(১)২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালীর ইতিহাসে এক পুণ্য দিন, পবিত্র দিন। শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, এই দিন আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে স্বীকৃত। এই দিন আমাদের যেমন বেদনার্ত করে তোলে, তেমনি আত্মমর্যাদা ও গৌরববোধে প্রতিষ্ঠিত করে। এই দিন বাঙালীর গর্বের দিন।
স্বাভাবিকভাবেই এইদিন বাংলাভাষা নিয়ে আলোচনার দিন। কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করে বাংলাভাষা আরো সমৃদ্ধ হতে পারে, সে নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙলা ভাষাকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার দিন, মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার জন্য শপথ গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণ।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এক পণ্ডিত (!!!) সেসব কিছুই করলেন না। বাংলাভাষা নিয়ে কোনো যথাযথ আলোচনা তাঁর লেখায় পাওয়া গেলোনা। কিভাবে ঘরেবাইরে প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করে বাংলাভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে; সে সংক্রান্ত কোনো আলোচনা তাঁর লেখায় পাওয়া গেলোনা! এর পরিবর্তে ঐ লেখাতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক, কুৎসিত আক্রমণ করা হলো! স্বাভাবিকভাবেই ঐ লেখা বিস্ময়বিমূঢ় করে। তবে পুণ্যদিনে ঐ নোংরা লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাইনি। ভাষাশহীদদের পবিত্র স্মৃতিকে কলুষিত করার জন্য মন সায় দেয়নি। তাই আজ এই নিয়ে কিছু কথা লিখছি। গুরু কর্তৃপক্ষের সৎসাহস থাকলে লেখাটি যেন মোছা না হয়!
লেখক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের উদ্দেশ্যে গালাগালি দিয়ে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বাঙলাভাষার জন্য কিছুই করেননি! আমার প্রশ্ন, লেখক(!!!) নিজে বাংলাভাষার জন্য কি করেছেন? দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি প্রবাসী। সেক্ষেত্রে মাতৃভাষা প্রসারের জন্য তিনি কি আদৌ কোনো অবদান রাখতে পারেন? সেক্ষেত্রে অপরের দিকে আঙুল তোলার কোনো অধিকার কি তাঁর আছে?
লেখক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের "সুখী সুখী হিন্দু" বলে ব্যঙ্গ করেছেন। লেখক এর মাধ্যমে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন বুঝতে পারলাম না। তবে এইটুকু জানি গত পঁচাত্তর বছরে এক কোটির বেশি মানুষ পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন। তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন ও তার বিরুদ্ধে নৃশংস সরকারী দমনপীড়ন। মরিচঝাঁপি থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন তাঁরা দেখেছেন। সম্প্রতি সন্দেশখালির ঘটনাও আমরা জানতে পেরেছি। এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাত যাঁরা সহ্য করেছেন, লেখক কি তাঁদের "সুখী সুখী হিন্দু" বলতে চেয়েছেন? তাহলে আর কিছুই বলার থাকেনা!
(২)
লেখক মহোদয়(!!!) তাঁর লেখায় পশ্চিমবঙ্গকে যেমন গালাগালি করেছেন, বাংলাদেশের তেমনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। উৎসাহের আতিশয্যে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন প্রত্যেক সমাজেই ভালোমন্দ আছে, কোনো দেশ বা সমাজ এর ব্যতিক্রম হতে পারেনা! বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কিছুই বলা যেতে পারে, তবে এটি অন্যপ্রসঙ্গ। তাই এনিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছিনা! শুধু মনে করিয়ে দিলাম, বাংলাদেশ কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়, ইসলামিক দেশ। এই দেশে বিধর্মীদের উপর নৃশংস অত্যাচার হয়, প্রকাশ্য সভায় তাদের হুমকি দেওয়া হয়, তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়! ইন্টারনেটের দৌলতে আজকাল সবকিছুই জানা যায়, লেখক বোধহয় সেকথা বিস্মৃত হয়েছেন! বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লিখে তসলিমা নির্বাসিত! হুমায়ূন আজাদ আক্রান্ত হয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নেন, সেখানেই প্রয়াত! গত কয়েক বছরে একের পর এক ব্লগার খুন হয়েছেন, কেউবা অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছেন! এসব নিয়ে লেখক অবশ্য একটি কথাও বলেননি!
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের গণপরিষদে তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাভাষার অধিকারের দাবিতে সরব হন। স্পষ্টভাষায় বলেছিলেন, বাঙালীদের উপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না! ১৯৬৫ সাল থেকে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাঁকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখে। ১৯৭১ সালে ধীরেন্দ্রনাথ ও তাঁর বড়ছেলেকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর আর কেউ তাঁদের খোঁজ পায়নি! আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই মৃত্যুঞ্জয় ভাষাশহীদ ধীরেন্দ্রনাথ নিয়ে একটি শব্দও লেখক ব্যয় করেননি! তার পরিবর্তে অপরের প্রতি বিষোদ্গার করতেই তিনি ব্যাপৃত ছিলেন! এই বিস্মৃতির কারণ বড়োই রহস্যজনক!
আলোচনার স্বার্থে আরো কিছু কথা জানিয়ে রাখি। বাংলাদেশের জনসমষ্টির একটি বিরাট অংশ ভাষাআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল তো নয়ই, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তারা তীব্র ঘৃণা পোষণ করে! বাংলাভাষা তাদের কাছে নাপাক ভাষা, দেশে তারা শরিয়তী আইন চালাতে চায়! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কুৎসিত কথা লেখে, ভিন্নধর্মী মানুষদের দেশ থেকে তাড়াতে চায়! পাকিস্তান, আফগানিস্তান তাদের চোখে আদর্শ রাষ্ট্র! লেখক অবশ্য এনিয়ে কিছুই বলেননি!
(৩)
২১ শে ফেব্রুয়ারি যেমন বাংলাভাষার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় দিন, একইভাবে ১৯শে মে আরেক পুণ্যদিন। ১৯৬১ সালের এই দিনে আসামের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষায় এগারো জন প্রাণ দিয়েছিলেন। একইভাবে মানভূমের ভাষাআন্দোলন আমাদের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। অতুলচন্দ্র ঘোষ, ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, ভাবিনী মাহাতো প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে এঁরা পুলিশি অত্যাচার সহ্য করেছেন, কারাবরণ করেছেন। অবশেষে এঁদের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ফলে ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। লেখক(!!!) কিন্তু এঁদের আত্মত্যাগ নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি! বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেই নিয়োজিত ছিলেন!
লেখক তাঁর লেখায় গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নিয়েই বেশি উৎসাহী প্রকাশ করেছেন। অবশ্য এই ধরনের লেখা এই প্রথম নয়, এর আগেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এই ধরনের কদর্য আলোচনা তিনি করেছেন। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কোনো আলোচনা না করে তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনে উৎসাহিত হয়েছেন ! আসলে তিনি নিজেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন! সেজন্যই এইসব কুৎসিত লেখা বের করতে পারেন! তাঁকে শুধু নজরুলের অসামান্য পঙক্তিদ্বয় মনে করিয়ে দিই;
"হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।"
খুব স্পষ্টভাবে বলতে গেলে এই লেখাটি চূড়ান্ত উদ্দেশ্যমূলক ও ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিপূর্ণ। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধ, ভালোবাসা থেকে এই লেখা উৎসারিত হয়নি; লেখা হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এই লেখায় মাতৃভাষা প্রসার ও প্রচারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই; শুধু আছে সাম্প্রদায়িক চিন্তার কুৎসিত উন্মাদনা! সেজন্যই সাহিত্যে তিনি হিন্দু-মুসলমান টেনে এনেছেন!
লেখককে অনুরোধ, এই ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির প্রকাশ পরিত্যাগ করে যথাযথ গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করুন। যদি সত্যিই মাতৃভাষাকে ভালোবেসে থাকেন, তবে মাতৃভাষার উন্নয়নে সচেষ্ট হোন। ভায়ে ভায়ে বিরোধ সৃষ্টি করে মাতৃভাষার মর্যাদাবৃদ্ধি করা যায়না, বরং তার অসম্মান করা হয়!
সবশেষে গোরা উপন্যাসের সেই অসামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করছি, " নিন্দা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরো পাপ ও স্বজাতির মিথ্যা নিন্দার মতো পাপ অতি অল্পই আছে।"