এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বিষয়:মুহূর্তকথা

    Sanchayita Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৫ এপ্রিল ২০১৭ | ৯৩৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • aranya | 83.197.***.*** | ২২ মে ২০১৭ ০৩:১১366068
  • অসাধারণ
  • Sanchayita Biswas | ২৪ মে ২০১৭ ১৫:১২366069
  • ১৫।

    গোরা একা থাকতে মোটেও ভালবাসে না।বাড়িতে কেউ না থাকলেই ওর রাগ হয়।এটা-সেটা-ওটা প্রায়ই নষ্ট করে।অনেক চেষ্টা করেও এ স্বভাব পরিবর্তন করা যায়নি।মা প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরে দেখে খবরের কাগজ কুটি কুটি করে ছড়িয়ে রাখা,জলের বোতল তুবড়িয়ে রাখা,সোফার কভার মেঝেতে ফেলা।মা কোমরে আঁচল জড়িয়ে বেতো পা নিয়ে গোরার পিছনে ছোটে।গোরা খাটের তলায় আশ্রয় নেয়।

    গোরার সবচেয়ে মজা হয় আমি আর মোহর বাড়ি ফিরলে।গেট দিয়ে আমায় ঢুকতে দেখেই ওর তুর্কীনাচন শুরু হয়।সারা বাড়ি,খাট বিছানা নেচে নেচে লন্ডভন্ড করে।এক লাফে আমার গায়ে উঠে যায়।চটকে চটকে আদর করলে তবে সে খুশী।মোহরের গায়ে কিন্তু কক্ষণো ওঠে না ও।এটা অলিখিত একটা নিয়ম।

    মোহরের জীবন্ত পুতুল হলো গোরা।মোহরের চারমাস বয়সে গোরা যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল,সেদিন সে ঠিক একমাস বয়সী শিশু।প্ল্যাস্টিকের বাক্স থেকে নেমেই ছোট্ট গোরা সারা বাড়িতে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল।মা সোফার উপর তুলে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো।বুঝলাম,ও একটু নিরাপদ উষ্ণতা খুঁজছিল।মোহর আমার কোল থেকে ড্যাবড্যাব করে গোরাকে দেখতো।আর গোরা দেখতো আমাকে।যেখানে বসতাম আমি,ও ঠিক আমার পায়ের মধ্যে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।মোহরকে আমার কোলে দেখলে কিরকম অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতো।কে জানে,ওর হয়তো ওর মায়ের গায়ের ওমের স্মৃতি মনে আসতো।

    গোরা সারা রাতে বেশ কয়েকবার এসে দেখে যায় আমাকে আর মোহরকে।আমরা দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে দেখি গোরা খাটের মাথার দিকে মেঝেতে শুয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।মোহর ঘুম থেকে উঠেই আগে ওইদিকে হাঁক পাড়ে,"গোয়া"।গোরা অমনি হাজির।মশারী তুলে দিতেই সোজা বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে।এখন তার আদর চাই।কান চুলকে,পেট চুলকে দিলেই সে খুশী।এর মাঝেই মোহর ওর মুখের মধ্যে হাত চালান করে দেয় কিংবা লেজ থেকে দু'খানা লোম তুলে আমার হাতে দেয়।গোরাও দু'একবার চেটে দেয় মোহরের মুখ।মোহর খিলখিল করে হাসে।

    মা চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে যায়।মোহর সেই বিস্কুট ছিনিয়ে নিয়ে গোরার মুখে গুঁজে দেয়,"খা খা"।গোরা বল নিয়ে ছুটে ছুটে খেলা করে।মোহর বড়দের মতো হাততালি দিয়ে ওকে উৎসাহ জোগায়,"বাঃ বাঃ।ছোতো।"মোহর প্যাঁকপ্যাঁক জুতো পরে হাঁটে।গোরা শব্দের রহস্য ভেদ না করতে পেরে তার পায়ে পায়ে ঘোরে এ ঘর সে ঘর।গোরার অযাচিত ঠেলায় মোহর হাঁটতে হাঁটতে পড়ে গেলে নিজেই জিভ কাটে,"এ মা!"আর গোরা ধাক্কা দেওয়ার লজ্জায় মুখ লুকোয় সোফার তলায়।

    আজকাল বিকেলবেলায় লোকজন প্রায়ই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের গেটের দিকে তাকায়।সেখানে প্রায়ই একটা এক বছর চার মাস বয়সী দুইপেয়ে লিলিপুট গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে লোক চলাচল দেখে ঝলমলে দৃষ্টিতে।পাশে বছর খানেকের চারপেয়ে এক দেবদূত দাঁড়িয়ে থাকে।গ্রীলের ফাঁক দিয়ে তার লালচে নাক বেরিয়ে থাকে।কমলালেবু রোদ জড়িয়ে থাকে দু'জনকে।আমি আর মা বারান্দায় বসে দেখি আর মুগ্ধ হই।
  • শঙ্খ | 52.***.*** | ২৯ মে ২০১৭ ১৩:১২366070
  • বাহ। মায়াটুকু ছুঁয়ে থাকে...
  • Sanchayita Biswas | ১০ জুন ২০১৭ ০০:৪২366071
  • ১৬।

    একটা সন্ধ্যেবেলায় বারান্দায় বসে মা বললো কিছুদিনের মধ্যেই একটা ভাই আসবে আমার সাথে খেলতে।আমি খুব অবাক হয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম,"ভাই কোথায় পাওয়া যায়?"মা বললো,"হসপিটালে কিনতে পাওয়া যায়।"তারপর একদিন সকালবেলায় মামাবাড়িতে ঘুম ভেঙে জানলাম সত্যিই গতরাতে একটা ভাই এসেছে হাসপাতালে মায়ের বিছানার পাশের ছোট্ট কটে!কি আশ্চর্য, ওইটুকু জীবন্ত পুতুল আমাদের সাথে ট্যাক্সিতে করে আমাদের বাসায় চলে আসলো!আসার সময় হিসু করে মায়ের কোলও ভিজিয়ে দিলো!আমার মনে আছে ভাইকে শোবার ঘরের খাটে এনে শোয়াতেই ও ইতিউতি দেখছিল।মনে হয় যে বাসায় থাকতে এসেছে সেটা পর্যবেক্ষণ করছিল।এতোটুকু নেংটি ইঁদুরের মত মানুষ!অতো বড়ো খাটে কি ছোট্ট জায়গা জুড়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে।

    আমি কখনো ভাইকে কোলে নিইনি।মা আমাকে কখনো ভরসা করে কোলে দিতো না ।আসলে আমার ধুপধাপ পড়ে যাওয়া স্বভাব ছিল।একটা দুপুরবেলায় অনেক কাকুতিমিনতির পর মা রাজী হলো ভাইকে কোলে দিতে।খাটের ওপর পা লম্বা করে বিছিয়ে বসলাম।তারপর আমার পায়ের উপর বালিশ রেখে মা সন্তর্পণে শুইয়ে দিলো ওকে।ভাইটা এমন পাজী,যেই মুহূর্তে মা শোয়ালো ওকে,সেই মুহূর্তে হিসু করে দিয়েছে আমার পায়ে।আমিও বোকার মতো পা দুটো সরিয়ে নিয়েছি ওর পিঠের তলা থেকে।অগত্যা মায়ের কিল এসে পড়লো পিঠে আর ভাইকে কোলে নেওয়ার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে গেল।আমি হ্যাংলার মতো দেখতাম সবাই ভাইকে কোলে নিচ্ছে।পাশের বাড়ির বাচ্চুদা তো ভাইকে কোলে নিয়েই আমায় ভয় দেখাতো,"তোর ভাইকে নিয়ে চলে যাবো।"আমিও চেঁচিয়ে কান্না শুরু করতাম।

    আমাকে কোলে বসিয়ে পড়া দেখিয়ে দিতো শম্পামাসি।ওদের বাড়িতে খুব ঘটা করে ভাইফোঁটা হতো।মাসি তার দুই ভাইকে পাশাপাশি আসনে বসিয়ে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ধান দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করে প্রদীপের তাপ ছোঁয়াতো।জলমিষ্টি খাইয়ে দিতো।দুই মামাই মাসিকে উপহার দিতো।আমি দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখতাম পুরো অনুষ্ঠানটা আর মাকে বিরক্ত করে মারতাম,"আমি কবে ভাইফোঁটা দেবো?"

    অবশেষে একটা ভাইফোঁটার দিনে মা শোবার ঘরের ফাঁটা লাল মেঝেতে মুখোমুখি বিছিয়ে দিলো দুটো আসন…চন্দন বেটে, দুব্বো তুলে, ধান এনে গুছিয়ে দিলো পাটা…পিতলের প্রদীপে তেল দিয়ে পলতে জ্বেলে রাখলো পাটার পাশে…পাঁচ রকম মিষ্টি আর জল সাজিয়ে দুই আসনে বসিয়ে দিলো তার দুই ছেলেমেয়েকে।একটা বছর পাঁচেকের দিদি প্রথম ফোঁটা দিলো বছর খানেকের পুঁচকে ভাইকে।বাম হাতের কড়ে আঙুলে চন্দন মাখিয়ে ছোট্ট ভাইয়ের কপালে ছুঁইয়ে মায়ের সাথে সাথে "মন্তর" পড়লো দিদি,"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যমের দুয়োরে পড়লো কাঁটা/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা"।ফোঁটাশেষে মা ভাইয়ের হাতে ছুঁইয়ে একটা পয়সা দিলো তার মেয়ের হাতে…প্রথম ভাইফোঁটার উপহার।

    অনেক ভাইফোঁটা পেরিয়ে এসে আজ বুঝি,আমাদের ভাইফোঁটাটা আসলে মায়ের ইচ্ছেপূরণের ফোঁটা।মায়েরা তিন বোন তিন ভাই হলেও কখনো ভাইফোঁটা হয়নি আমার মামাবাড়িতে…যেমন হয়নি জামাইষষ্ঠী বা কোনো পুজো।মা সারা জীবন অন্যের দুয়োরে দাঁড়িয়ে দেখেছে কেমন করে কড়ে আঙুলে চন্দন ছুঁইয়ে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করতে করতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বোনের মুখ…প্রশান্তি ছড়িয়ে যায় ভাইয়ের মুখে।আমরা দুই ভাইবোন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ বলেই বোধহয় মা ভাইফোঁটার মতো অনুষ্ঠানের বাঁধনে বেশী করে বেঁধে রাখতে চায় আমাদের…যাতে তিনশো চৌষট্টি দিন ঝগড়ার পরও আমরা বাড়ি ফিরে আসি…আসন পেতে ধান-দুব্বো-চন্দন দিয়ে আরেকবার কষে বাঁধি সম্পর্কের গাটছড়াটাকে…।
  • Sanchayita Biswas | ১১ জুন ২০১৭ ১৯:৫৪366072
  • ১৭।
    বছরটা যত শেষের দিকে এগোয়,মনটাও কেমন 'ছুটি ছুটি' হয়ে যায়।সেপ্টেম্বর আসলেই মনে হয় "আহ্,কি মজা।সামনে পুজোর ছুটি।"পুজোর ছুটি গড়াতে গড়াতে ভাইফোঁটায় গিয়ে পৌঁছোয়।আনন্দটা একটু থমকে যায়।তারপরই মনে পড়ে যায়,কিছুদিন পরই তো বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে।সিলেবাসও শেষ করেই রেখেছি পুজোর আগে।একটু পুনরানুশীলন করালেই হবে ক'টা দিন।…ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু প্রশ্ন দিই ইংরেজী ব্যাকরণের।জানলার ওপাশে পুকুর।মিঠে রোদে মাছ ঠোকরায়।হু হু করে হাওয়া আসে।স্কুলের বারান্দায় উঠে আসে মোরগ... ঘাড় বাঁকিয়ে ইতিউতি দেখে।

    আমি সকালে উঠি।টুকটাক কাজ করি।খবরের কাগজকে মোহরের হাত থেকে বাঁচাই।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মামমামের মাছকাটা দেখি।বাজারের থলেতে উঁকি দেয় পালংশাক।শিবাজী ধোঁয়াওঠা গরম ভাতে পারশে মাছের ঝোল ঢেলে নেয়। মোহরকে নাইয়ে খাইয়ে নিজে তৈরী হই।ব্যস্ত অটোরিকশা চেঁচিয়ে থামাই।তবুও আমার ছুটি শেষ হয় না।অটোর ভেতর টাকার গল্প হয়।ব্যাঙ্কের সামনে দেখি বিশাল লম্বা লাইন।রাস্তার পাশে তামান্নাদের কুঁড়ে ঘরের সামনে বসে জাল বুনছে তামান্নার দাদু।

    ধানকাটা চলছে জোর কদমে।রাস্তায় ছড়িয়ে থাকে ধানের সোনালী ছড়া।শূণ্য মাঠে খড়ের গোড়া চিবোয় ছাগল।পায়রার ঝাঁক এসে খোঁজে ধানের কণা।স্কুলের মাঠ পেরোয় ট্রাক্টরের সারি।রোদে পিঠ রেখে পরীক্ষার খাতা দেখি।প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চারা স্টীলের থালায় ভাত আর সোয়াবিনের ঝোল খায় মাঠে গোল হয়ে বসে।আইসিডিএসের রাঁধুনীকে ঘিরে মা আর বাচ্চাদের ভিড়।ছোট ছোট ক্যান ভরে ওঠে খিচুড়ী আর ডিমসেদ্ধতে।

    আমার ছুটির মেজাজ ফুরোতেই চায় না।পরীক্ষার খাতা ফুরিয়ে যায়।রেজাল্টের কাজ ফুরিয়ে যায়।দুপুর ফুরিয়ে যায়।বিকেলের গায়ে ছায়া নামতে না নামতে আজানের সুর ওঠে মসজিদে।মা হাঁসের পিছনে ছানা হাঁস ঘরে ফেরে।বাড়ি ফিরতে ফিরতে খেয়াল করি আরেকটা ছুটির দিন ফুরিয়ে গেল।…রাস্তার পাশের কুঁড়েঘরে তখনও জাল বুনছে তামান্নার দাদু।…
  • neerab pathak | 84.128.***.*** | ১৩ জুন ২০১৭ ০৬:৩৮366073
  • আপনার লেখা পড়ে আজ সরব হলাম একটা ছোট্টো কুর্নিশ জানাতে।
  • Sanchayita Biswas | ১৩ জুন ২০১৭ ০৯:২২366074
  • ১৮।
    'অপরাজিত' প্রথমবার পড়ি যখন,তখন বোধহয় আমি সিক্সে বা সেভেনে পড়ি।জীর্ণ একটা বই…মলাটটা পর্যন্ত খাস্তা হয়ে গেছে…উপুড় হয়ে না পড়লে পাতাগুলো শিউলি ফুলের মতো ঝরে পড়ছে…মলাটে অপুর অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া মুখটায় জ্বলজ্বল করছে শুধু চোখদুটো…হলদে হয়ে যাওয়া প্রথম পাতায় কোনো একটা স্কুলের লাইব্রেরীর স্ট্যাম্প…সেটাও আবছা…দ্বিতীয় পাতায় বিনিময় মূল্য লেখা:'এক টাকা দুই আনা মাত্র'…।জ্বরোরুগীর মতো পড়ে চলেছি বইটা…অক্ষরগুলো মিশে যাচ্ছে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে…স্বস্তি পাচ্ছি না কোনোভাবে…কি একটা আবেগ যেন রক্তে তৈরী হয়েছে,যার মাথা আর ল্যাজের কোনো হদিশ আমি পাচ্ছি না কোনোভাবেই।বইটার শেষ পাতাটা শেষ করে আবার প্রথমে চলে যাচ্ছি…পুরোনো করে করে সইয়ে নিতে চাইছি অস্থিরতাটাকে…হচ্ছে না…কিছুতেই হচ্ছে না…।আমি বুঝতে পারিনি,আমি প্রথমবার প্রেমে পড়েছি।

    রোজ স্কুল যেতে আমার ভালো লাগতো না।আসলে আমি স্কুলটাকে খুব একটা পছন্দ করতে পারিনি কোনোদিন।শুধু লাইব্রেরীটা আমার খুব প্রিয় ছিল…রেফারেন্স বইয়ের আলমারীগুলো বাদ দিয়ে অবশ্যই।যেদিন যেদিন স্কুলে যেতাম না,সেই দিনগুলো আমার আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করতো।দু'চারটে অঙ্ক না মিললেই রাফখাতার পেছনের পাতায় পেন দিয়ে স্কেচ করতাম…কিংবা অনেক পুরোনো পূজাবার্ষিকী পড়তে শুরু করতাম টেপরেকর্ডারে গান চালিয়ে দিয়ে।এরকমই একটা দুপুরে আমি 'ন হন্যতে' পড়তে শুরু করি মায়ের বইয়ের তাক থেকে নিয়ে।এবং অবধারিতভাবেই মির্চা ইউক্লিডের প্রেমে পড়ি।"বইয়ের পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলেছি হঠাৎ পিছন থেকে মির্চার গলা শুনতে পেলাম---যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে---
    'একটু দাঁড়াও অমৃতা---why are you breaking down now when you were so brave for so many years…I will show you my real self on the shores of the Ganges…'। "

    মির্চা ইউক্লিডের প্রতি অনুরাগটা আমায় ভীষণভাবে কাবু করতে পারেনি। মাত্র কিছুদিন আগেই আমি আবিষ্কার করেছি আমি নিজের অজান্তেই শর্তহীনভাবে ভালবেসে ফেলেছি কাউকে।আমার ইচ্ছে করছে তাকে সবসময় দেখতে এবং কক্ষণো না দেখতে।আমি শুনতে চাইছি না তার কন্ঠস্বর…কিন্তু সবসময় তাকে শুনতে পাচ্ছি আমার মাথার ভেতর।আমি পুড়ছি প্রতি মুহূর্তে।আমি চাইছি নিজেকে সংযত রাখতে…নিঃস্পৃহ থাকতে।অথচ লক্ষ প্রজাপতি উড়ছে আমার মাথার ভেতরে।আমার হাত ঠান্ডা,পা ঠান্ডা…নাক আর কানে আগুনের হলকা…দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ঋতুহীন শৈত্যে…শব্দেরা উধাও হয়ে যাচ্ছে আমার স্মৃতি থেকে…।

    একেকটা সময় আসে যখন বেশ একটা নিশ্চিন্তভাব আসে মনে।তরঙ্গহীন বৈচিত্র্যহীন জীবনটাকে ভীষণভাবে ভালবেসে ফেলি।ওয়াসিং মেশিনে নোংরা বেডকভার-ঘেমো গন্ধওয়ালা শার্ট ভিজিয়ে ফেলি।দুই চারটে পদ রান্না করি।বইয়ের শোকেস আর ড্রেসিং টেবিলের জায়গা বদলে দিই।সিটিভিএন চ্যানেল চালিয়ে শাড়ি দেখি।একই পোষাক পরে রোজ ইস্কুলে চলে যাই।বাচ্চাদের লিখতে দিয়ে চক্ দিয়ে স্কেচ করি টেবিলে।সহকর্মীদের আলোচনা শুনতে শুনতে মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসি।কি আরাম যে লাগে এই সময়গুলোয়!কি সুন্দর প্রেমহীন,কষ্টহীন হয়ে যায় জীবনটা।নিজেই নিজের মনের গায়ে হাত বুলোই,"যাক্,তুই এ জীবনের মতো নিশ্চিন্ত।এবার তুই আরামে বুড়ো হ'।"…এই নিশ্চিন্তিভাব কিন্তু বেশীদিন টেকে না।ফালতু বিষয় নিয়ে ভয়ানক ঝগড়া করি বরের সঙ্গে।রাগে ফুসতে ফুসতে টের পাই গলে যাচ্ছি মনে মনে…বালিশ ভিজে যাচ্ছে নিঃস্পৃহ থাকবার অক্ষম জেদে…পাশ ফিরে ছুঁয়ে দেখছি ঘুমন্ত মানুষটাকে…কম্বলটা গায়ের উপর আলগোছে তুলে দিতে দিতে ভাবছি,"জেগে যাবে না তো!?"…
  • সিকি | 158.168.***.*** | ১৩ জুন ২০১৭ ১৮:৩৫366075
  • স্বপ্নেরা অক্ষরের রূপ নিলে বুঝি এই রকমই দেখতে হয়। কী অসীম মায়ার বুনোনে মোড়ানো প্রতিটা শব্দ।

    আজ সব পড়ে উঠলাম। এ ঘোর কাটতে সময় লাগবে। অনেক, অনেক জন্ম পরে গুরুর পাতায় এমন বলিষ্ঠ কলম পাচ্ছি।
  • Sanchayita Biswas | ১৪ জুন ২০১৭ ১৭:৫০366076
  • ১৯।
    প্রতিমাসেই শিবাজী ছবি তুলতে যায় কোথাও না কোথাও।কখনো বর্ধমান,কখনো টেরিটি বাজার…মোটামুটি দলবল নিয়ে আউটিং ওর লেগেই থাকে।ভোর রাতে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়ই মাঝরাত হয় সেইসব দিনগুলোয়।ওই কষ্ট করে এসে তক্ষুণি তক্ষুণি আবার কম্পিউটারে ফেলে দেখে কোন কোন ছবি ভালো হতে পারে।কোনো কোনো ছবি সাঁলোতে পাঠায়।কিছু আবার প্রশংসাও পায়।আনন্দে ঝলমলে হয়ে ওঠে ওর মুখ।কম্পিউটার খুলে আমায় দেখাতে বসে সেইসব মুহূর্ত-গাথা:দামাল ছেলের গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার গল্প,স্তূপ করা ভাঙা মূর্তির মাঝে অযত্নলালিত একরত্তি মেয়ে,প্রাচীনার হাতে স্থবির তসবি,গাজনমেলায় নৃত্যরত বহুরূপীর দল…

    আমাদের আলমারীতে একটা লম্বা অ্যালবাম ছিল।তিন ভাঁজ করা যেত ওটাকে।মোজাইক রঙের কভারের উপর গোলাপের ছবি।ওটা খুব সহজে আমাদের হাত অবধি আসতো না।একমাত্র মামা-মাসিরা বেড়াতে এলে একটা সন্ধ্যেবেলায় সবাই মিলে বসে ছবিগুলো দেখা হতো।কতজনের কত মুহূর্তের ছবি!অ্যালবামের ছবিগুলো উল্লম্বভাবে সাজানো থাকতো।প্রথম ছবিটা বাবা-মায়ের বিয়ের একমাত্র ছবি।শীতের রাতে বিয়ে।তাই টোপরপরা বাবার গায়ে খদ্দরের চাদর জড়ানো।লাল তাঁতের শাড়ি আর ঝুটো গয়নায় মোড়া মা।আশপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে কত মানুষ।ছবিটা দেখতে দেখতে বিপ্লবদাদা বলছে,"দ্যাখ দ্যাখ, মা কেমন ছোটমাসির পাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে!এই পার্থ, তুই কিরম হনুমান টুপি পরে আছিস,দ্যাখ!"পার্থদা মুখ থোম্বা করে বলছে,"নিজের দিকে তাকা।পেঁচার মতো উঁকি দিচ্ছিস পিসি পিসেমশাইয়ের মধ্যে থেকে।" "হা হা হি হি।" "রবিমামার হাসিখানা দ্যাখ।" "কই কই, কোনটা রবিমামা…এ বাবা,চেনাই যাচ্ছে না…"।মলিন হয়ে আসা ছবিতে বাবা-মা ছাড়া সবাই হাসছে…ঠিক যেমন ছবি দেখতে দেখতে আমরা হাসিতে ভেঙে পড়ছি।…

    বহুদিন অবধি ঐ একটাই অ্যালবাম ছিল আমাদের।আসলে আমাদের অনেক ছবি ছিল না।আমাদের ক্যামেরাও ছিল না।কখনো কখনো মা বিকেলবেলায় খেলা থেকে ডেকে নিয়ে চলে যেত স্টুডিওতে।স্টুডিওর চেয়ারে বসিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে দিতে মায়ের খেয়াল হতো মেয়ের পায়ে হাওয়াই চপ্পল।ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়কে রেখে গোলাপী ফ্রক পরে আর টেরীকাটা চুলে সাদা ব্যান্ড লাগিয়ে ছবি তোলাতাম গোমড়া মুখে।ছবি ওয়াশ করা হলে সবার আগে চোখ চলে যেত হাওয়াই চটিতে আর সারা পায়ে অসংখ্য মশা কামড়ানোর দাগে।

    আমাদের অ্যালবামে কত অচেনা লোকের ছবি ছিল।কোন এক গুরুদেব আর তার শিষ্যার দুই তিনটে ছবি ছিল।জিগ্যেস করে জেনেছিলাম, শিষ্যাটি নাকি আমার এক পিসি…যদিও কস্মিনকালে তাকে দেখিনি।ফ্রকপরা মায়ের পাশে আরেকটি মেয়ে…সে যে কে তা জানি না।কাদের বাড়ির বিয়েতে কারা যেন লম্বা সারিতে খেতে বসেছে।সামনে মাটির ভাঁড় আর শূণ্য শালপাতার থালা।আর একটা লোকের ছবি দেখতে আমার খুব মজা লাগতো। লোকটা টাইট ফুলহাতা জামা পরা আর ভীষণ ফ্রিলি বেলবটম ট্রাউজার্স পরে স্টুডিওর থামে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে একটু কাত হয়ে…চোখে আবার সানগ্লাস।লোকটাকে দেখেই আমার হিন্দী ছবির ভিলেন মনে হতো।লোকটার পরিচয় আমার বাবা-মাও জানে না।কিভাবে ছবিটা আমাদের কাছে এলো,সে এক রহস্য।

    অ্যালবামটা আজকাল আমার ওয়ারড্রোবে থাকে।মাঝে মাঝে বের করে দেখি একা একা।কিসব অদ্ভুত ছবি ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট খাপগুলোয়।একটা বাড়ির প্লাস্টার করা দোতলার ছবি…সে বাড়ি আদৌ আছে কি না,কে জানে।গ্রামের বাড়ির মেটে বারান্দায় মা দুই বেণী ঝুলিয়ে অনার্সের পড়া পড়ছে।ভাই একা একা হেঁটে যাচ্ছে পুরীর সমুদ্রের ধারে…দেখে মনে হচ্ছে ওর কেউ নেই।কোন একটা পুকুর পাড়ে আমি আর হীরকদা পাশাপাশি বসে আছি।কোদাল হাতে বাবা মাটি কোপাচ্ছে খালি গায়ে…ওটা নাকি দিদার কবর খোঁড়া হচ্ছিল।ঠাকুরদা গলায় রুদ্রাক্ষ পরে ধুতি পরে খালি গায়ে বসে আছে।দিদার পাশে ভীতু ভীতু মুখ করে কিশোর বড়মামা দাঁড়ানো…ঢোলা হাফপ্যান্ট থেকে দড়ি ঝুলছে।আমার তিনবছরের জন্মদিনে কল্যাণীর বাসাবাড়ির সামনে সবাই জড়ো হয়েছে হাসি হাসি মুখে।আমাকে বৌ সাজানো হয়েছে।আমি হীরকদা আর পিন্টুদার মাঝে গোমড়া মুখে বসে আছি। আর সব্বাই দাঁড়িয়ে আছে…নীল জামা পরে বাবা,কদমছাঁট চুলের বড়মেসো,ডাকাত ডাকাত ছোটমামা,হলদে ফ্রক পরে বুড়িদি,খুন্তি হাতে কোমরে হাত দিয়ে বড়মাসি,লিসাকে কোলে নিয়ে ছাপা ছাপা শাড়ি পরে মা,বামপাশে ঘাড় হেলিয়ে ছোটমামি,বাবার কাঁধের উপর দিয়ে ডিঙিস পেড়ে দাঁড়িয়ে বিপ্লবদা…

    শিবাজীর তোলা যে ছবিগুলো আমার খুব ভালো লাগে,তার মধ্যে থেকে দুটো ছবি দেখানো হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল সাঁলোতে।আমরা খুব খুশী।শিবাজী নানারকম প্ল্যানিং করে ছবিগুলো নিয়ে।আমি সেগুলো বুঝি না…কিন্তু ভাল লাগে ওর ঝলমলে হাসি দেখতে।ও বলে চলে,"দেড়শোটা অ্যাকসেপ্ট্যান্স হলে এফিএফ পাবো।"সেটা কি,সে আমি বুঝতে পারি না।আমি কম্পিউটার স্ক্রীণে ঝলমলে সেই ছবিগুলোর মাঝে পুরোনো অ্যালবামটাকে খুঁজি যেখানে আমার আর ভাইয়ের নিষ্পাপবেলার ছবির পাশের খোপে সদ্যবিবাহিত বাবা-মা বসে থাকে…মুখে মৃদু হাসি…লাল তাঁত পরা মায়ের সিঁথি আনন্দে ভরে আছে…
  • Sanchayita Biswas | ১৫ জুন ২০১৭ ১৭:১৫366080
  • ২০।
    নেকদিন পরে পরে মামা-মাসির বাড়িতে যাই বাবা-মায়ের সঙ্গে।ভ্যানরিকশায় চেপে বাড়ি থেকে স্টেশন।এ গলি ও গলি পেরিয়ে রিকশাটা বড়ো রাস্তায় ওঠে।রাস্তাটা বেশ উঁচু।রিকশাওয়ালা চারজন মানুষ নিয়ে একটানে উঠতে পারে না।বাবা নেমে গিয়ে পেছন থেকে ঠেলে দেয় রিকশা।এক ঝটকায় হুড়মুড় করে বড় রাস্তায় ওঠে গাড়িটা।আমি মনে মনে হাঁক দেই,"হেইয়ো!"

    মা সারা রাস্তা পাখি পড়াতে পড়াতে যায়,"নাম বল্","ঠিকানা বল্","বাবার নাম কি","অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু নিবি না","কেউ কিছু দিলে খাবি না","ট্রেনে তুই উঠতে পারলে আর আমি না উঠতে পারলে পরের স্টেশনে নেমে দাঁড়াবি","আমি উঠতে পারলে আর তুই না পারলে চুপচাপ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবি।আমি ফিরে আসবো" ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি শুনি আর মনে মনে আতঙ্কগ্রস্থ হই।প্রতিবার ট্রেনে ওঠার সময় মায়ের আঁচল নতুবা বাবার পকেট শক্ত করে ধরে থাকি।আর প্রতিবার ভাবি, 'এইবার বুঝি হারিয়ে গেলাম!'

    বাবা ট্রেনের গলিতে ঢুকিয়ে দেয় দুই ভাইবোনকে।অচেনা হাঁটুগুলোতে ঠোক্কর খেতে খেতে জানলায় পৌঁছে যাই।জানলার শিকে হাত দেওয়া বারণ(মায়ের নির্দেশ) কারণ প্রায়ই সেখানে বমি-কফ-থুতু-পানের পিকের দেখা মেলে।সুতরাং আমরা দুইজন অসমান দেওয়াল কোনোরকমে ধরে দুলতে থাকি ট্রেনের ছন্দে।স্টেশন আসে…হুমড়ি খাই।স্টেশন ছাড়ে…হুমড়ি খাই।শেষে জানলায় বসা কোনো স্নেহাতুর কাকু বা মাসির কোলে জায়গা মেলে।চলন্ত গাছ-ধানক্ষেত-আকাশ পেরোতে পেরোতে উত্তর দিই তার সব প্রশ্নের।
    -"তোমার নাম কি?"
    নাম বলি।
    -"বাবার নাম কি?"
    বাবার নাম বলি।
    -"কোথায় যাচ্ছো?"
    তাও বলি।
    -"বাড়ি কোথায়?"
    মায়ের শেখানো ঠিকানা বলতে বলতে মায়ের দিকে চাই।গর্ব ঠিকরে বেরোয় মায়ের চাউনি থেকে।মেয়ে ঠিকঠাক ঠিকানা বলতে পেরেছে যে!এ মেয়ে হারাবে না!!

    উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়েছি স্কুলপাশ করে।ঢাউস একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে হোস্টেল বদল করেছি বারংবার।সংসার পেতেছি ঝরঝরে তক্তপোশের ওপর তোষক বিছিয়ে…বরাদ্দ একটা তাকে অন্তহীন বইখাতার স্তূপে…আলনার একটা অংশে মুষ্টিমেয় কিছু জামাকাপড়ে…একটা বালতি-একটা মগ-একটা থালা-একটা বাটি-একটা গ্লাসে…।রুমমেট বদলেছে বছর বছর।আলাপ পরিচয় পর্বে জেনেছি তাদের ঠিকানা,যেমনভাবে তারাও জেনেছে আমারটা।নিজের ঠিকানা বলতে বলতে মন চলে গেছে তক্তপোশের তলায় রাখা ট্রাংকের গায়ে যেখানে বহুকাল আগে বাবা লাল রঙে লিখিয়ে রেখেছিল আমার নাম-ঠিকানা।…

    আজকাল কেউ আমায় যখন জিগ্যেস করে,"বাড়ি কোথায়?",আমি ভারী মুশকিলে পড়ি।মুখে যে ঠিকানা বলি,মনের ঠিকানার সাথে তা মেলে কই!বিয়ের পর খাতাকলমে না হলেও আমার ঠিকানা তো বদলে গেছেই।আমি যে এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকি বেশীরভাগ সময়।আমি আর আমার ছোটবেলার কোলবালিশে রোজ পা তুলে শুই না।ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রোজ আমার এলোমেলো ওয়ারড্রবে গুঁজে রাখি না।ফ্রিজ থেকে ইচ্ছেমতো ডিম বের করে ভেজে ডালের পাতে খাই না।'রিচি রিচ' দেখবো বলে টিউশন মিস্ করি না।ক্যাসেট চালিয়ে রেখে হাতের কাজ পরীক্ষার প্র্যাকটিকাল খাতা তৈরী করি না।বালিশের নীচে 'পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক' বা 'সত্যি রাজপুত্র' নিয়ে ঘুমাই না।…

    প্রতিবছর অনেক বই আসে মায়ের নামে…পাবলিশাররা পাঠায় ক্যুরিয়ারে।মা প্রত্যেকটার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখে…আর লেখে কুমারীবেলার ঠিকানা।আগে ভারি বিরক্ত লাগতো।জিগ্যেস করতাম কেন এরকম লেখে।আজকাল বুঝি জীবন যেখানে এনে ফেলেছে মাকে,সেটা মায়ের বাড়ি নয়।আমার মতো মাও মনে মনে অন্য ঠিকানায় বাস করে…যেখানে দিনের শেষে পিঠোপিঠি ভাইবোন এক হ্যারিকেনের কাছে ভিড় করে কানে আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করে…
  • Sanchayita Biswas | ১৫ জুন ২০১৭ ১৭:১৫366079
  • ২০।
    নেকদিন পরে পরে মামা-মাসির বাড়িতে যাই বাবা-মায়ের সঙ্গে।ভ্যানরিকশায় চেপে বাড়ি থেকে স্টেশন।এ গলি ও গলি পেরিয়ে রিকশাটা বড়ো রাস্তায় ওঠে।রাস্তাটা বেশ উঁচু।রিকশাওয়ালা চারজন মানুষ নিয়ে একটানে উঠতে পারে না।বাবা নেমে গিয়ে পেছন থেকে ঠেলে দেয় রিকশা।এক ঝটকায় হুড়মুড় করে বড় রাস্তায় ওঠে গাড়িটা।আমি মনে মনে হাঁক দেই,"হেইয়ো!"

    মা সারা রাস্তা পাখি পড়াতে পড়াতে যায়,"নাম বল্","ঠিকানা বল্","বাবার নাম কি","অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু নিবি না","কেউ কিছু দিলে খাবি না","ট্রেনে তুই উঠতে পারলে আর আমি না উঠতে পারলে পরের স্টেশনে নেমে দাঁড়াবি","আমি উঠতে পারলে আর তুই না পারলে চুপচাপ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবি।আমি ফিরে আসবো" ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি শুনি আর মনে মনে আতঙ্কগ্রস্থ হই।প্রতিবার ট্রেনে ওঠার সময় মায়ের আঁচল নতুবা বাবার পকেট শক্ত করে ধরে থাকি।আর প্রতিবার ভাবি, 'এইবার বুঝি হারিয়ে গেলাম!'

    বাবা ট্রেনের গলিতে ঢুকিয়ে দেয় দুই ভাইবোনকে।অচেনা হাঁটুগুলোতে ঠোক্কর খেতে খেতে জানলায় পৌঁছে যাই।জানলার শিকে হাত দেওয়া বারণ(মায়ের নির্দেশ) কারণ প্রায়ই সেখানে বমি-কফ-থুতু-পানের পিকের দেখা মেলে।সুতরাং আমরা দুইজন অসমান দেওয়াল কোনোরকমে ধরে দুলতে থাকি ট্রেনের ছন্দে।স্টেশন আসে…হুমড়ি খাই।স্টেশন ছাড়ে…হুমড়ি খাই।শেষে জানলায় বসা কোনো স্নেহাতুর কাকু বা মাসির কোলে জায়গা মেলে।চলন্ত গাছ-ধানক্ষেত-আকাশ পেরোতে পেরোতে উত্তর দিই তার সব প্রশ্নের।
    -"তোমার নাম কি?"
    নাম বলি।
    -"বাবার নাম কি?"
    বাবার নাম বলি।
    -"কোথায় যাচ্ছো?"
    তাও বলি।
    -"বাড়ি কোথায়?"
    মায়ের শেখানো ঠিকানা বলতে বলতে মায়ের দিকে চাই।গর্ব ঠিকরে বেরোয় মায়ের চাউনি থেকে।মেয়ে ঠিকঠাক ঠিকানা বলতে পেরেছে যে!এ মেয়ে হারাবে না!!

    উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়েছি স্কুলপাশ করে।ঢাউস একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে হোস্টেল বদল করেছি বারংবার।সংসার পেতেছি ঝরঝরে তক্তপোশের ওপর তোষক বিছিয়ে…বরাদ্দ একটা তাকে অন্তহীন বইখাতার স্তূপে…আলনার একটা অংশে মুষ্টিমেয় কিছু জামাকাপড়ে…একটা বালতি-একটা মগ-একটা থালা-একটা বাটি-একটা গ্লাসে…।রুমমেট বদলেছে বছর বছর।আলাপ পরিচয় পর্বে জেনেছি তাদের ঠিকানা,যেমনভাবে তারাও জেনেছে আমারটা।নিজের ঠিকানা বলতে বলতে মন চলে গেছে তক্তপোশের তলায় রাখা ট্রাংকের গায়ে যেখানে বহুকাল আগে বাবা লাল রঙে লিখিয়ে রেখেছিল আমার নাম-ঠিকানা।…

    আজকাল কেউ আমায় যখন জিগ্যেস করে,"বাড়ি কোথায়?",আমি ভারী মুশকিলে পড়ি।মুখে যে ঠিকানা বলি,মনের ঠিকানার সাথে তা মেলে কই!বিয়ের পর খাতাকলমে না হলেও আমার ঠিকানা তো বদলে গেছেই।আমি যে এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকি বেশীরভাগ সময়।আমি আর আমার ছোটবেলার কোলবালিশে রোজ পা তুলে শুই না।ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রোজ আমার এলোমেলো ওয়ারড্রবে গুঁজে রাখি না।ফ্রিজ থেকে ইচ্ছেমতো ডিম বের করে ভেজে ডালের পাতে খাই না।'রিচি রিচ' দেখবো বলে টিউশন মিস্ করি না।ক্যাসেট চালিয়ে রেখে হাতের কাজ পরীক্ষার প্র্যাকটিকাল খাতা তৈরী করি না।বালিশের নীচে 'পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক' বা 'সত্যি রাজপুত্র' নিয়ে ঘুমাই না।…

    প্রতিবছর অনেক বই আসে মায়ের নামে…পাবলিশাররা পাঠায় ক্যুরিয়ারে।মা প্রত্যেকটার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখে…আর লেখে কুমারীবেলার ঠিকানা।আগে ভারি বিরক্ত লাগতো।জিগ্যেস করতাম কেন এরকম লেখে।আজকাল বুঝি জীবন যেখানে এনে ফেলেছে মাকে,সেটা মায়ের বাড়ি নয়।আমার মতো মাও মনে মনে অন্য ঠিকানায় বাস করে…যেখানে দিনের শেষে পিঠোপিঠি ভাইবোন এক হ্যারিকেনের কাছে ভিড় করে কানে আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করে…
  • Sanchayita Biswas | ১৫ জুন ২০১৭ ১৭:১৫366078
  • ২০।
    নেকদিন পরে পরে মামা-মাসির বাড়িতে যাই বাবা-মায়ের সঙ্গে।ভ্যানরিকশায় চেপে বাড়ি থেকে স্টেশন।এ গলি ও গলি পেরিয়ে রিকশাটা বড়ো রাস্তায় ওঠে।রাস্তাটা বেশ উঁচু।রিকশাওয়ালা চারজন মানুষ নিয়ে একটানে উঠতে পারে না।বাবা নেমে গিয়ে পেছন থেকে ঠেলে দেয় রিকশা।এক ঝটকায় হুড়মুড় করে বড় রাস্তায় ওঠে গাড়িটা।আমি মনে মনে হাঁক দেই,"হেইয়ো!"

    মা সারা রাস্তা পাখি পড়াতে পড়াতে যায়,"নাম বল্","ঠিকানা বল্","বাবার নাম কি","অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু নিবি না","কেউ কিছু দিলে খাবি না","ট্রেনে তুই উঠতে পারলে আর আমি না উঠতে পারলে পরের স্টেশনে নেমে দাঁড়াবি","আমি উঠতে পারলে আর তুই না পারলে চুপচাপ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবি।আমি ফিরে আসবো" ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি শুনি আর মনে মনে আতঙ্কগ্রস্থ হই।প্রতিবার ট্রেনে ওঠার সময় মায়ের আঁচল নতুবা বাবার পকেট শক্ত করে ধরে থাকি।আর প্রতিবার ভাবি, 'এইবার বুঝি হারিয়ে গেলাম!'

    বাবা ট্রেনের গলিতে ঢুকিয়ে দেয় দুই ভাইবোনকে।অচেনা হাঁটুগুলোতে ঠোক্কর খেতে খেতে জানলায় পৌঁছে যাই।জানলার শিকে হাত দেওয়া বারণ(মায়ের নির্দেশ) কারণ প্রায়ই সেখানে বমি-কফ-থুতু-পানের পিকের দেখা মেলে।সুতরাং আমরা দুইজন অসমান দেওয়াল কোনোরকমে ধরে দুলতে থাকি ট্রেনের ছন্দে।স্টেশন আসে…হুমড়ি খাই।স্টেশন ছাড়ে…হুমড়ি খাই।শেষে জানলায় বসা কোনো স্নেহাতুর কাকু বা মাসির কোলে জায়গা মেলে।চলন্ত গাছ-ধানক্ষেত-আকাশ পেরোতে পেরোতে উত্তর দিই তার সব প্রশ্নের।
    -"তোমার নাম কি?"
    নাম বলি।
    -"বাবার নাম কি?"
    বাবার নাম বলি।
    -"কোথায় যাচ্ছো?"
    তাও বলি।
    -"বাড়ি কোথায়?"
    মায়ের শেখানো ঠিকানা বলতে বলতে মায়ের দিকে চাই।গর্ব ঠিকরে বেরোয় মায়ের চাউনি থেকে।মেয়ে ঠিকঠাক ঠিকানা বলতে পেরেছে যে!এ মেয়ে হারাবে না!!

    উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়েছি স্কুলপাশ করে।ঢাউস একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে হোস্টেল বদল করেছি বারংবার।সংসার পেতেছি ঝরঝরে তক্তপোশের ওপর তোষক বিছিয়ে…বরাদ্দ একটা তাকে অন্তহীন বইখাতার স্তূপে…আলনার একটা অংশে মুষ্টিমেয় কিছু জামাকাপড়ে…একটা বালতি-একটা মগ-একটা থালা-একটা বাটি-একটা গ্লাসে…।রুমমেট বদলেছে বছর বছর।আলাপ পরিচয় পর্বে জেনেছি তাদের ঠিকানা,যেমনভাবে তারাও জেনেছে আমারটা।নিজের ঠিকানা বলতে বলতে মন চলে গেছে তক্তপোশের তলায় রাখা ট্রাংকের গায়ে যেখানে বহুকাল আগে বাবা লাল রঙে লিখিয়ে রেখেছিল আমার নাম-ঠিকানা।…

    আজকাল কেউ আমায় যখন জিগ্যেস করে,"বাড়ি কোথায়?",আমি ভারী মুশকিলে পড়ি।মুখে যে ঠিকানা বলি,মনের ঠিকানার সাথে তা মেলে কই!বিয়ের পর খাতাকলমে না হলেও আমার ঠিকানা তো বদলে গেছেই।আমি যে এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকি বেশীরভাগ সময়।আমি আর আমার ছোটবেলার কোলবালিশে রোজ পা তুলে শুই না।ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রোজ আমার এলোমেলো ওয়ারড্রবে গুঁজে রাখি না।ফ্রিজ থেকে ইচ্ছেমতো ডিম বের করে ভেজে ডালের পাতে খাই না।'রিচি রিচ' দেখবো বলে টিউশন মিস্ করি না।ক্যাসেট চালিয়ে রেখে হাতের কাজ পরীক্ষার প্র্যাকটিকাল খাতা তৈরী করি না।বালিশের নীচে 'পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক' বা 'সত্যি রাজপুত্র' নিয়ে ঘুমাই না।…

    প্রতিবছর অনেক বই আসে মায়ের নামে…পাবলিশাররা পাঠায় ক্যুরিয়ারে।মা প্রত্যেকটার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখে…আর লেখে কুমারীবেলার ঠিকানা।আগে ভারি বিরক্ত লাগতো।জিগ্যেস করতাম কেন এরকম লেখে।আজকাল বুঝি জীবন যেখানে এনে ফেলেছে মাকে,সেটা মায়ের বাড়ি নয়।আমার মতো মাও মনে মনে অন্য ঠিকানায় বাস করে…যেখানে দিনের শেষে পিঠোপিঠি ভাইবোন এক হ্যারিকেনের কাছে ভিড় করে কানে আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করে…
  • Sanchayita Biswas | ২২ জুন ২০১৭ ০৭:২৫366081
  • ২১।
    সকালবেলা বাজার করতে যাওয়ার পথে অভ্যাসবশেই আমি শম্পামাসিদের ঝাঁ চকচকে থমথমে বাড়িটার দিকে তাকাই ও দীর্ঘশ্বাস ফেলি।এই বাড়িটা আমার একটুও পছন্দ নয়।শম্পামাসিদের পুরোনো বাড়িটাই আমার খুব পছন্দের ছিল। গলি রাস্তা থেকে সটান একফালি এবড়ো খেবড়ো জমি পেরিয়ে উঁচু তিন-চারধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে লাল মেঝেওয়ালা বারান্দায় পৌঁছে যাওয়া যেত।বারান্দায় আগল ছিল না বলে আমার ভালোও লাগতো,ভয়ও লাগতো।আমি চিরকালই ধুপধাপ পড়ে যাই যেখানে সেখানে।তাই অতো উঁচু বারান্দার ধারে বসতে বেশ ভয় লাগতো।আবার কোণা বরাবর মোটা মোটা ঠান্ডা থামে হেলান দিয়ে বসতে ভালোও লাগতো।ওখানে বসলেই ওদের কয়লার গুদামটা ষ্পষ্ট দেখা পেতাম।উঁচু বিশাল একটা ঘর…সবটাই কয়লায় ভর্তি।বারান্দায় বসে সাধারণ জ্ঞানের বইতে পড়তাম:
    প্রঃ পশ্চিমবঙ্গের কয়লা শিল্পাঞ্চলের নাম বলো।
    উঃ দুর্গাপুর-রাণীগঞ্জ।
    পড়তে পড়তে গুদামঘরটার দিকে চোখ চলে যেত…টোপা টোপা কয়লার পাহাড় আর কালচে একটা কয়লা তোলার বেলচা…।দুর্গাপুর বা রাণীগঞ্জ জায়গাটা বোধহয় ঐ গুদামটার মতোই!

    আমার অক্ষরশিক্ষা হয় শম্পামাসির কাছে।একদিন বিকেলবেলায় মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলো মাসি।কি সব কথাবার্তা হলো।পরেরদিন থেকেই মাসির কাছে পড়া শুরু হলো আমার।মাসির কোলে বসে স্লেটের ওপর খড়ি দিয়ে লেখা শিখলাম 'অ'…আমাদের কামরাঘরের তক্তপোশে মাদুরের ওপর বসে প্রথাগত শিক্ষার প্রথম পাঠ…বাইরে ঝলমলে মফঃস্বলীয় রোদ্দুর…টাইম-কলে পাড়ার মেয়ে-বৌদের নিত্যকার ঝগড়া…হুডতোলা রিকশার প্যাঁ পুঁ…

    মাসিরা তিন ভাইবোন।শম্পামাসি,বাবনমামা আর পিঙ্কুমামা তিনজনই প্রাইভেট টিউশন করতো তখন।বাড়িতে ছাত্রছাত্রীরা আসতো প্রায় সারাক্ষণ ।হাহাহিহি থেকে ঠাসঠুস দুমদাম নানারকম শব্দ হতো পড়ার সময়।ওদের কলতলায় ঘসঘস শব্দে বাসন মাজতো কাজের বৌ।কয়লা কিনতে আসতো নানারকম লোকজন।তাদের সাথে দরদাম থেকে গল্পগাছা সবটাই করতো মাসির বাবা যাকে আমি দাদু বলতাম।ঘরের কাজ করতে করতে ক্রমাগত কথা বলে যেতো দিদা।সব মিলিয়ে জমজমাট একটা বাড়ি।আমার অদ্ভুত ভালো লাগতো এই হট্টমেলা।দাদু আমায় 'বৌ' সম্বোধন করতো।দাদুর স্পিচে কিছু সমস্যা ছিল মনে হয়।আমি বেশীরভাগ কথাই বুঝতে পারতাম না। আমায় যা-ই বলতো দাদু,আমি মুখে হাসি ঝুলিয়ে অল্প অল্প মাথা নেড়ে দিতাম।আমার এই অভ্যেসটা আজও যায়নি।কথা খুঁজে না পেলে আজও আমি এই কাজটাই করে নিজের অজ্ঞতা ঢাকি।

    ওদের বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা ছিল ওদের ছাদ।ন্যাড়া 'L' আকারের একতলা ছাদ…কালচে কালচে মেঝে…কোনো খাঁজে দু'একটা অশথ গাছের চারা জন্মেছে।ছাদ থেকে সারা পাড়া দেখা যায়।ঐ যে সামনের গলির ওপারের শ্যাওলামাখা পুকুর…সিঁড়ি খসে গেছে…নর্দমার পাশে উপচে পড়ছে নোংরার স্তূপ…বাড়ির পেছনে আরো বাড়ি…তার পিছনে একটা মাঠ…মাঠের পাশে টলটলে পুকুর…বিকেলের রোদ গা সেঁকছে তার জলে…।এই ছাদেই আমি প্রথম তারাখসা দেখি।সেটা কোন্ সাল মনে নেই।তবে সেই রাতে সারা মফঃস্বল জেগেছিল উল্কাপাত দেখবার উত্তেজনায়।মা-বাবার সাথে শম্পামাসিদের ছাদে এসেছিলাম আমরা দুই ভাইবোন।মাদুরের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে সেই মহাজাগতিক সৌন্দর্য্য দেখেছিলাম সবাই মিলে।তারায় ভরা রাতের আকাশ এভাবে আগে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি আমার।

    ওদের ঠাকুরের সিংহাসনটা খুব সুন্দর ছিল।দিদা-দাদু রঙিন ঝলমলে বসন পরাতো ঠাকুরদের।তাঁদের নাইয়ে খাইয়ে শয়ন দিতো নিত্যদিন।ঠাকুরদের ছোট ছোট বালিশগুলো দেখে আমার ভারী লোভ হতো।আহা রে,ওগুলো পেলে আমার ন্যাড়ামুন্ডি মেয়ে পুতুলটা কি আরামেই না ঘুমোতো!বোধহয় সোমবারে সোমবারে দিদা বট্ঠাকুরের পুজো দিতো।সেইসব বিকেলবেলায় খেলার শেষে ওদের বাইরের সিঁড়িতে বসে প্রসাদ খেতাম আমি।

    এক বিকেলে মাসি নিয়ে গেল বড়ো রাস্তার দিকে।মাকে ছেড়ে ওই আমার প্রথম কারো সাথে কোথাও যাওয়া।মাসির হাত ধরে গলি পেরোলাম…বড়ো রাস্তা টপকে সিনেমাহলের গলিতে ঢুকলাম।এই গলিটায় ঢুকিনি আগে কখনো।বাইরে থেকে দেখেছি গলির মুখে মুচির দোকান।মাসির সাথে মুচির দোকান পেরিয়ে বাদাম-মশলামুড়ি-কোল্ডড্রিঙ্কের দোকানকে বায়ে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি।হাঁ করে দেখছি হার্ডওয়ারের দোকানের সামনে সিনেমার টিকিট হাতে দাঁড়ানো দর্শকের জটলা…উঁচু ঝকঝকে সিনেমাহল…উপরে রঙচঙে পোস্টারে নায়ক-নায়িকার ছবি।সেসব পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।আরেকটু এগোলেই বিশাল ইছামতী…বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে জলে…জায়গায় জায়গায় চলটাওঠা স্যাঁতলাপড়া।নদীর পাশে একটা বাড়ি.. একতলা না দোতলা মনে নেই।মাসির হাত ধরে সেই বাড়িতে ঢুকেছি আর চমকে উঠেছি।একটা বড়ো ঘর…অজস্র তাক…কত্ত কত্ত বই…।সেই প্রথম আমার লাইব্রেরীর সাথে পরিচয়।মাসি বই জমা করছে।নতুন বই ইস্যু করছে।কয়েকজন চেয়ার-টেবিলে নিবিষ্ট হয়ে পড়াশুনা করছে।সিনেমাহল থেকে ছবি শেষের ঘন্টা শোনা গেল।আমি একঘর বইয়ের মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি।অনেক উপরে কড়িবরগার সিলিঙে ঘটাং ঘটাং করে পাখা চলছে।কেউ টেবিলে বই বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে গেছে।হাওয়ায় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে পাতাগুলো।জানলার বাইরে সন্ধ্যে নামছে।পাশেই কোনো গাছে পাখিদের কলরোল শুনছি।নদীর জল কমলা হয়ে উঠছে।আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছে…ভীষণ কান্না পাচ্ছে…
  • rani | 113.88.***.*** | ২২ জুন ২০১৭ ১৭:০৭366082
  • আশ্চর্য ভালো
  • Titir | 138.2.***.*** | ২২ জুন ২০১৭ ১৯:৩৫366083
  • ভীষন ভালো লাগছে। ইছামতী দেখিনি কখনো, কিন্তু মূর্ত হয়ে উঠেছে কমলা রঙে । দিব্য দেখতে পাচ্ছি তাকে।
  • Sanchayita Biswas | ২৩ জুন ২০১৭ ১৮:২৪366084
  • ২২।
    একেকটা দিন বাঁচতে ভীষণ ভালো লাগে।সকালে জানলা খুলেই কুসুম কুসুম রোদ আর শিরশিরে হাওয়া মাখতে ভালো লাগে।মোহর চোখ মেলেই সুর করে যখন বলে,"মাম্মাম,ভায়ো আতো?",তখন বাঁচার ইচ্ছেটা আরো বেড়ে যায়।গোরা আমাদের জেগে ওঠার সংবাদ কিরকম করে যেন পেয়ে যায়।দুই পা মশারীর ওপর তুলে লেজ নাড়তে থাকে আনন্দে।সদ্য ঘুম কাটা ফোলা ফোলা চোখ আর এলোঝেলো চুল নিয়ে মোহর উঠে বসে।পুটপুটে ঠোঁটদুটো গোল করে হাঁই তুলতে তুলতে গোরাকে 'গুম্মন্নিং' বলে।আমার সকালটা ঝলমলিয়ে ওঠে।

    রান্নাঘরের পাশে একটা আমগাছ গজিয়েছিল।বাড়তে বাড়তে এখন ছাদে উঠে গেছে।ওই কোণেই কলের তলায় বালতি মগ রাখে মা সারা বছর।আমরা ছাদে রোদ পোহাতে উঠলেই মোহর ঐ কোণে চলে যায়।ফাঁকা বালতি মগ নিয়ে এসে গোরার পিছনে ছোটে।মগটা ফাঁকা বালতিতে চুবিয়ে তুলে এনে গোরার গায়ে ঠেকায়।তারপর কচি কচি আঙুলগুলো লোমের মধ্যে দিয়ে চালাতে চালাতে স্বগতোক্তি করে,"গোয়া,তান কর্।"

    আমাদের বাড়ির পেছনে বাগানে একটা বাদাম গাছ আছে।আয়লার সময় গাছটা কিশোর ছিল।ঝোড়ো হাওয়ায় শিকড় প্রায় উপড়ে আমার ঘরের জানলায় এসে আছড়ে পড়েছিল।ঝড়ের শেষে বাগানের মালিক খুঁটি দিয়ে আবার দাঁড় করিয়ে দেয় গাছটাকে।গাছটা এখন কিশোর থেকে যুবক হয়েছে।ডিসেম্বরের শীতে লালচে-মরচে হয়ে গেছে পাতাগুলো।ছাদ থেকে দেখা যায়, মগডালে আটকে আছে হলদে একটা ঘুড়ি।উত্তুরে হাওয়ায় নড়ে ওঠে সেটা…কিন্তু উড়তে পারে না।

    মোহর যতক্ষণ জেগে থাকে,ততক্ষণ চটরপটর করে কথা বলতে থাকে।গাছ থেকে আমপাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে করতে আপনমনেই বলতে থাকে,"আমপাতা জোয়া জোয়া…মায়বো তাবুক…"।যদি বলি,"টাপুরটুপুর সারা দুপুর নুপূর বাজায় কে?"নিজেকে দেখিয়ে বলে,"আমি আমি"।আমাকে নকল করে গোরার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে,"কিইই ছোনা…!"গরম পিঠে হাতে নিয়ে কুটুর কুটুর করে খায় আর সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।একটু প্রসাদের আশায় গোরাও ওর পেছন পেছন ঘোরে।গোরার দিকে চোখ পাকায়,"আপ।দেবো না।"তারপরেও কি মনে করে বাকি পিঠে দিয়ে দেয় ওকে।

    এই যে একই কম্বলে জড়ামড়ি করে আমি,মোহর আর গোরা রোজ ভাতঘুম দিচ্ছি,এটার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে।শিরশিরে দুপুরের রোদের সাথে দূরে পিকনিক পার্টি থেকে ভেসে আসা উদ্ভট গানগুলোর জন্য বাঁচতে বেশ লাগে।রোদ পড়ে এলে জামাকাপড় তুলতে যাই ছাদে।রেলিঙে মোহরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।গোরা দুই পা রেলিঙে তুলে আমার দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে।রাস্তা পেরিয়ে দাসপাড়ার কুড়েঘরগুলোর পলিথিন লাগানো ছাদগুলো পেরিয়ে ফোনের টাওয়ার- ক্লাবের পুকুর ছাড়িয়ে পুরোনো আইসক্রিম কলের ঘরটায় গিয়ে চোখ আটকে যায়।এখন ওটা কাঠের গুদাম।কিন্তু আমার কানে ওই ঘর থেকে আসা শোঁ শোঁ ঘটাং ঘটাং শব্দই আসে…যেমন অনেক বছর আগে সত্যি সত্যি ঐ শব্দই হতো।আমি বেশ দেখতে পাই,গাবলুগুবলু একটা ফ্রকপরা মেয়ে চারকোণা একটা পঁচিশ পয়সা নিয়ে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কলটার বাইরে…হলুদ বরফ আইসক্রিম কিনবে…কিন্তু একা একা সাহসে কুলোচ্ছে না ভেতরে ঢুকতে!কে যেন ভেতর থেকে বললো,"কি চাই,খুকি?"মুখচোরা ভীতু মেয়ে কিছু না বলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগিয়েছে…রোদ্দুরে লালচে একটা মুখ…।আমি ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি।মোহর অভ্যাসবশে জিগ্যেস করে,"মাম্মাম,কি কত্তো?"আমি আনমনেই বলি,"কিছু করছি না বাবা।"কাদের বাড়ি থেকে গান শোনা যায়,"শাঁখো পে পাত্তে থি…পাত্তো মে বুন্দে থে…বুন্দো মে পানি থা…পানি মে আঁসু থে…না জানে কিঁউ দিল ভর গয়া…"।বেঁচে থাকার অনেক আনন্দ…ব্যথা ব্যথা তিরতিরে সুখ…।
  • Sanchayita Biswas | ২৫ জুন ২০১৭ ২৩:০২366085
  • ২৩।
    কল্যাণীর বাসাবাড়িটা আমার কেমন স্বপ্নে পাওয়া বলে মনে হয়।যেন সত্যি সত্যি ছিল না…কিন্তু আমার মাথার মধ্যে কোথাও একটা আছে।একটা ছোট্ট শোবার ঘর আর একটা কামরাঘর…কামরাঘরে স্টোভ পাতা…তাতে ছোট্ট দুধের হাঁড়ি বসানো…শোবার ঘরে আমাদের পুরোনো তক্তপোশটা পাতা…ইট দিয়ে অনেকখানি উঁচু করা…সাদা-কালো একটা ছোট্ট টিভি…টিভিতে একটা নবে মোচড় দিয়ে দূরদর্শন ধরানো…গান বাজছে কোত্থেকে 'উরি উরিব্বাবা'…উঠোনের এক কোণে একটা টয়লেট…টিউবওয়েলের সামনে বালতি-মগ রাখা…বাবা অফিস যাবার আগে ওখানে স্নান করছে…।

    পিন্টুদা আর তার পিসিমণির বাড়িটা আমাদের ছোট্ট ঘর দুটোর পাশেই ছিল।ওরা আমাদের বাড়িওয়ালা।পিন্টুদার পিসিমণিকে আমিও পিসিমণি বলতাম।ওনাকে আমার মনে নেই।কিন্তু ওদের তিন ধাপপয়ালা সিঁড়িটা মনে আছে।লাল মেঝেটা মনে আছে।আর মনে আছে পিন্টুদার লাল-কালো একটা ট্রেন…প্ল্যাস্টিকের রেললাইনের ওপর ছুটতো…কুউউউ ঝিকঝিকঝিকঝিকঝিক…।ট্রেনটা ওর মহার্ঘ্য সম্পত্তি। আমার হাত দেওয়া মানা।আমি তাকিয়ে আছি... '৪'এর আকারের রেললাইন দিয়ে তিনকামরার ট্রেন ছুটছে…আমার ভীষণ ইচ্ছা করছে ওটাকে ছুঁতে।আর কোনো খেলনা কোনোদিন এরকমভাবে ছুঁতে চাইনি।

    কতগুলো অগোছালো ফল-ফুলের গাছ নিয়ে ছোট্ট একচিলতে বাগান এ বাড়িতে।গেটের ধারে একটা নারকেল গাছ মনে হয় ছিল।একটা লেবুগাছ ছিল…কি লেবু জানি না।তবে বাগানটা আমার কাছে ইন্টাররেস্টিং মনে হতো কারণ ওতে হলুদ গাছ হতো।পাঁচিলের ধারে একটা কোণ একটু খুঁড়ে কি সুন্দর হলুদ বার করে নিতো ওরা।পরবর্তীতে যতবার পড়েছি "হলুদ বনে বনে/নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে/সুখ নাই কো মনে",আমার শুধু মনে হয়েছে ঐ কোণে হলুদ গাছগুলোর আশেপাশে আমার কি যেন একটা লুকিয়ে আছে…আজও খুঁজে পাইনি…

    বাড়ির গেটের বাইরে চওড়া রাস্তা ছড়ানো।হাওয়া দিলে ধুলো ওড়ে। শুকনো পাতায় উঠোন ভরে যায়।রাস্তা দিয়ে ডানদিকে হেঁটে গিয়ে একটা পার্কে পৌঁছনো যায়।মা-বাবা নিয়ে যায় সেখানে মাঝে মাঝে।দোলনায় চড়ি,ঢেঁকিতে চড়ি।স্লিপে চড়ার সাহস পাই না…।গেটের সামনের রাস্তা পেরিয়ে রেলওয়ের ফাঁকা জমির ওপাশে সত্যি সত্যি রেললাইন।ট্রেনের শব্দ শুনলেই ছুট্টে চলে যাই গেটের কাছে।লোহার গ্রীল ধরে দেখি ঢিমে তালে চলে যাচ্ছে মালগাড়ি…কি জানি কি আছে ঐ বন্ধ কামরাগুলোয়…

    আমাকে দেখাশোনা করে বুড়িদি।দুপুরবেলায় আমায় ঘুম পাড়িয়ে গেটের বাইরে চলে যায় ও।গেটের বাইরে রাস্তার ধারে বিশাল একটা গাছ…তার গোড়ায় গোল করে বাঁধানো বসবার জায়গা। ওখানে বড়ো ছেলেরা আড্ডা দেয়।বুড়িদি দুপুর কাটায় সেই খানে।আমার ঘুম ভাঙে একলা ঘরে।খাট থেকে নেমে গেটের কাছে দাঁড়াই।বুড়িদি তখন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে কোনো ছেলের গায়ে।

    পিন্টুদা আমার চেয়ে আড়াই-তিন বছরের বড়ো।ভীষণ বিচ্ছু।আমার মাসতুতো দাদা হীরক আসলেই পিন্টুদার সাথে খুব খেলাধূলা করে।ওরা ফুটবল খেলে।গেটের গ্রীলে চড়ে দোল খায়।পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বসে পড়ে পা দুলায়।প্যান্ট না খুলেই হিসু করে দেওয়ালে ছবি আঁকে।আমি ছোট বলে আমায় খেলায় নেয় না ওরা।আমারও ভারী ইচ্ছে করে ওরকমভাবে দেওয়ালে ছবি আঁকতে।আমি একা একা চেষ্টা করি।আমার সুন্দর ব্যাগি জিন্সটা ভিজে যায়।মা কান টেনে ধরে পিঠে দুমদুম কিল কষায়।

    মা ছুটির দুপুরে ফিলিপসের টেপরেকর্ডারটা নিয়ে বসে।তাতে ব্ল্যাংক ক্যাসেট ভরে রেকর্ড করে আমাদের ছোটবেলা।হীরকদা ছটফট করে,"মাসি, মাসি,আমি একটা ছড়া বলবো?"বলেই শুরু করে,"তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে…"।মা গেয়ে ওঠে,"আমারও পরাণ যাহা চায়…"।বাবা কবিতা বলে,"সোনার চাঁপা,সোনার বরণ…"।'চ' আর 'স' এর উচ্চারণ গা ঘেঁষে বসে থাকে।আমি আধো আধো ভাঙা ভাঙা স্বরে গল্প শুরু করি,"এত্তা পাতাআআআ…এত্তা বনের মদ্দে এদ্দিন উত্তে উত্তে উত্তে…"।গল্পের মাঝে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যায়।আমার বাকি গল্পটা ঢেকে দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায় যে পথে পাতাটাও একা একা উড়ে চলে গেছে…
  • Sanchayita Biswas | ২৮ জুন ২০১৭ ০৬:৩৫366086
  • ২৪।
    মুহূর্তগুলো কিরকম অগোছালো হয়ে কাছে আসে।মিশ খায় না একে অপরের সাথে…তবু এই মুহূর্তটার পাশেই বহুবছর আগের একটা মুহূর্ত বসে থাকে।এ ভারী অদ্ভুত একটা সিনেমা।এই যে কম্বলের তলায় শুয়ে পা গরম করার চেষ্টা করছি,কোথা থেকে মহম্মদ রফির গলা ভেসে আসছে,"উচাটন মন ঘরে রয় না…"।আমি দেখতে পাচ্ছি,ফিলিপসের টেপরেকর্ডারটা কামরাঘরের রংচটা লাল মেঝেতে রাখা আছে…বাবা পাশে বসে আছে…একটা পা ভাঁজ করা,আরেকটা ছড়ানো…আমাদের স্কুলে পরার জুতো,বাবার দশ নম্বরী বাটা কোম্পানীর স্যু স্তূপ করে রাখা পাশে…সারা সপ্তাহের ধুলো তাদের গায়ে…বাবা চেরী ব্লসমের কৌটো আর জুতো পরিষ্কারের ব্রাশ নিয়ে বসেছে…পরিপাটি ঝকঝকে হয়ে উঠছে জুতোগুলো…দুপুরের রোদ লুটিয়ে পড়েছে মেঝে থেকে টেপরেকর্ডার পর্যন্ত…পরবর্তী গান শুরু হয়েছে "এখনি বিদায় বোলো না…"

    আমার সহকর্মী লতিফ স্যরের বড়ো নাতনীটা গতকাল হোস্টেলে চলে গেছে।এই বাচ্চাটি ওনার বড়ো আদরের।বছর এগারোর মেয়েটা পরশুরাতেও গলা জড়িয়ে শুয়েছে ঠাকুরদার।স্যর স্কুলের বারান্দায় বসে মিড-ডে মিলের খাতা তৈরী করতে করতে বলছিলেন আল-আমিন মিশনের সুব্যবস্থার কথা।জিগ্যেস করলাম,"কবে ফিরবে নাতনী বাড়িতে?"উনি বললেন,"তিন মাস পর।"স্যর নিজের মনেই বলে চলেন,"মেয়েটার শোয়া বড্ড খারাপ।দেওয়ালের দিকের খাট দিলে ভালো হয়।পড়ে টরে না যায়।…রাস্তায় বেরোলেই কত কি চায় 'দাদু,এইটা কিনে দাও' 'ওটা চাই'।…এতো মাংস খেতে ভালবাসে…।"স্যরকে শুধোলাম,"কাল চলে আসার সময় দেখা করতে দিলো ওর সাথে?"উনি কলম নামিয়ে মাঠের দিকে তাকালেন।অসহ্য সুন্দর হলুদ একটা দুপুর।স্যর নীচু গলায় বললেন,"আমিই দেখা করিনি।"দু'ফোঁটা জল চিকচিক করছে বৃদ্ধের চোখে।আমি দেখতে পাচ্ছি একটা ভিজিটর্স রুম।ছোট্ট আমি দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে।হোস্টেল জীবনের প্রথম শণিবার।অনেক মানুষের ভিড়ে আমি বাবাকে খুঁজছি।মনে মনে ভয়,বাবা যদি না আসে…যদি আমায় ভুলে গিয়ে অফিস থেকে বাড়ি চলে যায় সটান…।আমার কান্না পাচ্ছে।চোখের জলে দেখতে পাচ্ছি না কাউকে।সবাই তাকাচ্ছে আমার দিকে।"মামন",বাবার কন্ঠস্বর শুনে দৌঁড়চ্ছি সেই দিকে।জাপটে ধরেছি উঁচু-লম্বা মানুষটার কোমর,"আমায় বাড়ি নিয়ে চলো।আমি থাকবো না এখানে।"ভেউভেউ করে কাঁদছি।বাবা সামলানোর চেষ্টা করছে।আমি আবিষ্কার করছি,আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক এই প্রথম বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম যেমন করে সবসময় মাকে জড়িয়ে ধরতে পারি…

    চন্ডীপুর পঞ্চায়েত অফিসের সামনে অটোটা থেমেছে।আমার পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা নেমে গেলেন।অটোর পাশে বিশাল একটা গাছ… গুঁড়ি দেখে মনে হলো মেহগনি।গাছের কান্ডে একটা বড়ো লাল টিপ আটকানো।হয়তো আশেপাশের বাড়ির কোনো বৌ দুপুরের স্নান শেষে ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল কারো সাথে…ক্রিম মাখা কপাল থেকে খুলে এসেছিল টিপটা…কৌতুকচ্ছলে আটকে দিয়েছে গাছের গায়ে।মনে মনে এরকমই গল্প বানাতে বানাতে এগিয়ে যাই গাছটা ছেড়ে…সোজা পৌঁছে যাই মায়ের পুরোনো ড্রেসিং টেবিলটার সামনে।সরু লম্বা আয়নার দু'পাশে পেখম মেলে আছে দুটো কাঠের ময়ূর।দেড়শো টাকায় কেনা সস্তা কাঠের তৈরী ড্রেসিং টেবিল।ঘুন ধরে গেছে একটা ময়ূর আর একটা পায়ায়।নিস্তব্ধ সময়ে 'কিরকিট কিরকিট' আওয়াজ শোনা যায়।কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে থাকে অসমান মেঝে জুড়ে।মা স্কুল থেকে ফিরে বামদিকের ময়ূরটার গায়ে আটকে রাখে লাল বড়ো টিপখানা।টিপের পাশে টিপ জমে জমে আঠালো হয়ে যায় ময়ূরের পেখম।হাত দিলে চিটচিটে হয়ে যায় আঙুল।আমি অটোয় বসে বুড়ো আঙুলে প্রথমা ছোঁয়াই।মসৃন আঙুলে চিটচিটে মুহূর্ত আটকেই থাকে।…
  • Suhasini | 213.99.***.*** | ২৮ জুন ২০১৭ ১১:৩৫366087
  • হোস্টেল জীবনের শনি-রোববার… কী যে বোরিং ছিল। কোনও ভিজিটর নেই, সচেতনভাবে মিস করেছি এমনও নয়। তবে কেমন করে জানি একবার হয় হপ্তায় আসা রুমির দাদার সামনে বলে ফেললাম, আমার দাদাও নেই তাই ভিজিটরও নেই। যদিও তারপর থেকে টুটুল দা আমারও দাদা… তবুও…
  • Sanchayita Biswas | ৩০ জুন ২০১৭ ১৯:৪৮366089
  • ২৫।
    নিজের মতো একটা কোণ খুঁজে নেওয়াটা আমার ছোটবেলার অভ্যেস।বড়ো খাটে আমরা চারটে মানুষ শুতাম আড়াআড়ি।বাবা আর মায়ের মাঝে ভাই,আমি খাটের কোণে কোলবালিশ জড়িয়ে মায়ের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমোতাম।মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসা হতো তখন।আমি খুঁজে-বেছে আলমারীর পাশের কোণটাকে স্থায়ী আসন বানিয়ে ফেললাম।স্কুলে ছয়জন করে বসতাম একেকটা বেঞ্চে।বেঞ্চের একটা কোণ আমার বরাদ্দ।ঐ কোণটা ভরে থাকতো আমার সই আর আমার আঁকা ছবিতে।প্রতিবার নতুন ক্লাসে ওঠার সময় মনখারাপ হতো ঐ কোণটুকুর জন্যে।মার্কশিট হাতে নিয়ে শেষবার হাত বুলোতাম কোণটাতে।পরের দিন থেকে নতুন ঘরে খুঁজে নিতাম নতুন একটা কোণা…

    আমি চিরকালই মুখচোরা।নিজে থেকে কারো সাথে মিশতে পারি না।নতুন কারো সাথে আলাপের পর্ব এলেই আমার অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।'ভালো আছেন','কোত্থেকে আসছেন','আবহাওয়াটা বেশ ভাল'…এরপর কি বললে ভালো হয়?!আমি মনে মনে মাথা চুলকোই…কথা খুঁজি এদিক ওদিক তাকিয়ে…মুখে বোকা বোকা একটা হাসি টেনে রাখি! কেউ আমার সাথে নিজে থেকে আলাপ করলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।এই যে কেয়াদি বাংলাদেশ থেকে প্রতিবার এসে অচেনা-অজানা আমাকে কি আদর করে জড়িয়ে ধরেন,এটা যে আমার কি প্রচন্ড ভালো লাগে সে কথা কি করে বোঝাই!আমার সাথে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন উনি।আমার কিন্তু একটুও অাড়ষ্ট লাগে না সেই সময়!কেয়াদি বাটা থেকে পান বার করে মুখে দেন আর গুটুরগুটুর করে গল্প করেন আমার সাথে…দুপুর গড়াতে গড়াতে বিকেল হয়ে যায়…

    আমি এই একাকী কোণটুকু স্কুল থেকে ব্যাগে পুরে কলেজে নিয়ে গিয়েছি…কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে।সতেরো নম্বর রুমের কোণের ডেস্কটায় বসে নোটস্ খাতা ভরে ফেলেছি চকরাবকরা প্যাটার্ণে।'রেপ অফ দ্য লক' বা 'প্যারাডাইস লস্ট' খায় না মাথায় মাখে, কি জানি!এক বিন্দুও তো শুনিনি!ঐ যে গল্প করছে মধুরা-সায়ন্তনী-সমীহা-সংযুক্তা…হো হো করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে সৃজিতা-নীলাঞ্জনা-রুচিরা…লিটেরারি ডিসকাশনে ব্যস্ত জয়িতা-অতসী-রশ্মি-সাহিলা…নাটকের পরিকল্পনা করছে শ্রীয়া-উদিতা-সম্রাজ্ঞী…মানালি কি যেন একটা জিগ্যেস করছে আমায়…দুইখানা অমৃতার অনর্গল বকবকানিতে মানালির মৃদুস্বর আমার কানে পৌঁছচ্ছে না…আমি নোটস্ করার মোটা ডায়রিতে জানুয়ারীর নয় তারিখটা অলংকরণ করেই চলেছি নীল কালিতে…

    আমার বেশ মনে আছে শরণ্যের পাশে বসেছিলাম ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনটায়।আমার পাশে বসা মানালি ফিসফিস করে বলছে,"তোর পাশে যে ছেলেটা বসেছে না,ও কিন্তু জুয়েল।দারুন রেজাল্ট করেছে অনার্সে!"ওরে বাবা,বলে কি!মানালিও ইউনিভার্সিটি টপার!দুই নক্ষত্রের মাঝখানে কালিপড়া হ্যারিকেনের মতো বসে আছি!আমি মনে মনে আমার প্রিয় কোণটুকুকে খুঁজতে থাকি।…

    ২৬বি ঘরটা আমার ভীষণ প্রিয়।মাঝের রো'এর শেষের দিক থেকে পাঁচ নম্বর বেঞ্চের কোণটুকু আমার!আমার পাশে সুবর্ণা-দীপমালা-সঞ্চিতা-পূর্ণেন্দু-নীপারা বসে প্রায়ই।জয়েন্ট ক্লাসগুলোতে 'এ' সেকশন থেকে মানালিও আসে।সন্দীপন রোজ প্রথম ক্লাসটার শেষে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে জায়গা করে নেয় আমাদের মাঝে।সামনের বেঞ্চে গোটা কলেজ স্ট্রীটখানা পড়তে থাকে কোয়েল।ওর পাশে বসে থাকে তৃষা-স্বাতীরা।পাশের রো'তে আড্ডা জমায় গার্গী-শ্রাবস্তী-অরিত্র-শুভংকর-দীপ্তার্ক।সন্দীপণ প্রায়ই শ্রাবস্তীকে খেপায়,"তোর হাসিটা না একদম শিল্পা শেঠীর মতো!"আমি বহুদিন অবধি ফুকোকে 'ফকাল্ট' আর মমকে 'মঘ্যাম' উচ্চারণ করি।গম্ভীর গম্ভীর শুভংকরকে দেখিয়ে সন্দীপন ফিসফিস করে,"এই ছেলেটা কিন্তু হেব্বি জ্ঞানী।জানিস,কবিতা লেখে আর ই-ম্যাগ বার করে।"ডায়াসে অধ্যাপিকা কৃষ্ণা সেন দেরিদা পড়ান…ওনার অসামান্য প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে সবাই একমনে শুনতে থাকে ওনার লেকচার…প্রাগৈতিহাসিক ফ্যানগুলোর উথালিপাথালি হাওয়ায় উড়তে চায় সাদা পাতাগুলো…বাইরে বাসের বিদঘুটে আওয়াজে চাপা পড়ে যায় বক্তৃতার অংশবিশেষ…জানলার ওপাশে বিশাল রাধাচূড়া গাছটা হলদে হয়ে থাকে পপকর্ণ আকারের ফুলে…বিবর্ণ আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে মেডিকেল কলেজের লাল ইটগুলো জেগে থাকে…বেঞ্চে আমার কোণটা ভরে ওঠে অপাংক্তেয় গ্রাফিতিতে…
  • Sanchayita Biswas | ১৪ জুলাই ২০১৭ ০৭:০৪366090
  • ২৬।
    দৃশ্যটা এখনো মনে পড়ে।শোবারঘরে টিভি চলছে।মাকে লুকিয়ে স্টোভের পাশ থেকে দেশলাই বাক্স নিয়ে এসেছি।কাঠি বার করে বাক্সের গায়ে মায়ের কায়দায় ঠুকছি।মা তো এক ঠোকরেই জ্বালিয়ে ফেলে দেশলাইটা।আমারটা জ্বললো না কেন!?আমি বারবার ঠুকি।কচি কচি আঙুলে বারুদের গন্ধ লেগে যায়।তারপর একসময় দপ্ করে জ্বলে ওঠে কাঠি।ছ্যাঁকা খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই সেটাকে, "মা গোওও।"মা ছুটে আসে আমার চিৎকারে।লাল হয়ে গেছে নরম চামড়া…চিড়বিড় করছে। জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম আমি ভয় পাই।

    বাবার সাথে প্রতি রোববার বাজারে যাই।সারথি ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই বাজার।ওই রাস্তার গায়ে বিশাল উঁচু ড্রেন…ফ্রকপরা আমার চেয়েও উঁচু।কালো কালো ময়লা সুতোর মতো আটকে থাকে ওর গায়ে।হালকা স্রোত বয়ে যায় শ্যাতলারঙা জলে।কে যেন বলেছিল,এই ড্রেনটা নাকি নদীতে মিশেছে!আমার সবসময় মনে হয়, আমি ওতে পড়ে যাবো…স্রোতে ভেসে নদীতে ডুবে যাবো…কেউ আমায় খুঁজে পাবে না!…আমি বাবার হাত খামচে ধরি রাস্তার ওই বাঁকে।

    সপ্তাহে দুই দিন বিকেলে সন্তোষ কাকুর কাছে কত্থক শিখতে যাই।সুন্দরীদিদিদের গলি পেরিয়ে বুলুদিদিদের উঠোনের ওপর দিয়ে পুলিশের বাড়ির পেছন ঘুরে আমরুল শাকভরা গলির মধ্যে দিয়ে বাজারের পেছনদিকের মজাপুকুরের গা দিয়ে সন্তোষকাকুর বাড়ি পৌঁছোই।আমার সাথে মিমি-মমি থাকে।ফেরার সময় আঁধার নেমে যায় বলে ওই পথে ফেরা বারণ।তখন বাজারের পথ ধরতে হয়।আলো ঝলমলে বাজারের শেষে ফ্রিজ সারাইয়ের দোকান।অধিকাংশ সন্ধ্যেতে তা বন্ধ থাকে।দোকানের উল্টোদিকে কাদের যেন পাঁচিলঘেরা আম-কাঁঠালের বাগান।দিনের বেলা লোভী চোখে তাকাই ফলগাছের দিকে।সন্ধ্যার আঁধারে চোখ বুজে বাগান পেরোই।মনে হয়,চোখ খুললেই আমগাছের ডালে কাউকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখবো!মিমি-মমি দুই বোনে হাত ধরাধরি করে পার হয় বাগান।আমি ওদের পেছন পেছন বিড়বিড় করতে করতে আসি,"ভূত আমার পুত/পেত্নী আমার ঝি/রাম-লক্ষ্মণ সাথে আছে/করবি আমায় কি!"

    আমাদের বাসাবাড়ির বাথরুমটা অন্ধকার।দেওয়ালটা হয়তো কোনো একসময়ে হলুদ ছিল।এখন কি রং তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।আমি স্নান করতে গিয়ে দেওয়ালে ছবি খুঁজি রোজ। একটা বেড়াল…গনেশ…ত্রিশূল…।প্রতি চৈত্রমাসে বাবা তরমুজ এনে বাথরুমের চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে দেয়।আবছা অন্ধকারে আমার মনে হয় জলে কিসের মাথা ভাসছে!আমি ভয়ে বাথরুমে যাই না।কালো স্যাঁতসেঁতে জায়গা বলে বাথরুম ভরে থাকে বড়ো বড়ো থাবার মতো মাকড়শায়।ঘুলঘুলি থেকে আসা সামান্য আলোতে সেগুলো আরো বিকটদর্শন হয়ে যায়।আমার গা ঘিনঘিন করে।বাথরুমে ঢোকার আগে বাবাকে বিরক্ত করে মারি মাকড়শা তাড়াবার জন্য।

    সন্ধ্যে দিতে গিয়ে রোজ দেশলাই নিই তাক থেকে।কাঠি বার করে বাক্সটা একটু দূরে ধরে ঠুকঠুক করে বাক্সের গায়ে ঘষি।কখনোই একবারে জ্বালাতে পারি না।অধিকাংশ সময়েই কাঠি ভেঙে যায়।তারপর একসময় ফস্ করে আগুন জ্বলে ওঠে।ছ্যাঁকা খাওয়ার আগে ধূপ জ্বালিয়ে ফেলার চেষ্টা করি।তবুও হাতে টাটকা বারুদগন্ধ লেগে থাকে…প্রথমবারের মতো!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন