১৯৪৮ সালে ১৮ই আগস্ট তারিখে একটি Public meeting আয়োজিত হয় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। তাতে স্বনামধন্য ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার একটি জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন, বাঙালি উদ্বাস্তুদের দুর্দশাকে কেন্দ্র করে। অমৃতবাজার সহ অনেক পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিল। তার পূর্ণ বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হল।----------------------------------------------------------------
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করেছেন যে, বিগত জুলাই মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ স্বাধীনতালাভের পর বারো মাস অতিক্রান্ত হবার পূর্বেই, পূর্ববঙ্গ থেকে সাড়ে এগারো লক্ষ অসহায় মানুষ পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। উদ্বাস্তু-আগমনের এই স্রোত এখনও বন্ধ হয়নি, পাঁচদিন আগেই পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত ৭৬০ জন নিঃসহায় শরণার্থী শিয়ালদহ স্টেশনে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, এমনকি সারাদিনে হাজারজন পর্যন্ত শরণার্থীর আগমনের সংবাদ মাঝেমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখলে এই শিকড় হারানো অসহায় শরণার্থীদের আগমনের স্রোত বন্ধ হওয়ার আদৌ কোনোরকমের সম্ভাবনাই আমি দেখতে পাচ্ছিনা, শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি, অনাগত ভবিষ্যতে বছরের পর বছর ধরে প্রত্যেক দিন শতশত অসহায় মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাধ্য হয়ে ক্রমাগত চলে আসতে থাকবে; এবং এই মানব-স্রোতের প্রবাহপথে প্রথম বন্দরটি হবে কলকাতা।
বর্বরতার অন্ধকারে অবনমন -
এই ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, পূর্ব পাকিস্তান বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে, এবং সেখানকার হিন্দুদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সম্মানজনক কাজকর্ম চাকরিবাকরি ইত্যাদির সুযোগ নেই, তারা সম্মানের সাথে ব্যবসায়িক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে সে আশাও সুদূরপরাহত। এককথায়, স্বচ্ছভাবে, কোনো সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সেখানকার হিন্দুরা যে রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে মুসলমানের সমকক্ষ হয়ে উঠবে, বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মুখ দেখবে—তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ইউরোপীয় পরিভ্রমণকারীরা মুসলমান রাজবংশের শাসনে থাকা প্যালেস্টাইনের অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, সেসময় ওই দুর্ভাগা মরুদেশে অশিক্ষিত-অনুন্নত-অর্ধসভ্য মানুষ পশুর মত জীবনধারণ করতে বাধ্য হত, হাজার রকমের রোগ-ব্যাধি-ধুলো-ময়লার মধ্যে অবহেলিত পশুর মত দুঃসহ ক্ষুধায় ধুঁকতে ধুঁকতে তারা সেখানে মৃত্যুর প্রহর গুণত। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে সেখানে ইহুদীরা এসে স্থানীয় আরবদের থেকে জমি কিনে রাস্তাঘাটের উন্নতি করতে শুরু করে; বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, ফলের বাগিচা, এবং সর্বোপরি একটি সৎ ও সুশিক্ষিত পুলিশবাহিনী তৈরী করার মাধ্যমে তারা সেই মরুপ্রান্তরে এক মরুদ্যান সৃষ্টি করে।
বর্বরতার অন্ধকারে নিমগ্ন সেই অনুর্বর পবিত্র ভূমিতে গড়ে ওঠা ইহুদীদের প্রত্যেকটি ঘাঁটি আজ আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত সুযোগসুবিধায় পরিপূর্ণ আধুনিক সভ্যতার মরুদ্যানরূপে— সগর্বে, সদর্পে সেখানে বর্তমান রয়েছে। কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ইহুদীরা প্যালেস্টাইন-ভূখন্ডে তাদের রাষ্ট্রের অধিকার যখনই ছিনিয়ে নিয়েছে, প্রাচ্যদেশের মুসলমান অপশাসন ও স্থবিরতার বুক চিরে তখনই আধুনিক সভ্যতার জয়যাত্রার বার্তা নিয়ে নতুন সূর্যের আলোয় রাঙা হয়ে সেজে উঠেছে তাদের সেই প্রাণের ভূমি। ইহুদী বিনে প্যালেস্টাইন যে অন্ধকারে পড়ে ছিল, আজ পূর্ববঙ্গ সেই একই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলেছে। আজ ইহুদীরা সর্বস্ব পণ করে যেভাবে তাদের প্রাণের ভূমি প্যালেস্টাইনের মধ্যযুগীয় বর্বরতার অভিশাপ মোচন করেছে, চারপাশের ঊষর মরুপ্রান্তরের মধ্যযুগীয় অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার বিদীর্ণ করে আধুনিক সভ্যতার আলোকবর্তিকা হাতে তাদের মরুদ্যানে সকলকে স্বাগত জানাচ্ছে, সেই একই ভাবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গকেও উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকলকে বদ্ধপরিকর হতে হবে।
তারা অভিজাত সম্প্রদায় ছিল -
আজ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় চড়ে শিয়ালদহ স্টেশনচত্বরে এসে ভিড় করা মানুষগুলোকে আপনারা বিধ্বস্ত, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় দেখছেন। এই মানুষগুলোই কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি, ধনসম্পদ, উদ্যম, সাংগঠনিক ক্ষমতা ইত্যাদির দিক থেকে তাঁদের জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের ভূমিপুত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কোনো দেশ, এবং তার সমাজের মহত্ত্ব সেখানকার যেসকল বিদ্বান মানুষজনদের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে, পূর্ববঙ্গের জনসমাজের সেই মহত্তম অংশ ছিলেন এই হতভাগ্য ব্যক্তিরাই। ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুর আজ তাদের সেই সুসন্তানদেরকে হারাচ্ছে—ঈশ্বরের বিচারে সেখানকার পরবর্তী প্রজন্মগুলো বংশপরম্পরায় নিশ্চয়ই এই অপূরণীয় ক্ষতির মূল্য চোকাতে বাধ্য হবে।
আমি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এইসব সভ্য সুশিক্ষিত মানুষ যাঁরা আপনাদের দ্বারপ্রান্তে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেবেননা। আজ যদি আপনারা এই সুমহান মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন, ভবিষ্যতে এই মানুষগুলোই আপনাদেরকে আরও বেশি গৌরবের অধিকারী করবে। তিরিশ বছরেরও আগে একটি বাংলা মাসিক পত্রিকায় আমি লিখেছিলাম—“The life stream of the Bengali race flows languidly in West Bengal; it is full and vigorous among the Hindus of East Bengal only.”
অবক্ষয়প্রাপ্ত পুরনো দিনের জীবনচর্যায় জীর্ণ হয়ে যাওয়া দেহে এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজনকে আশ্রয় দিয়ে আমাদের নবজাত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এক সমৃদ্ধ শক্তিশালী রাজ্য হওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করুক। এটা আপনাদের নিজেদের ভালোর জন্যই, জানবেন আজ এ-কাজ করে দেখানোর দায় এক ও একমাত্র বাঙালি হিন্দুর। আর তার জন্য আজ যাঁরা মন্ত্রীত্বে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্যান্য পেশায় বড় বড় পদে অবস্থান করছেন, ভোটের রাজনীতিকে অবলম্বন করে রাজকীয় ক্ষমতা অর্জন করেছেন, আমি তাঁদেরকে অনুরোধ করছি—দয়া করে ভয় পাবেননা, নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির অঙ্ক কষে পিছিয়ে যাবেননাঃ এই নতুন রক্তপ্রবাহকে বরণ করে নিন, অন্যথায় আপনাদেরকেও বিলুপ্ত হয়ে যেতে হবে, আপনাদের নবীন প্রজন্মেরও কোনো ভবিষ্যৎ থাকবেনা।
দুঃখজনক দেশত্যাগ -
ঐতিহাসিক Gibbon বর্ণিত পুরাকালের ‘wandering of tribes’ বা ‘migration of races’ এর মতই ভারতের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ অংশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে; এবং পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর স্থানান্তরণ ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এক বিরাট প্রভাব ফেলবে। কিন্তু গিবন-বর্ণিত সেই উপজাতিদের যাযাবরবৃত্তির তুলনায় আজকের ভারতে উপস্থিত দেশত্যাগী শরণার্থীদের সমস্যা আরও অনেক বেশি মর্মান্তিক, কারণ সেই উপজাতিরা সংঘবদ্ধভাবে, এবং যোগ্য নেতৃত্বের পরিচালনায় অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে নতুন দেশে গিয়েছিল, সেখানে তীব্র সংগ্রামের পর বিজয়ী হয়ে তারা সেই নতুন দেশে নতুন করে তাদের বসতি স্থাপন করে অল্পকালের মধ্যেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এইভাবেই জার্মানির Angles এবং Saxonsগণ ব্রিটেনে বসতি স্থাপন করে, এবং স্থানীয় জনপ্রবাহে মিশে গিয়ে পরবর্তীকালে মহাশক্তিধর ব্রিটিশ জাতিতে পরিণত হয়। একইভাবে হাঙ্গেরির Hunরা, স্পেনের Gothরা তাদের নতুন দেশে গিয়ে স্থানীয় জাতিসত্তায় অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে যায়। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন ওই দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে অব্যবহৃত জমি বর্তমান ছিল।
আগত শরণার্থীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করুন -
বর্তমানে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দেশত্যাগের সমস্যার সাথে একমাত্র English puritan দের সমস্যার তুলনা চলে, যারা ইংল্যান্ড ত্যাগ করে প্রথমে হল্যান্ড ও পরবর্তীতে ম্যাসাচুসেটসে চলে যেতে বাধ্য হয়; বা ফরাসী Huguenots-গণের দুর্দশার সাথে তুলনা চলে যারা রাজা চতুর্দশ লুইএর আমলে ফ্রান্স ছেড়ে হল্যান্ড, প্রাশিয়া এবং ইংল্যান্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই সমস্ত স্থানান্তরণের মূলে ছিল ধর্মীয় নিপীড়ন এবং শাসকের অসৎ ও বৈষম্যমূলক আচরণ, যারফলে দেশের জনসংখ্যার একটি অংশ কার্যত সমস্ত আইনকানুনের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল। এই মানুষগুলোকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ফলে ফ্রান্সের যে কতবড় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা আপনারা সহজেই বুঝতে পারবেন যখন আপনারা ইতিহাসে পড়বেন, এই দেশত্যাগী ফরাসী প্রোটেস্ট্যান্টদের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে কীভাবে হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার শিল্প-বাণিজ্যের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। চরিত্রে-বিদ্যায়-বুদ্ধিতে তারা ছিল সমাজের সর্বোৎকৃষ্ট জনগোষ্ঠী। ওয়াটার্লুর যুদ্ধে ওয়েলিংটনের অশ্বারোহী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জনৈক ফরাসী প্রোটেস্ট্যান্ট বস্ত্রব্যবসায়ীর প্রপৌত্র, যাঁর প্রপিতামহকে ১৩০ বৎসর পূর্বে বাধ্য হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়েছিল। Cogne-র যুদ্ধে রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের সৈন্যবাহিনীর একেবারে কেন্দ্রীয় শক্তিই ছিল একদল দেশত্যাগী ফরাসী প্রোটেস্ট্যান্ট; যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রান্সের রাজার পক্ষের আক্রমণকারী সৈন্যদলকে দেখিয়ে তৃতীয় উইলিয়াম তাঁর সেই ফরাসী প্রোটেস্ট্যান্ট-সৈন্যদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “ভদ্রমহোদয়গণ! এরাই তোমাদের ওপর অত্যাচার করেছিল!” তাই আজ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থেই উচিত এই শরণার্থী ভাইবোনদেরকে বুকে টেনে নেওয়া, এবং তারা যাতে আবার যথার্থ স্বাবলম্বী সমৃদ্ধ মানুষ হিসাবে এবং সমাজ হিসাবে উঠে দাঁড়াতে পারে তা সুনিশ্চিত করা। জাতির ভাগ্যাকাশে বিপর্যয় দেখা দিলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতকে হয়তো এই শরণার্থীদের কাছেই শরণাপন্ন হতে হল—এমন দিন যে আসবেনা, তা কে বলতে পারে?
প্রয়োজন পরিকল্পনার -
এখন, এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী-আগমনের ব্যাপারে একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারবো যেঃ
সুপরিকল্পিতভাবে, সুপরিচালিতভাবে অতীতে সংঘটিত হওয়া যে গণ-অভিবাসনগুলোর উদাহরণ দিয়েছি, নতুন ভূমিতে গিয়ে স্থানীয় সমাজে অভিবাসীদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে দৃষ্টান্ত আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি— আজ ভারতভূমিতে আগত নতুন শরণার্থীরা নতুন স্থানে নতুন বসতি স্থাপনের সেই সুযোগ-সুবিধাগুলো একদমই পাবেনা। সর্বোপরি, আমাদের পূর্ববঙ্গীয় শরণার্থীবন্ধুদের মধ্যে যোগ্য নেতৃস্থানীয় পথপ্রদর্শকের অনুপস্থিতির কারণে, এবং তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তারা নিজেরা কীভাবে এগিয়ে যাবে—সেবিষয়ে তাদের সামনে কোনো সুষ্ঠু, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারণে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীবন্ধুদের সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এনাদের জন্য সর্বপ্রথম যেটা সুনিশ্চিত করতে হবে সেটা হল এনাদের প্রত্যেকের দেহধারণের জন্য খাদ্যের সংস্থান সুনিশ্চিত করা, এবং এই বিপুল সংখ্যক ছিন্নমূল মানুষগুলোর মাথার ওপর স্থায়ী ছাদের ব্যবস্থা করা। সৌভাগ্যবশত, হিন্দুদের চিরাচরিত দান-ধ্যান-অতিথিসেবার সংস্কার এক্ষেত্রে মূল্যহীন হয়ে যায়নি, নিষ্ফল নিরর্থক বলে প্রমাণিত হয়নি, হাজারো সমস্যায় এই নিঃসম্বল মানুষগুলোর জীবন জর্জরিত হয়ে গেলেও, যেকোনো উপায়েই হোক— এই নবাগতদেরকে অন্তত খাদ্যের অভাবে অনাহারে মরতে হয়নি। ১৯৪২-৪৩ সালে কলকাতায় তদানীন্তন সরকারের কারসাজিতে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, আমরা তার মোকাবিলা করেছি। আমি আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সহৃদয় পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে প্রার্থনা করছি, তাঁরা যেন ‘৪২-৪৩এর মতই একইরকম উৎসাহে আজ আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত পূর্ববঙ্গের ভাইবোনদের জন্য আবারও ত্যাগ স্বীকার করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, ওই মানুষগুলোকে আপন করে নেন। যদি ওই অসহায় মানুষগুলো অবহেলার শিকার হন, তাহলে শুধু নিউমোনিয়া থেকে শুরু করে কলেরা ইত্যাদি বিভিন্ন মহামারী কলকাতায় যে থাবা বসাবে তাইই নয়ঃ আমাদের আত্মার অবমাননা হবে— বাঙালিত্বের দুর্জয়-দুর্দমনীয় স্পর্ধা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
আজকের সমস্যাসমূহ-
আমি আমাদের জননায়কদেরকে দেশভক্তি ও দূরদৃষ্টি সহকারে ভবিষ্যতে আসন্ন এই সংক্রান্ত আরো গুরুতর সমস্যাবলী, এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধানের ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। কারণ নিছক দানধ্যানের মাধ্যমে বা সহানুভূতি দেখিয়ে সেই সমস্যাগুলোর স্থায়ী প্রতিকারের দিশা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
প্রথমতঃ সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এই নবাগতদেরকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক জীবনপ্রবাহে কীভাবে অঙ্গীভূত করা যায়। এখানে সমগ্র বঙ্গদেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জমিতে তার জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান নিশ্চিত করার মত কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এখানে বিচারব্যবস্থা ও আইনব্যবস্থা, চিকিৎসাজগৎ ইতিমধ্যেই অতিপৃক্ত হয়ে পড়েছে, শিক্ষাব্যবস্থার হালও প্রায় তাইই। ক্ষুদ্র শিল্প থেকে শুরু করে খুচরো ব্যবসা, টুকটাক মুদিখানা এমনকি বিড়ির দোকান চালানোর পেশাটিও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দুদের অন্নসংস্থানের জন্য বরাদ্দ করে দেওয়া উচিত, কারণ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদেরকে আমি এরকম ছোটোখাটো দোকান চালাতে দেখিনি বললেই চলে। আনন্দের বিষয়, আমাদের পূর্ববঙ্গীয় ভাইরা তাঁদের সহজাত ক্ষমতাবলে অদম্য উৎসাহের সহিত এইসব কাজে ইতিমধ্যেই আত্মনিয়োগ করতে শুরু করে দিয়েছেন। গত ৩০ বছর ধরে আমি লক্ষ্য করছি, কলকাতার মধ্যে পূর্ববঙ্গনিবাসী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন বড় দোকান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ঠিক যেমনভাবে মহারাষ্ট্রে গুজরাটিরা ক্রমে ক্রমে ব্যবসার জগতে আধিপত্য বিস্তার করছে।
দ্বিতীয়তঃ এই বিপুল সংখ্যক বাস্তুত্যাগী জনতাকে কীভাবে উদ্বাস্তু-শিবির থেকে ক্রমান্বয়ে স্থায়ীভাবে নিজস্ব একটা নতুন বাসস্থানের নিশ্চিন্ত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্য Tennessee Valley Authorityর মত কোনো স্থায়ী বোর্ড তৈরী করতে পারলে সেই সংস্থাই দায়িত্ব নিয়ে একাজ সম্পূর্ণ করতে সফল হবে।
তৃতীয়তঃ এই মানুষগুলোর খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার সাথে সাথে আরও একটি জরুরি জিনিসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন আছে। এই বিপুলায়তন ছিন্নমূল মানুষের সমুদ্রের মধ্যে ঢাকার দিককার অসংখ্য ছাত্রছাত্রীও বর্তমান—যাদেরকে তাদের স্কুল ছেড়ে এপারে চলে আসতে হয়েছে—তাদের পড়াশোনা যেখানে থেমে গিয়েছিল, ঠিক সেখান থেকেই যাতে তারা আবারও এখানে পড়াশোনা শুরু করতে পারে, তাদের বিদ্যাচর্চায় যেন ভাটা না পড়ে, একটা বছরও যেন তাদের নষ্ট না হয়—সেইটি সুনিশ্চিত করতে হবে। এই ছাত্রছাত্রীরাই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি মাননীয় জেফারসন ডেভিড মহাশয় তাঁর West Point Cadetদেরকে বলেছিলেন, “You are the seed-crop of the nation.”। হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ধরেছেন, এই ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা কিন্তু টাকাপয়সা চায়না, তাদের যেটা প্রয়োজন সেটা হল পর্যাপ্ত বইপত্র, সেগুলো হাতে নিয়ে মাথা গোঁজার মত ভদ্রস্থ জায়গা।
আর আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গস্থিত সীমিত সংখ্যক শিক্ষাঙ্গনগুলি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়—আরো আরো বেশি সংখ্যায় তাদের জন্য নতুন নতুন উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, পুরনো শিক্ষাঙ্গনগুলোর বিস্তার ঘটাতে হবে; যাতে ছাত্র-ছাত্রী উভয়েই— প্রথাগত যে পুঁথিগত শিক্ষা, এবং কারিগরী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারে। অন্যথায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখনকার তুলনায় আরো গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবে।
লাভের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি—দেশত্যাগী শিক্ষক-সমাজের অদম্য কর্মচঞ্চলতা, আত্মত্যাগ এবং নতুন করে নিজেদের উত্তরপ্রজন্মের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার সাংগঠনিক উদ্যোগ, এবং নতুন বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য তাঁদের পুরনো ছাত্রছাত্রীদের সেইরকমই অদম্য উৎসাহ এবং কঠোর পরিশ্রমী, নাছোড়বান্দা মনোভাব। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এই ছিন্নমূল বিদ্যার্থীসমাজকে যাতে হারিয়ে যেতে না হয়, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাদফতর তাদের করণীয় কর্তব্যপালনে তৎপর হোক। এই সমস্যা নিবারণের জন্য ছিন্নমূল মানুষগুলোর তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে যেটুকু কর্তব্য করার ছিল, তারা বলতে গেলে তার থেকে বেশিই করেছে এবং করছে— আর এতেই এই সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে গেছে।
কোনোরকমের ক্ষমতার প্রতি মোহ কাম্য নয় -
শেষে একটিই কথা বলার যে মুহূর্তে এই ভাসমান জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছে এবং পূর্বপাকিস্তানে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে প্রত্যাবর্তনের আশা যে সুদূরপরাহত (যদিও তাদের মনে এমন আশার উদয় হওয়াটাই স্বাভাবিক) —একথা বুঝতে পেরে তারা সে-বাসনা স্থায়ীভাবে ত্যাগ করেছে, সেই মুহূর্ত থেকে আর এক বিন্দুও বিলম্ব না করে তাদেরকে আইন মেনে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার প্রদানের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে, এবং তারা যাতে পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দাদের মতই সবক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সমান সুযোগ-সুবিধা পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ স্বার্থপরের মত ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করবেন—সেটা কোনোমতেই চলতে দেওয়া যাবেনা।
সমস্যাটি কিন্তু বহরে এবং জটিলতায় দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কোনো একজন ব্যক্তি বা একটিমাত্র দফতরের পক্ষে এককভাবে এই সমস্যা সামাল দেওয়া একান্তই অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের উচিত হবে কোনো Non-official স্থায়ী সংস্থা তৈরী করে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই নবাগত অসহায় মানুষগুলোর দেখভালের ব্যবস্থা করা। আর, তারা স্টেশনগুলোতে এসে পৌঁছনোমাত্র তাদের সাহায্যের জন্য, এবং এই নতুন অচেনা পরিবেশে তাদের সামনে যথার্থভাবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করার জন্য যাতে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে সেই সংস্থার সভ্যরা উপস্থিত থাকেন তা নিশ্চিত করা; এবং আমরা এই মানুষগুলোর পুনর্বাসনের জন্য যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তার সাথে সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে নতুন করে নতুন দেশে এনাদের স্থায়ী আশ্রয়ের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। যাতে করে এই মানুষগুলোর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সংগ্রামে তাঁরা যে সাহায্য ও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন— overlapping হয়ে যাওয়ার কারণে সেসবের কোনো অপচয় না হয়। ইতঃপূর্বে পূর্ববঙ্গের যেসকল সন্তান কলকাতায় এসে বড় ব্যবসায়ীরূপে আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, এবং সেখানকার যেসব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিগণ দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় আমাদের মধ্যে আছেন—তাঁদেরকে আমি আবেদন জানাচ্ছি, এই সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁরা যেন আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন এবং আজ ওই অসহায় মানুষগুলোর চরম দুর্দিনে তাঁদের জন্য যে কর্তব্য সম্পাদন করাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে সেখানে তাঁদের সর্বোচ্চ অবদান রাখেন।