এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্মৃতি ছায়ায় চৈত্র মায়ায়...

    স্বনন্দিনী Swanandini লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ এপ্রিল ২০২৪ | ২৬৯ বার পঠিত
  • পূবের সূর্য ঘোমটা খুলছে। কুঙ্কুম রাঙানো নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। সবুজ পাতারা ছড়িয়ে দিচ্ছে মিঠে হাওয়া; ফুলেরা সুবাস। পাখির দল বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে; জুড়ে দিয়েছে কনসার্ট। উঁচু উঁচু বাড়িগুলো তালগাছের মত নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু একটু করে জেগে উঠছে চরাচর। তবে বেশিরভাগ পাড়াই এখনও 'দুয়ার এঁটে' ঘুমিয়ে। বড় মায়াবী এই ভোরের পৃথিবী। অনাঘ্রাতা এক নারী যেন! যার অপার্থিব শান্ত সমাহিত আঁচল ছায়ায় দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নেওয়া যায় কয়েক দণ্ড।

    আজ ২৬ শে চৈত্র, ১৪৩০। বছর শেষের বিদায় বাঁশি বাজতে শুরু করে দিয়েছে। চার তলার ব্যালকনি বাগানে দাঁড়িয়ে ভোরের পৃথিবী দেখতে দেখতে পিছিয়ে যাচ্ছি বছর পঁচিশ পিছনে।

    যখন বাগানে বাগানে ফুল কুড়িয়ে শুরু হতো এই ভোরগুলো। ঠাকুমার নিত্যপুজোর অর্ঘ্য জোগাড় দিতাম। বছর শেষের এই দিনগুলোতে মা-ঠাকুমাদের দম ফেলার ফুরসৎ মিলতো না। একদিকে পুরনো হেঁসেলকে ঘষে-মেজে নতুন করে নেওয়ার প্রস্তুতি; অন্যদিকে নীল ষষ্ঠী, গোকুল ব্রত, চৈত্র সংক্রান্তির নিয়মনিষ্ঠা। বাবার ছিল নতুন খাতা আর বছর শেষের হিসাব নিকাশ।

    সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এই সময় হরগৌরী সেজে বহুরূপী ও গাজনে সন্ন্যাসীদের বাড়ি বাড়ি আগমন পর্ব। পড়াশোনার বিশেষ ঝক্বি না থাকায় চৈত্রেরএই ঠাঁ ঠাঁ দুপুরগুলোতে আমরা কচিকাঁচারা আসর জমাতাম কখনো এ বাড়ির দাওয়ায়; কখনো ও বাড়ির উঠোনে।

    'হর হর মহাদেব' - বলে হাঁক পেড়ে যখন বহুরূপীর দল বাড়ির উঠোনে এসে নাচ জুড়ত, তখন সবচেয়ে খুঁদেরা কেউ কেউ লুকোনোর জন্য মায়ের আঁচল খুঁজতো। জটাজুটধারী শিবকে তাদের বড্ড ভয়! আমরা যারা একটু তালগাছ হয়েছি তারা হাঁ করে গিলতাম সেইসব দৃশ্য। গাজনে সন্ন্যাসীরা হাজির হলে আবার মায়েদের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে যেত। হাতের সমস্ত কাজ ফেলে ঘটি করে ঠান্ডা জল এনে তারা সন্ন্যাসীদের পা ধুইয়ে দিতেন। ঝোলায় দিতেন চালটা, কলাটা, মুলোটা আর কাঁচা টাকা। খর রোদের দিনে শিবকে ঠান্ডা করার এমন সুযোগ কি আর রোজ রোজ মেলে!

    এ তো গেল দো পেহের কা কিসসা ! বিকেল হতেই মুখিয়ে থাকতাম কালবৈশাখীর দমকা বাতাসের জন্য। ঝোড়ো হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ, হওয়ার তালে তালে বড় বড় গাছেদের অনবরত মাথা দুলিয়ে যাওয়া, আর বাড়ির উঠোনে দুমদাম শিলাবৃষ্টি। ঝড়ের তাণ্ডব প্রচন্ড বাড়লে ঠাকুরমা বলতেন পিঁড়ি পেতে পবনদেবকে বসতে দাও। অতএব বাড়ির সদর গেট থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হত একটি পীঁড়ে; সঙ্গে চলত মন্ত্র পড়ার ধুম। কোথায় গেল সেই সব দিন!

    সেল সেল সেল! চৈত্র সেল! আমাদের মেয়েবেলায় গ্রাম মফঃস্বলের মানুষদের জন্য বিকিকিনির সবচেয়ে প্রিয় ইভেন্ট ছিল চৈত্র সেল। বাড়ির মহিলাকুলকে দেখতাম সারা বছর ধরে ভান্ডারে পয়সা জমাতে বছরের এই বিশেষ সময়টির জন্য। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে বিকেল-বিকেল পরিপাটি হয়ে দলবেঁধে সব বেরিয়ে পড়তেন স্টক ক্লিয়ারেন্সের বাজার ধরতে। ফিরতেন চওড়া হাসি নিয়ে। সম্বৎসরের ঘরোয়া প্রয়োজন থেকে একটু দামি সাজ-পোশাকের শখ-সবেরই অব্যর্থ দাওয়াই ছিল, এই চৈত্রের হাট।

    আজ অনলাইন শপিং প্লাটফর্মে সারা বছরই প্রায় অফারনীতি চলে। রাস্তার উপর গজিয়ে ওঠা মোহময়ী শপিংমলগুলোই বা কম কি! তাদের ডিসকাউন্ট রাজনীতির ফাঁদে ধরা দেয় নি এমন গ্রাহক আর কজন আছেন!ফলত, আজ আমরা প্রয়োজনের থেকে বেশি কিনি; ভোগ করার থেকে বেশি লোভ করি।

    আমাদের ঘর ভরে উঠেছে আজ সামগ্রীর পাহাড়ে; ‌মন ভরে উঠেছে নেতিবাচক ভাবনায়। ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে আজ আমরা বাঁচিনা। দু'দণ্ড ভাবার অবসর নেই আমাদের। ভোগসামগ্রীর কানা গলিতে উপভোগের মন গিয়েছে হারিয়ে। নির্মল আনন্দের সন্ধান পেতে আজও তাই ডুবদি শৈশব সমুদ্রে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন