জাতীয় সঙ্গীত শুরু হলে ঋজু হয়ে যায় আমাদের
শিরদাঁড়া, আমরা সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ ছাড়ি। হতে পারে কারো কণ্ঠ সোচ্চার কারো বা অনুচ্চ, কেউ কেউ হয়ত শুধুই ঠোঁট নাড়ে কিন্তু গান করে সবারই হৃদয়। হয়ত সুর তান মেলেনা অনেকেরই কিন্তু হ্রদয় মিলে যায়। সে তখন না ব্রাহ্মণ, না যাদব, না দলিত। না হিন্দি ভাষী, না বাঙালি, না ওড়িয়া। না কংগ্রেস,না বিজেপি, না সিপিএম, না সিপিআই, না তৃণমূল, না ডট ডট ডট! ঠিক এই প্রথম স্বাধীনতার পর এই দেশ দেখছে সেই প্রাথমিক পরিচিতি, দ্য প্রাইম আইডেন্টিটি ফিকেশন, আমরা ভারতবাসী। আমরা কংগ্রেস বিজেপি সিপিএম তৃণমূল যাই হতে পারি, সেটা আমাদের আনুষঙ্গিক পরিচয়। মানুষের ওই সব বিশেষিকরণের বাইরেও আমাদের আরও একটা সাধারণ পরিচয়, আমরা ভারতীয়। সংবিধানের শুরুতেই যে কথা লেখা আছে, উই দ্য ইন্ডিয়ান!
২০২৪, ৯ আগষ্ট! আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই ভয়াবহ, কদর্য, নৃশংস ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ দেখছে সেই 'উই দ্য ইন্ডিয়ান' কে। বাংলার জুনিয়র ডাক্তাররা হারিয়েছেন তাঁদেরই এক সতীর্থকে। কী ভাবে হারিয়েছেন? ৩৬ ঘণ্টা তিনি একটানা চিকিৎসা করার পর নিজের হাসপাতালের সেমিনার রুমে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাঁকে খুন করে ধর্ষণ অথবা ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। তাঁর চোখ থেকে রক্ত উগরে এসেছে, তাঁর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। যদিও এই দেশ ও এই রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনা খুব একটা নতুন নয়। এই তো ক'দিন আগেই খোদ রামমন্দিরের এক সেবিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করেছে দুষ্কৃতীরা। এই হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী ও যোগী আদিত্যনাথের পবিত্র রামমন্দিরের নিরাপত্তা! উচ্চবর্ণ কিংবা নিম্নবর্ন দেশের কোন অংশে আজ নারী মৃগয়া সহজলভ্য নয়? মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মনিপুর কিংবা খোদ অমিত শাহ শাসিত পুলিশের দিল্লি, পরিসংখ্যান ভয়াবহ। কিন্তু তারও মধ্যে বাংলার আরজি কর কাণ্ডের এত ব্যপ্তি কেন? কারণ এই কাণ্ড বাংলার মানুষের একটা বোধকে, একটা ক্রোধকে সংঘটিত করেছে এবং তা'হল কেবলমাত্র নারী নয়, কেবলমাত্র চিকিৎসক নয়, নারী পুরুষ নির্বিশেষে যেখানে যে পেশায় যে আছে অথবা পেশাহীন সবার জন্যই পশ্চিমবঙ্গের শাসককুল এক দূর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেই দূর্বিসহ অবস্থায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে আর উল্টো দিকে শাসকের ঝান্ডা ধরে যা খুশি কর কেউ তোমার টিকি ছুঁতে পারবে না। তাকে দল কিছু বলবে না, প্রশাসন কিছু বলবে না, পুলিশ কিছু বলবে না। উল্টে এদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে শাসকদল, পুলিশ, প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়বে, জিনা হারাম করে দেবে।
কী রকম সেই অবস্থা! খোদ মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক জনসভা থেকে দলীয় নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধিকে বলছেন, "যা করেছ, করেছ। আমার কাছে সব খবর আছে। তোমার এত বড় বাড়ি হয় কী করে?এত কামানো ভালো নয়।" অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী জানেন তাঁর দলের নেতা কর্মীরা কোথায় কী করছেন? কিন্তু সেই অন্যায়ের কোনো শাস্তি নেই! মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, সব কাটমানি ফেরত দাও। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, কাটমানি নেওয়া হচ্ছে, আমফানের টাকা লুট হচ্ছে, আবাস যোজনার টাকা লুট হচ্ছে, সড়ক যোজনার টাকা লুট হচ্ছে, পাথর, ফোরাম, বালি, কয়লা, গরু পাচার সব সব হচ্ছে কিন্তু কোথাও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। উল্টে যাঁরা এসবের প্রতিবাদ করছেন বিপদ তাঁদের। প্রতিবাদী বরুন বিশ্বাস, তপন দত্তকে কারা হত্যা করেছে পুলিশ জানে কিন্তু বিচার পাননি তাঁদের পরিবার।
মানুষ দেখছে, তৃণমূলের একদা হাভাতে নেতা কর্মীদের গাড়ি বাড়ি চাকরি ঠিকাদারি সব হচ্ছে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। নেতার ছেলে মেয়ে বউ শালা শালি সরকারি চাকরি হাতিয়ে নিচ্ছে কিন্তু যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা চাকরির দাবিতে হাজার হাজার দিন ধরে রাস্তায় পড়ে ধর্না দিচ্ছেন! আরেক দিকে চলচ্চিত্র টেলি সিরিয়ালের কলাকুশলীরা দেখছেন স্টুডিও পাড়ার নেতৃত্বে যারা আছেন এবং তাদের পেয়ারের ডিরেক্টর প্রোডিউসারদের কিছু না দিয়ে কাজ পাওয়া যায় না। কাকে কী দিতে হয় তা কহতব্য নয়। কয়েকদিন আগেই স্টুডিও পাড়া শিল্পী কলাকুশলীদের ধর্মঘট দেখেছে এই কারণে। আমরা দেখেছি বাংলা আকাদেমি থেকে নন্দন কারা নিয়ন্ত্রণ করছে, কীভাবে করছে? মুখ্যমন্ত্রী কবিতার জন্য আকাদেমি পাচ্ছেন, সেরা গীতিকারের পুরষ্কার পাচ্ছেন। সরকারের পায়ে তেল মাখিয়ে শিল্প-সাহিত্যকে সরকারের ধামাধরা করা হচ্ছে। যাঁরা করছেন তাঁরা সরকারের বদান্যতা পাচ্ছেন যাঁরা তা করছেন না তাঁরা দূর হটো। নাট্য আকাদেমির ও অবস্থা তথৈবচ। সরকারের স্তাবক নাট্যদল অনুদান লুটছে। ছোট ছোট নাট্যদল গুলো ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার লড়াই করছে।
অন্যদিকে হাসপাতালের সাধারণ বেসরকারি আয়া, ফুটপাতের দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, অটো,টোটো, ট্যাক্সিওয়ালেদের শুধু কাটমানি দিয়ে কাজ কিংবা ঠিকাদারি, হকারি করার অনুমতি অথবা গাড়ি চালানোর পারমিট পেতে হয় তাই নয়, নিয়মিত তোলার জোগান দিতে হয়। তোলার জন্য একই শাসকদলের একাধিক ইউনিয়ন। ইউনিয়নের সদস্য হলে তবেই আয় করতে পারবেন আর আয় করলে আয়ের একটা অংশ তুলে দিতে হবে শাসকদলের নেতাদের।
এই সর্বস্তরের যন্ত্রনাই আজ ফেটে পড়ছে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে। কেউ নিজের জায়গায় হয়ত প্রতিবাদ জানাতে ভয় পাচ্ছেন কিন্তু আন্দোলনরত ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, চালিয়ে যাও আমরা আছি। ডাক্তাররা অবস্থান করছেন কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর ত্রিপল টাঙাতে আসছেন মানুষ। চিকিৎসকদের অবস্থানের আশেপাশের মানুষদের একটা বড় অংশ সারারাত ঘরের দরজা খোলা রেখেছেন, যদি কারও বাথরুমের প্রয়োজন হয়, ডাক্তারদের খাবার, ফল, পানীয় জোগান দিচ্ছেন দোকানদাররা, ভ্যাপসা গরমে তাঁদের জন্য শুধু হাতপাখাই আনেননি, নিজের হাতে পাখা করে দিচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা। তোমরা লড়ে যাও, আমরা আছি। ডাক্তারদের পাশে সর্বস্তরের মানুষ! কেন? নিজের প্রতি অবিচারের জবাব দিতে। এই আন্দোলন তাই এখন আর ডাক্তারদের আন্দোলন নয়, জনগণের আন্দোলন, গণ আন্দোলনে পরিণত। কারো হাতে ঝান্ডা নেই, রাজনৈতিক শ্লোগান নেই। শুধু একটাই ভাবনার শরিক সবাই, আমরাও তোমাদের মত বঞ্চনার শিকার, থ্রেট কালচারের শিকার। আমরাও বিদ্ধস্ত। আমরা ভারতীয়,আমরা বাঙালি, মোরা যাত্রী একই তরুণীর। এই বোধ এবং এই ক্রোধ দুই-ই পবিত্র।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।