বিদ্যাসাগরের 'শ্লোকমঞ্জরী' বেরল ১৮৯০ সালের মে-মাসে। 'শ্লোক- মঞ্জরী'তে বিদ্যাসাগর সাকুল্যে দুশো-তেরোটি উদ্ভট শ্লোক সঙ্কলন করেছেন।
অনেক আগে বলা হয়েছে, গঙ্গাধর তর্কবাগীশের কাছে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েছেন ১৮২৯ সালের জুন থেকে ১৮৩৩ সালের জানুআরি পর্যন্ত।
উত্তরকালে বিদ্যাসাগর লিখেছেন:
"পূজ্যপাদ (গঙ্গাধর) তর্কবাগীশ নহাশয়, শেষ ছয় মাস, দৈনন্দিন অধ্যাপনাকাৰ্য্য সমাপ্ত হইলে পর, প্রত্যহ, এক একটি উদ্ভট শ্লোক লেখাইয়া, তাহার অর্থ বুঝাইয়া দিতেন। ঐ শ্লোকটি কণ্ঠস্থ করিয়া, আমাদিগকে, পর দিন, তাঁহার সমক্ষে, উহার আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা করিতে হইত। যদি আবৃত্তি বা ব্যাখ্যায় কোনও ব্যতিক্রম লক্ষিত হইত, তিনি তাহার সংশোধন করিয়া দিতেন। এই রূপে, ছয় মাস, আমরা প্রত্যহ এক একটি উদ্ভট শ্লোক কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম।
উদ্ভটশ্লোকশিক্ষা বিষয়ে আমার সবিশেষ অভিনিবেশ দেখিয়া, পূজ্যপাদ তর্কবাগীশ মহাশয় সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। আমি সাহিত্যশ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইবার পর, তিনি আমায় বলিয়া দিয়াছিলেন, প্রত্যহ না পার, মধ্যে মধ্যে আমার নিকটে আসিয়া, উদ্ভট শ্লোক লিখিয়া লইয়া যাইবে। তদীয় এই সদয় আদেশ অনুসারে, সাহিত্যশ্রেণীতে অধ্যয়নকালে, মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকটে গিয়া, উদ্ভট শ্লোক লিখিয়া আনিতাম। এইরূপে, দয়াময় তর্কবাগীশ মহাশয়ের প্রসাদে, দুই শতের অধিক শ্লোক সংগৃহীত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতিরিক্ত, পরম পূজ্যপাদ পিতৃদেবের ও অন্যান্য ব্যক্তির নিকট হইতে, ক্রমে ক্রমে, প্রায় তিন শত শ্লোকের সংগ্রহ করিয়াছিলাম।"
উদ্ভট শ্লোক কাকে বলে? বিদ্যাসাগর লিখেছেন: "যে সকল শ্লোক কোনও গ্রন্থের অন্তর্ভূত নহে, উহারাই উদ্ভট শব্দে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে।"
'শ্লোকমঞ্জরী'র পরিশিষ্টভাগে বিদ্যাসাগর কয়েকটি আদিরসাশ্লিষ্ট শ্লোক সন্নিবেশিত করেছেন। কোনো-কোনো শ্লোকে বিদ্যাসাগর পাদটীকা যোগ করেছেন। একটি শ্লোকের (তব তন্বি কুচাবেতৌ নিয়তং চক্রবর্ত্তিনো। আসমুদ্রকরগ্রাহী ভবান্ যত্র করপ্রদঃ।।) বিদ্যাসাগর কৃত পাদটীকা উদ্ধৃত করি:
"এই শ্লোক সংক্রান্ত কিংবদন্তী সংক্ষেপে নির্দিষ্ট হইতেছে।
কালিদাসের আরাধনায় প্রসন্ন হইয়া, সরস্বতী দেবী তাঁহার সম্মুখে আবির্ভূত হইলে, প্রভূত ভক্তিযোগ সহকারে বারংবার প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া, কালিদাস সরস্বতী দেবীর বর্ণনা করিলেন। এই বর্ণনা আরাধ্য দেবতার বর্ণনার অনুযায়িনী হয় নাই: সামান্য নায়িকাব বর্ণনা যে প্রণালীতে প্রণীত হইয়া থাকে, তদনুযায়ী হইয়াছিল। এজন্য সরস্বতী দেবী সাতিশয় অসন্তোষপ্রদর্শন পূর্বক বলিলেন, তুমি, সমান্য নায়িকার ন্যায় বর্ণনা করিযা, আমার অবমাননা করিলে। এই অপরাধে, সামানা নায়িকার হস্তে তোমার প্রাণান্ত ঘটিবেক।
রাজা বিক্রমাদিতোর রক্ষিতা এক বারবনিতা ছিল। রাজপ্রাসাদে এই বারবনিতার সুখ, সম্পত্তি, ও আধিপত্যের সীমা ছিল না। কালিদাস তাহার নিরতিশয় প্রণয়ভাজন ছিলেন: প্রত্যহ, গোপনে তাহার ভবনে গিয়া, আমোদ করিতেন। এক দিন, তিনি তাহার সহিত আমোদ করিতেছেন, এমন সময়ে রাজা বারবনিতার আবাসে উপস্থিত হইলেন। তদীয় আগমনবার্তা শ্রবণে, কালিদাস ও বারবনিতা উভয়ে ভয়ে অভিভূত ও যৎপরোনাস্তি ব্যতিব্যস্ত হইলেন। উপায়ান্তর দেখিতে না পাইয়া, অবশেষে কালিদাস পার্শ্ববর্তী গৃহে লুকাইয়া রহিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে রাজা বারবনিতার নিকটে উপস্থিত হইলে, উভয়ে, একাসনে আসীন হইয়া, ইষ্টালাপ করিতে লাগিলেন। রাজা, বারবনিতার স্তনে হস্তার্পণ করিয়া, বলিলেন,
"তব তন্বি কুচাবেতৌ নিয়তং চক্রবর্তিনো"।
রাজকৃত স্তনবর্ণনা শ্রবণবিবরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র, কালিদাস, এককালে বাহ্য- জ্ঞানশূন্য হইয়া, ঐ বর্ণনার সমর্থনার্থে বলিলেন,
"আসমুদ্রকরগ্রাহী ভবান্ যত্র করপ্রদঃ"।
রাজা, কালিদাসের স্বরশ্রবণ মাত্র, চকিত ও অতিমাত্র লজ্জিত হইলেন, এবং এ স্থানে কালিদাসের গতিবিধি আছে, ইহা বুঝিতে পারিয়া, ভয়ানক ঈর্ষ্যার আবির্ভাব বশতঃ, বারবনিতার উপর যংপরোনাস্তি রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইয়া, আজ অবধি আমি তোমার সংস্রবত্যাগ করিলাম, তাহাকে এই কথা বলিয়া, চলিয়া গেলেন। কালিদাসের নির্বুদ্ধিতা ও অবিমৃশ্যকারিতার জন্যে, আমি এ জন্মের মত রাজপ্রসাদে বঞ্চিত হইলাম, এই ভাবিয়া, ক্রোধে অন্ধ ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, বারবনিতা তৎক্ষণাৎ স্বহস্তে কালিদাসের মস্তকচ্ছেদন করিল। এই রূপে, সরস্বতীর অভিসম্পাতবাক্য সর্বতোভাবে কার্য্যে পর্য্যবসিত হইল।"