ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে একটি বৃহৎ উপাসনালয়, পাপ মোচন জেলখানায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; কারণ পাপ মোচন না হলে পরবর্তী পাপের প্রেরণা কোথা থেকে আসবে? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটির উপাসনালয়ে যাওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ নিদেনপক্ষে একজন সাধারণ কারা প্রহরীর অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়না। অথচ কারাগারের লাইব্রেরীতে প্রবেশের জন্য জেল সুপারসহ তিন স্তরের কারা প্রহরীর অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই কেউ এত ঝামেলা পোহাতে চায় না, বা এই অনুমতিই মেলে না। ... ...
এর দুইদিন পরে। আমি বসে আছি উপ-কমিশনারের রুমে। বড় হেফাজতিটাকে নিয়ে আসা হলো। আমাকে দেখিয়ে বলা হলো, এই লোকটা কেমন? মানে মানুষ কেমন? হেফাজতিটা বললো, সে মানুষ হিসেবে ভাল। মনটা ভাল আছে, লোক খারাপ না, কিন্তু সমস্যা হইলো নাস্তিক। নাস্তিক না হইলে তারে খুব ভাল মানুষই বলা যাইতো। ... ...
হ্যাঁ, তারা সকলেই নাস্তিক এবং ধর্ম সম্পর্কে তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নিজ নিজ চিন্তা ভাবনা, বিচার বিশ্লেষণ রয়েছে। তারা কেউ খুন করে নি, ডাকাতি করেনি, গাড়ি পোড়ায় নি, মসজিদে আগুন দেয় নি, কোরআন পোড়ায় নি। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতারের সময় একটি প্রশ্নই করেছিল, "আপনারা কী নাস্তিক?" উত্তরটা হ্যাঁ হবার সাথে সাথেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। আর এই গ্রেফতার হয়েছিল হেফাজতে ইসলামের চাপের কারণে। অর্থাৎ নাস্তিক হওয়া বাঙলাদেশে একটি অপরাধ বলেই গণ্য হচ্ছে! তাদের ভাল পুরষ্কারই দেয়া হল। ... ...
গাড়ি থেকে যখন নামানো হল, তখন আমরা সংখ্যায় পরিণত হয়েছিলাম। গরু বাছুরের মত আমাদের বারবার গোনা হচ্ছিল, এরপরে একটা অন্ধকার করিডোরে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা চারজন একজনার পিছনে আরেকজন ঢুকছি, আমাদের সামনে পিছনে চারজন কারা প্রহরী। সবার আগে রাসেল ভাই, তারপরে শুভ, তারপরে আমি, সবশেষে বিপ্লব ভাই। আমাদের ১৪ সেলে নিয়ে গেল। ১৪ সেলের দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, তাদের টিনের বাসন দিয়ে শব্দ করে কান ঝালাপালা আবস্থা। তারা সবাই একসাথে স্লোগান দিতে লাগলো; বলতে লাগলো, "নাস্তিকমুক্ত জেলখানা চাই", "নাস্তিকদের আজই ফাঁসি চাই", "জেলখানায় নাস্তিক, মানি না মানবো না" ... ...
দেখা যাচ্ছে, “পারাপার”-এর নির্যাতন এ গল্পে এসে বিস্তৃত হয়েছে আরো তৃণমূল পর্যায়ে। হয়ে উঠেছে আরো বেশি নির্মম; প্রাণঘাতী। তাই “এই সময়”-এ এসে জহিরকে লিখতে হয়েছে, পাড়ার মাস্তাদের (তিন ভাই—আবু, হাবু, শফি) হাতে নিহত মোহাম্মদ সেলিম নামের এক কিশোরের কথা। একটি অসম বয়সী কিশোর-যুবতীর প্রেমের ট্রাজেডীর আড়ালে জহির এই গল্পে যে ম্যাসেজটি দিয়েছেন তা হলো, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ষোলকলা-পূর্ণ হয়েছে। কারণ, স্বাধীনতা বিরোধী মওলানা জব্বার (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বদু মওলানার এক্সটেনসশন), এরশাদ সাহেব, মালেকা বানু আর মেজর ইলিয়াস, সবাই আজকে গাঁটছড়া বেঁধেছে। ... ...
আসলে, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেণ্টারির মতো, মুক্তিযুদ্ধকে গ্লোরিফাই করার জন্য কোনো গল্প লেখেন নি জহির। এমন কি পুরো গল্প আগাগোড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টাইমফ্রেমে বন্দী জহিরের এমন গল্পের সংখ্যা মাত্র একটি। সেটি হলো: “মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা”। এই গল্পে বান্দর হয়ে ওঠে রাজাকার-আল-বদর অথবা সে সময়ের লুটপাটকারী সুবিধাবাদীর প্রতীক। এ বাদে জহিরের অন্যান্য গল্পে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তীব্র ঝলকানির মতো। আবার কখনো কখনো তা থেকে গেছে ক্রোমা-ক্যানভাসের মতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঘটনাই জহিরের কলমে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। আর সেটার পেছনে তার ভাষা ও গল্প নির্মাণ টেকনিক বড় সাহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে “কাঁটা” গল্পের কিছু খণ্ডিত অংশ কোড করা যেতে পারে— ... ...
উপন্যাসে জহিরকে অনেক বেশি এককেন্দ্রিক ও সুসংহত মনে হয়। কারণ, এসময় তাকে পারম্পরিক সাজুয্যপূর্ণ কাহিনী নির্মাণ করতে দেখি ( এখানে ভাষা ও জাদুবাস্তবতার প্রায়গিত জৌলুসের প্রসঙ্গটি উহ্য রাখছি)। কিন্তু গল্পে? গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় এই জহিরই আবার অনেক বেশি বিক্ষিপ্ত। আর সেখানেও চলে আসে জহিরের গল্প বলার নিজস্ব টেকনিকের প্রসঙ্গটি। “পারাপার”এর পর আমরা জহিরের যেসব গল্প পাই, তাতে গল্পকেন্দ্র এতো বেশি ওঠানামা করে যে, তাকে তখন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। বলা যায় না—“গল্পটার পটভূমি হলো এইটা..” অথবা বলা যায় না—“তিনি এইটা বলতে চাইছেন”। এক্ষেত্রে জহিরের টাইম লাইন ভেঙে ফেলার প্রবণতা সাধারণ পাঠকদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেহেতু জহিরের ভাষাটি বেশ সহজ এবং (সিনটাক্স) প্রায় কথ্য ঢঙের কাছাকাছি, সর্বোপরি একটা চাপা হিউমার তাতে বিরাজমান থাকে, সেকারণে গল্পটি না শেষ করেও পাঠক স্বস্তি পায় না। পাশাপাশি গল্পে নানান মাত্রার রূপক ও ইলিউশন ব্যবহার করে জহির গল্পকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড় করান। ... ...