সূত্র:
ভারত সরকার দ্বারা প্রকাশিত রাজ্যভিত্তিক শহীদ অভিধানযে বিষাক্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক হোয়াট্সঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের (সংক্ষেপে হোবিবি-র) পোস্ট পাওয়া গেল, তার শুরুতে লেখকের নাম "মাননীয় তপন ঘোষ" এবং শেষে বন্ধনীর মধ্যে ভুল বানানে লেখা, "(সংগৃহিত)"। বোল্ড ফন্টে পোস্টটির শিরোনাম, "বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জবাব।"
এতে প্রথম সাতটি বাক্য প্রোপাগান্ডামূলক স্লোগান, বা অসভ্য চিৎকার বা উদগ্র ঘোষণা, হয়ত পাঠকের মুড সেট করার জন্য। সেখানে আলোচনার যোগ্য কোন যুক্তি বা তথ্য নেই। অবশ্য পরেও যে খুব একটা আছে তা নয়। তবে অর্ধেক ও বিকৃত ইতিহাস জ্ঞানের যথেচ্ছ উল্লেখ আছে, সেগুলোর প্রতি সুস্থ মস্তিষ্কের পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কেননা, অতি বড় স্থিতধী মানুষও জঙ্গী (বা সঙ্ঘী)-দের এহেন কদর্য অশালীন বাগাড়ম্বরের সামনে পড়লে হত-বাক হয়ে যেতে বাধ্য, তখন মাথা কাজ করা থামিয়ে দেয়। তাই সেই পোস্টের থেকে যে কথাগুলো আলোচনা করতে চাই, সেগুলো সময় করে পড়ুন, বুঝুন এবং জলাতঙ্ক ও মুসলামানাতঙ্ক ছড়ানো মনুষ্যেতর প্রাণীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।
[১ম উক্তি] - "পরাধীন যুক্ত বাংলায় ৫৪% মুসলিম আর ৪৬% হিন্দু ছিল। বঙ্গপ্রদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হিন্দু সংখ্যালঘু প্রদেশ ছিল। তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামে উভয়ে অংশগ্রহণ করলে — শহীদ হওয়া এবং এবং জেলে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম বেশি হিন্দু কম হওয়া উচিত ছিল! ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী থেকে বাংলায় যে শহীদ হওয়ার পরম্পরা শুরু হয়েছিল তাতে কতজন মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে বা ফাঁসিতে শহীদ হয়েছিল? মোট শহীদ সংখ্যার ৫৪% কি? আন্দামান সেলুলার জেলে কয়জন মুসলিম গিয়েছিল? মোট কারাবাসীদেরর ৫৪% কি?"
আমরা ধরে নিচ্ছি হিন্দু-মুসলিম ভাগটা ওরা যা বলছে সেরকমই ছিল। কেননা তথ্যসূত্র উল্লেখ হোবিবি-র রীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পাটীগণিত পড়ে যদি পড়াশুনা ছেড়েছুড়ে স্বয়ংসেবক হওয়া যায়, তাহলে এই প্রশ্নগুলি যথার্থ বলে মেনে নেওয়া যায়।
প্রথম আপত্তি, পরাধীন যুক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলিম ছাড়া কি অন্য কোন ধর্মের মানুষজন ছিল না? ওরা তো বলছে ৫৪+৪৬=১০০ শতাংশের কথা। আবার ওরাই মিশনারিদের ধর্মান্তরীকরণের অভিযোগে গ্রাহাম স্টেইনসদের মত নিরীহ খ্রিস্টানদের জ্যান্ত পোড়ায়। তাহলে, প্রকৃত কথাটা ওরা প্রথমেই গোপন করছে, হিন্দু-মুসলিম ভাগটা ৪৬/৫৪ হতে পারে না। ঘৃণা ছড়াতে গেলে এসব ইচ্ছাকৃত বিকৃতি দরকার হয়।
দ্বিতীয় আপত্তি, 'শহীদ হওয়ার পরম্পরা' বাক্যবন্ধ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যাদের নাড়ির যোগ নেই, তারাই এতটা অশ্রদ্ধার সাথে শহীদদের বলিদানকে হেয় করতে পারে।
তৃতীয়ত, সমসত্ত্ব মিশ্রণের যেকোন অংশ থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করলে মিশ্রণের উপাদানগুলির অনুপাত নমুনার অনুপাতেও অপরিবর্তিত থাকে। ক্লাস সেভেনের ভৌতবিজ্ঞানে এটি পড়ানো হয়। সেই জ্ঞানকে সম্বল করে জঙ্গীরা সমাজের হিন্দু-মুসমান মিশ্রণকেও সমসত্ত্ব বলে দেখাতে চায়। বাস্তব অভিজ্ঞতা কি আদৌ সে কথা বলে? এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, 'কতজন মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে... আন্দামান সেলুলার জেলে গিয়ে...' ইত্যাদি। সে প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়ে দিয়েছি। এই লেখার শুরুতে। এবং তথ্যসূত্রও দিয়েছি, কেননা এই লেখাটা হোবিবি-র নিয়ম মেনে লেখা পোস্ট নয়। এখন বরং অন্যান্য উক্তিগুলি বিচার করা যাক।
[২য় উক্তি] - "আচ্ছা হিন্দুরা না হয় পুজো টুজো করে। তা মুসলিমরা আল্লাহ্- আল্লাহ্ করে নামাজ-টামাজ পড়ে একটা আলাদা বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করল না কেন? তারাই তো ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রথম দায়িত্ব তো তাদেরই ছিল। করল না কেন?"
আবার বলি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যাদের দূর-দূরান্তের যোগও নেই, তারাই উক্ত এই কথাগুলোকে যুক্তি বলে মেনে নেবে, বাকিরা মানতে পারবে না। পারিবারিক ঝামেলায় বড় ভাই মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নেবে, অনেকটা এইরকম চিন্তাভাবনার উপরে ওই যুক্তিটা সাজানো। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে (অর্থাৎ বড় বলে) ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রথম দায়িত্ব তাদের। এটা কোন যুক্তি হল! এর সাথে টেনে, নিজে নিজেই ঝগড়া চালানোর তাগিদে, পোস্টে এল পরের সঙ্ঘী যুক্তি, বাংলায় মুসলিম শাসনে হিন্দু নারীদের বিপন্নতা, এবং মুসলিমদের বহুবিবাহের ও বহু-বহু সন্তান জন্মের কারণে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি। এর জবাব একটা বহু পুরনো গানে আছে, তার একটা লাইন বলি।
ছাগলে কামড়াল সীতায়, কেঁদে মরে দুঃশাসন।
অর্থাৎ কার্যকারণবিহীন যুক্তিপরম্পরা। সম্ভবত এই কারণেই সঙ্ঘীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, বরং গান্ধীজীর মত হিন্দু-সংগ্রামীদের হত্যা করার কাজে লিপ্ত হয়েছিল। কেননা, ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দায়িত্ব, সংখ্যালঘু হিন্দু স্বয়ংসেবকেরা সে কাজে প্রাণ খোয়াতে যাবে কেন!
[৩য় উক্তি] - "আচ্ছা- ঠিক আছে, ওরা শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল। তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামে ওদের অংশগ্রহণ না হয় কিছুটা কম হবে। *শূন্য তো হওয়ার কথা নয়!* সুতরাং মোট শহীদের মধ্যে ওদের সংখ্যা ৫৪% হবে না। কিছুটা কম হবে। অর্ধেক হোক ২৭%, আরো কম করে ধরলে ২০% হোক বা ১০% হোক। কই ?
একজনও বাংলার মুসলমান শহীদের নাম বলুনতো। পারবেন না। যুক্তবঙ্গের প্রায় ৩০০ শহীদের একজনও মুসলমান শহীদ নেই।... পাঞ্জাবেও একই অবস্থা। পরাধীন ভারতে পাঞ্জাব ও বাংলা এই দুটো প্রদেশ থেকেই সব থেকে বেশি শহীদ হয়ে ছিল। আবার এই দুটি প্রদেশেই মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল। অথচ এই দুটি প্রদেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে থেকে একজনও শহীদ হয়নি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে।
সমস্ত শহীদ হয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখদের মধ্যে থেকে।"
এইবারে এল সেই মোক্ষম জায়গা,
ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার পালা। পাঠক যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে বলি, এর উত্তর হল, না, শূন্য নয়। এই কথাগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। শহীদদের মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা শূন্য তো নয়ই, বরং অনেক অনেক বেশী। শতাংশের হিসেব করতে উচ্চ গণিতের ধারণা লাগে না। উদাহরণ দিয়েছি, এই লেখার শুরুতেই।
[৪র্থ উক্তি] - "স্বাধীনতার আগে দুবার (১৯৩৭, ১৯৪৬) নির্বাচন হয়েছিল এবং মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। মোট তিন জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল। তা হিন্দুরা শিক্ষায় এত এগিয়ে ছিল, এত ডাক্তার- উকিল- ব্যারিস্টার-শিল্পী-সাহিত্যিক-জমিদার-রায় বাহাদুর নেতা— সব হিন্দুরা ছিল, কিন্তু তিন জন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে একজনও হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী হলো না কেন? পাঞ্জাবেও তাই। বাংলায় তিন জন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন, ফজলুল হক এবং সুরাবর্দী। শিক্ষায় যতই পিছিয়ে থাক, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে যতই দূরে সরে থাক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে কোনো অমুসলমানকে মুখ্যমন্ত্রী তারা মেনে নেবে না। তাহলে রাজনীতি সচেতনতার কি কোন ঘাটতি ছিল? ও— শুধু শহীদ হওয়ার সময়, জেলে যাওয়ার সময়, আন্দামান জেলে যাওয়ার সময় ওদের সচেতনতার অতি অভাব নজরে পড়ে? মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেওয়ার সময় সচেতনতার অভাব হয় না? এই সব ছেঁদো যুক্তি আর কতদিন চলবে ?"
সত্যিই এদের মূর্খতায় হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। প্রথমত, যে নির্বাচনের কথা এখানে বলা হয়েছে, তাতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নয়, প্রধাণমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন মোতাবেক এই নির্বাচন হয় প্রথম ১৯৩৭ সালে, তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী অবস্থানের কারণে কংগ্রেস পার্টি (সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পার্টি) এই নির্বাচন বয়কট করেছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করে মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল কৃষক-প্রজা পার্টি, সমর্থন করেছিল মুসলিম লীগ এবং প্রথম প্রধাণমন্ত্রী হয়েছিলেন এ কে ফজলুল হক। ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগ তাদের সমর্থন তুলে নেয়, ফলে মন্ত্রীসভা বাঁচাতে
ফজলুল হক জোট বাঁধেন, কাদের সাথে জানেন? হিন্দু মহাসভার সাথে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। সঙ্ঘীদের গডফাদার শ্যামাপ্রসাদ, বি জে পি-র মাদার পার্টি হিন্দু মহাসভার জনক, ফজলুল হকের জোট সরকারের অংশীদার হন, সেই জোট চলে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। বাকি ইতিহাসটা নাহয় একটু গুগল সার্চ করে জেনে নেবেন।
সুতরাং, জলাতঙ্ক ও মুসলামানাতঙ্ক ছড়ানো মনুষ্যেতর প্রাণীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।