায় বড় করে একটা হিমালয় গজিয়ে উঠল।

    সুতরাং,  নয় নয় এ মধুর খেলা, নয় নয় এ বিগলিত কেকোচিত কেকা। বাস্তবটা এই,  আমাদের পায়ের তলার মাটি একটু একটু করে সরছে। সেই সঙ্গে আমরাও। তাই পৃথিবীতে একটা বিষয় অন্তত স্থির- যে পৃথিবীতে কোনকিছুই স্থির নয়। সুতরাং, চরৈবতি।
    তবে, আবার যখন স্থলে কিংবা বনতলে দোলন জাগবে, তখন তাকে ভূমিকম্প না ভূমিকল্লোল- কি নামে ডাকবেন,  সেই ব্যাপারে গলানোর মতো নাকটি একান্তই  আপনার  ব্যক্তিগত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২১:২৬730587
  • ভারী সুন্দর সহজ ভাষায় লেখা।

  • Moumita Mitra | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫৫730588
  • ধন্যবাদ

  • o | 173.245.***.*** | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২২:৪৪730589
  • ভাল লাগল। :-)

  • Moumita Mitra | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২২:৫৬730590
  • ধন্যবাদ। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন