ব্যঙ্গাত্মক গল্প
গোগোল: শিক্ষামন্ত্রীর বিদ্যার গোডাউন
কলমে : শংকর হালদার শৈলবালা
গল্পের শ্রেণী : রূপক বা অ্যালেগরি (Allegory), ব্যঙ্গাত্মক বা স্যাটায়ার (Satire) ও উপদেশ মূলক বা নৈতিক গল্প (Moral Tale)
একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে, নতুন শিক্ষামন্ত্রী এলেন। তিনি প্রযুক্তি এবং ডেটার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। তিনি ঘোষণা করলেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন থেকে ডেটা-চালিত হবে। জ্ঞান একটি পণ্য, আর তা পরিমাপ করা হবে গোডাউনের হিসাবে। যে স্কুলের গোডাউনে যত বেশি নম্বর জমা হবে, সেই স্কুল তত বেশি উন্নত।”
মুখ্যমন্ত্রী এই কথা শুনে চিন্তিত হলেন। তিনি তাঁর সবচেয়ে বুদ্ধিমান পরামর্শদাতা গোগোলকে ডেকে পাঠালেন। গোগোল একজন তরুণ, টেক-স্যাভি এবং প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন।
শিক্ষামন্ত্রী গোগোলকে বললেন, “গোগোল, তুমি তো সবকিছুর মধ্যে রহস্য খুঁজে বের করো। বলো তো, আমাদের রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা কেন এত ভালো রেজাল্ট করেও চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে?”
গোগোল মুচকি হেসে তাঁর ল্যাপটপটি খুললেন। তাতে একটি প্রেজেন্টেশন ফাইল ছিল। তিনি বললেন, “স্যার, একটি গল্প বলি। এক ডেটা সায়েন্টিস্ট ছিলেন। তিনি একটি নতুন অ্যাপ তৈরি করলেন, যার নাম 'জ্ঞান অ্যাপ'। এই অ্যাপের কাজ ছিল শুধু নম্বর সংগ্রহ করা। যিনি যত বেশি নম্বর সংগ্রহ করবেন, তিনি তত জ্ঞানী। কিন্তু আসল জ্ঞান বা সৃজনশীলতা, যা দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা যায়, তার কোনো পরিমাপ ছিল না। ফলে সবাই নম্বর সংগ্রহের জন্য রাতদিন মুখস্থ করতে লাগল, কিন্তু নতুন কিছু শেখা বা তৈরি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।”
গোগোলের গল্প শুনে শিক্ষামন্ত্রী বিরক্ত হলেন। বললেন, “গোগোল, তুমি আমার পরিকল্পনার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?”
গোগোল শান্তভাবে বললেন, “ঠাট্টা নয় স্যার, উপমা। আপনি শিক্ষার জন্য 'গোডাউন' বানাচ্ছেন, অর্থাৎ আপনি চাইছেন শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থ বিদ্যাকে মস্তিষ্কের মেমোরিতে জমা করুক এবং পরীক্ষার খাতায় তা আপলোড করে দিক। কিন্তু জ্ঞান তো আর মেমোরি চিপ নয়, এটি হলো মানুষের মনকে প্রজ্বলিত করা এক প্রক্রিয়া।”
গোগোল তাঁর প্রেজেন্টেশনের একটি স্লাইড দেখালেন, যেখানে একটি উজ্জ্বল বাল্বের ছবি ছিল। স্লাইডের ক্যাপশন ছিল, "জ্ঞান হলো আলো, ডেটা নয়।" তিনি বললেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন সেই ডেটা সায়েন্টিস্টের অ্যাপের মতো। আমরা কেবল নম্বর, জিপিএ (GPA) এবং পাশের হারের ডেটা নিয়ে ব্যস্ত। আমরা ভুলে গেছি যে, প্রকৃত জ্ঞান হলো উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা। ছাত্রছাত্রীরা জানে, তাদের সৃজনশীলতা বা গভীর ভাবনাকে মূল্যায়ন করা হবে না, শুধু মুখস্থ করা তথ্যকেই নম্বর দেওয়া হবে। ফলে, তারা শুধু 'নম্বর সংগ্রহের খেলায়' মত্ত থাকে। আর এই কারণেই তারা ভালো রেজাল্ট করেও বাস্তব জীবনে পিছিয়ে পড়ছে।”
মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী দুজনেই নীরব। গোগোল তার ল্যাপটপটি বন্ধ করে বললেন, “স্যার, আপনি গোডাউন বানাতে পারেন, কিন্তু তাতে যদি প্রকৃত জ্ঞান না থাকে, তাহলে তা কেবল একটি খালি গুদাম। আলো না থাকলে তা দিয়ে কিছু দেখা যায় না।”
গোগোলের এই কথায় মুখ্যমন্ত্রীর চোখ খুললো। তিনি গোগোলের বুদ্ধির তারিফ করলেন এবং নতুন করে শিক্ষানীতি সংস্কারের নির্দেশ দিলেন। এরপর থেকে শুধু নম্বর নয়, সৃজনশীলতা, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষা এবং বাস্তব দক্ষতাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হলো। এভাবেই আধুনিক যুগের গোগোল প্রমাণ করলেন, জ্ঞান কোনো ডেটা নয়, তা মানুষের মন ও আত্মায় প্রজ্বলিত এক শিখা।
~~~~~~~~~~~~~~~
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।