পরদিন সকালে সত্য আসতে শরীরটা কোনও ক্রমে তুলে গাড়িতে গিয়ে বসলো ফুলকি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাঁর মনে হলো বাড়ি না ফিরে অফিসে যাই। সত্যকে সে তাই বলল। ফেরার সময় যে সুভাষ নেই, শত কষ্টের মধ্যেও এটা তাঁকে একটা তৃপ্তি দিচ্ছে। সে মনে করতে পারলো না, কখনই সুভাষের সান্নিধ্য তাঁকে আনন্দ দিয়েছে কিনা!! অফিসে তাঁকে দেখে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বস্ বললেন “এই শরীরে অফিসে আসার কি দরকার ছিল?” সে কি বলবে অফিস তো তাঁর একটু বেশি নিজের জায়গা। সে এক কাপ চা খেল।
হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ হতে আরম্ভ করলো। সে যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না!! সমস্ত শরীর ভেঙে চুরে আসছে যন্ত্রণায়, মাথা ঘুরছে, এসি তেও ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। পেটে অসম্ভব ব্যথা করছে, কেউ যেন পেটে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে। সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
যখন তাঁর জ্ঞান ফিরলো তখন সে হাসপাতালে। অনেক গুলো অচেনা মুখ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। সে টুম্পা ও তাঁর নিজের মা কে খুঁজলো, পেলো না !! স্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ধীরে ধীরে সে মনে হয় আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। তাঁর বাবার মুখ ভেসে উঠছে। দাদু তাঁকে ডাকছে। সে কি তাঁরা তো আর নেই!!! তাহলে এই যে অস্পষ্ট ছায়ার মতো তাঁদের দেখা যাচ্ছে। তাঁরা বলছে “ যেই যা বলুক, আমরা জানি তুমি আমাদের বড় আদরের মেয়ে আর তুমি খুব ভালো “!! সে যেন জলের মধ্যে ডুবে যেতে লাগলো!! তাও তাঁর একটু আনন্দ হলো যে যাই বলুক দাদু আর বাবা তাঁকে ভালো বলেছে,এতেই শান্তি। সে সত্যিই ডুবে গেল।
ডাক্তাররা বাইরে এসে বললেন “She is no more”। ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো ফুলকির মা!! তার মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো ছিল। ফুলকির মা কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে গেলেন, মেয়ের কাছে। শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কোনও কষ্ট পেয়েছে মনেই হচ্ছে না!! তিনি কাঁদতে কাঁদতে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, আর কামনা করলেন এ রকম মেয়েই যেন তার পরের জন্মে হয় !!!
সুভাষ এলো,ওর দিকে তাকাতে পারছেন না ফুলকির মা, কি কষ্টই না করেছে ছেলেটি..... সম্বন্ধ করে বিয়ে দিলেও এ রকম ছেলে আর পাওয়া যাবে না। ফুলকির মা কে সে নিয়ে গেল হাসপাতালের বাইরে। বলল একটা গাড়ি করে রেখেছি আপনারা সব বাসায় ফিরে যান। একই গাড়িতে তিনি ফুলকির বড় ননদ ও আরও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে লাগলেন চোখের জল ফেলতে ফেলতে। তিনি কি তখন জানতেন যে এটাই তার ফুলকিকে শেষ দেখা !!!
ফুলকির বন্ধুরাও জানলো না। একমাত্র ফেসবুক আর হোযাটসঅ্যাপ এর স্ট্যাটাস ছাড়া। ফুলকির মা ওরা চলে গেলে, কাগজ পত্র সব ঠিকঠাক করে সুভাষ ও তার বন্ধুরা ফুলকিকে নিয়ে শশান ঘাটে নিয়ে এলো। ফুলকি আর জানতেও পারবে না যে তাঁর ইচ্ছে মত বেনারসী শাড়ি পড়িয়ে ফুল দিয়ে ঢেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয় নি। সমস্ত আয়োজন বাদ দিয়ে, অত্যন্ত সাদামাটা ভাবেই ইলেকট্রিক চুল্লি তে তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ৪৫ মিনিট গোটা ১০ শশান যাত্রীর কাছে তার পরিশ্রম ও মানসিক চাপের ফর্দ দিয়ে গেল সুভাষ। আর একটি গুরুত্বপুর্ন কাজ সে করেছে এই সময়ে, সে ফেবুতে সব পোস্টের জবাব দিয়েছে। WhatsApp এর উত্তর ও দিয়েছে। শশানের কাজ শেষ করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরল তারা। টুম্পা মধ্যপ্রদেশের এক শহরে খবরটা পেল রাত্রি ৯টা নাগাদ। তারপর থেকে একটানা কেঁদেই চলেছে সে, তার বর ও ছেলে অনেক স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করেও বিফল হলেন। টুম্পার ছোটবেলার ঘটনা গুলো চোখের উপর ভেসে উঠছে। শুধু তার মনে হচ্ছে এই সংসারের জন্যই সে ফুলকিকে শেষবারের মতো দেখতে পেলো না !!
কাগজপত্র সব ঠিকই রেখেছিল সুভাষ, এত ঝামেলার মধ্যেও কোনও ভুল হয়নি। নিজেকে বাহবা দিল সে। শ্রাদ্ধের সব ব্যবস্থা করেই সে ফুলকির অফিসে গেল। সবাইকে সপরিবারে নিমন্ত্রন করে, বস্ এর কাছে সব কাগজ পত্র জমা দিল। বস্ বললেন সামনের সপ্তাহে এসে খবর নিতে। খুশি মনে চলে এলো সে, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি, পেনশন টা বেশ মোটাই পাওয়া যাবে। এবার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি টা নিয়ে পরতে হবে।
ফুলকির মৃত্যুর মাস তিনেক পরে সুভাষের পেনশন চালু হয়ে গেল। সঙ্গে ইন্সুরেন্স থেকেও মোটা অংকের টাকা পাওয়া গেল। ফুলকির রেখে যাওয়া সোনার গয়না তো আছেই। এক বন্ধু তাকে আবার বিয়ের পরামর্শ দিলো, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। কিছুটা ধীরে পা ফেলতে হবে। সে বিশ্রাম নিতে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে চলে গেল সঙ্গী কয়েকজন বন্ধু।