এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একদিন আমি বিনা আন্দোলনেই রাত 'দখল' করেছিলাম, মানে মাঝরাত্তিরে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। কলকাতায় নয়, পোর্ট ব্লেয়ারে। রাত ১২টা থেকে দেড়টা দুটো পর্যন্ত। একাই। 

    Bhutanoya লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ আগস্ট ২০২৪ | ১৭২ বার পঠিত
  • পোর্ট ব্লেয়ার একটা বিচিত্র জায়গা। আন্দামান যতটা দেখলাম ততটা পুরোটাই। আন্দামানের আদিবাসীদের বসতি ছোট করে করে মূলবাসীদের বসতি হয়েছে। তাতে অবশ্য বিচিত্র কিছু নেই, ভারতে এই রীতি অনেক জায়গায়। তবে এই উচ্ছেদের অতীত-বর্তমান এই লেখার আলোচ্য নয়। বিচিত্র হচ্ছে আন্দামানের মূলবাসীরা, যাদের অধিকাংশই বাঙালী, অনেকে ১৯৭১এ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আসা, অনেকে পশ্চিমবঙ্গীয়। প্রথম চমকটা দিলেন এক পাঁপড় বিক্রেতা মহিলা। আন্দামানের এক দ্বীপে তিনি সাইকেল বালির ধারে দাঁড় করিয়ে সমুদ্রের তীরে ঘুরে ঘুরে পাঁপড বেচছিলেন। সাইকেলে কোনও তালা নেই। 'দিদি, তালা দেন নি তো' বলায় মহিলা বললেন, 'ও কিছু হবে না, কেউ নেবে না।' আমি, খাস উত্তর কলকাতার লোক, শুনে তাজ্জব। আমার সাইকেলে দুটো তালা পড়ত, একটা সাইকেলের নিজের লক, আরেকটা চেন দিয়ে জানলার গ্রিলে বাঁধা। সেখানে নিশ্চিন্তে সাইকেল ছেড়ে মহিলা এদিক ওদিক যাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী? 

    রাতের দিকে এক ভাতের হোটেলে কথাবার্তা হয়েছিল, আমরা মাংস কিনে আনব, দোকানে রেঁধে দেবেন। দোকানের সামনে দুজন মাঝবয়সী লোক বসে গল্প করছিলেন, আমাকে দেখে খেজুরে আলাপ শুরু করলেন, এই দেখার আছে ওই দেখার আছে ইত্যাদি। আমি বললাম, এখন তো বোধহয় কোথাও যাওয়াটা ঠিক হবে না, না? দ্বিতীয় চমক, ওঁরা বললেন, না না, যাও না, কিছু হবে না। আমি আবার হাঁ, ব্যাটারা বলে কি, এই ঘুটঘুটে রাত্তিরে বেরিয়ে জ্যান্ত ফিরব নাকি? ওঁরা বললেন, এখানে খুব নিরাপদ। উটকো কাজকর্ম হয় না। 'কেন হয় না?' শুনে ওঁরা ভেবেচিন্তে বললেন, 'কইরা পলাইব কোথায়?' আমি 'কেন নৌকা ধরে পালাবে', 'কে করেছে জানবে কী করে' ইত্যাদি প্রশ্ন করলাম, কেন আন্দামান এত নিরাপদ সে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল না, কিন্তু আন্দামানের জনপদ যে নিরাপদ এ নিয়ে ওই দুজন নিশ্চিত। 'আর চুরি কেন হয় না?'-র উত্তরে বললেন, সরকার চিকিৎসার খরচ দেয়, মাসে ৩০০০ টাকা বার্ধক্য ভাতা দেয়, এখানে জীবন দিব্যি কেটে যায়। পশ্চিমবঙ্গে এঁদের একজন মাঝে মাঝে যান আত্মীয়দের কাছে, কিন্তু ওখানে ভাল লাগে না, খুব ঝামেলা, এখানে শান্তির জীবন, চাষবাস করেন ইত্যাদি। 

    এতকিছু শুনে আমি তাজ্জব। আমাদের বাংলার লোক দিয়েই ভর্তি একটা জনবসতি, খুব বেশীদিনের তাও না, সেখানের নিরাপত্তার অবস্থা, জীবনের অবস্থার এত ফারাক আমাদের থেকে? কী হচ্ছে ব্যাপারটা? আমি দিনের শেষে টুরিস্ট, তাতে প্যাকেজ টুর, খুব স্বাধীনতা নেই, পরে কোনোদিন এসে ঘুরেটুরে দেখব ব্যাপারটা কীরকম, কতটা দুধ কতটা জল এইসব ভেবে কদিন কাটল। নিরাপত্তার কথাটা এর মধ্যে আরও বিশবার শুনলাম নানা লোকের থেকে। যাবার আগে ভাবলাম কপাল ঠুকে একবার পরখ করেই দেখি। যদি ঠিক হয়, হয়ত সারাজীবনে এই একটাই সুযোগ হবে রাতে একটা ভারতীয় শহরে একা ঘোরার। পকেটে একটা ফোল্ডিং ছুরি নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে রাত ১২টার আশেপাশে বেরিয়ে পড়লাম। অপূর্ব সুন্দর শহর, নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে এক দুজনকে চোখে পড়ল, তারা এক আধবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিন্তু কোনওরকম ভায়োলেন্ট উদ্যোগ নিল না। ঘন্টাদেড়েক ঘুরে মনে হল বাড়ির লোক নির্ঘাত কাঁইকাঁই জুড়ে দিয়েছে এতক্ষণে, ভেবে হোটেল ফিরলাম। 

    কলকাতায় রাত করে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা ভালো না, আরও অনেকের মতই। দিল্লীতে শুনেছি মেয়েদের ৭টার পরে বেরোনোই বিপজ্জনক। কিন্তু নির্ভয়া কাণ্ডের মতই কোনোদিনই আন্দোলন কোনও কাজের দিকে যেতে দেখিনি। কিছু লোক আছেন যাঁরা কড়া শাস্তির দাবি তোলাটাকেই কাজের মনে করেন। শাস্তিটাই আদৌ হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ খুব কমই দেখি। আমাদের বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল, বিচারপ্রার্থীরা উকিলের সাহায্য ছাড়া অসহায়,  অসংখ্য পেন্ডিং কেস, অধিকাংশ কারাবন্দী আন্ডারট্রায়াল, অথচ জুডিশিয়াল রিফর্মের দাবি ওঠে না। শাস্তির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলাটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। তার পরেও, জুডিশিয়াল রিফর্মের আন্দোলন দেখা যায় না, 'কড়া আইন'-এর দাবি দেখা যায় প্রচুর। আন্দামান কী করে এত নিরাপদ বা সত্যিই কতটা নিরাপদ সেটা আমি ওইটুকু দেখে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওই শান্তি আমরাও তো পেতে পারি। সে আন্দোলনও দেখি না। যদিও দেখার কথা ছিল। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন