এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দুই ভাই আর এক টুকরো কিশোরবেলা 

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ জুলাই ২০২৩ | ৬৩৪ বার পঠিত


  • Since you are God’s dear children.
    You must try to be like Him.
    Your life must be controlled by love.
    Just as Christ loved us and gave His life for us.
    As a sweet-smelling offering and sacrifice.
    That pleases God.

           ‘মানুষ’ কেমন হওয়া উচিৎ --- বজ্রাদপি কঠোরানি মৃদুনি কুসুমাদপি --- বজ্রের চেয়েও কঠোর, কুসুমের চেয়েও কোমল। কুসুমের মতো কোমল মন নিয়েই তো সে জন্মায়। সে যা দেখে তার মধ্যেই বিস্ময় লুকিয়ে থাকে। প্রতি মুহূর্তের প্রাকৃতিক বিস্ময়তার সাথে সাথে মিলিয়ে নেয় অন্তরের কল্পনার বিস্ময়তাকে। আর সে চায়, তার কাছের মানুষজনও এই কোমলতাকে মায়ময় স্নেহময়তা দিয়ে ঘিরে রাখে, আগলে রাখে। যেমনটা এক কিশোর চায়, ঠিক তেমনটা করেই গড়া সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস – রুকু সুকু।

           রুকু আর সুকু। দুই ভাই। কেমন তারা? “দাদু রুকুর নাম রেখেছেন ‘ভালমানুষ’। সত্যিই সে ভালোমানুষ, ধীর, স্থির। এক জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারে। নিজের মনে, নিজের ভাবেই থাকে। ভাল বই পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। সুকুর নাম রেখেছেন ‘পালোয়ান’। ছটফটে পালোয়ান। সব সময় একটা-না-একটা কিছু তার মাথায় ঘুরছে। এক জায়গায় পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কাজ চাই, কাজ। সুকুর কাজ অনেক সময় বড়োদের মতো অকাজ। সুকুর ভয়ে সবাই তটস্থ।” তাদের বাবা ডাক্তার মুখার্জি। মা রাজ্যেশ্বরী সুগৃহিণী। দাদু সুধীরঞ্জন বার্মার খনির একদা ইঞ্জিনীয়ার, দাদুর বন্ধু প্রাক্তন মেজর কালী মুখার্জি। মোটামুটি এই ছয়টি চরিত্র। মূল চারটি চরিত্র নিয়ে যে লীলাবতী ঘর তৈরী হয়েছে ডালটনগঞ্জের জঙ্গলঘেরা পাহাড়ী বাংলোতে, সেই মায়াময় পরিবারটি কেমন? মাতামহের ভাষায়, “তোর সংসার একেবারে জমজমাট। মনে হচ্ছে ভগবান যেন নিজে হাতে, নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়েছেন। ... ভগবান আছেন এবং তোমাদের মধ্যেই আছেন।” জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে যে দাদু দেখেন --- “জীবন যেন একটা চৌবাচ্চা। এক নল দিয়ে জল ভরা হচ্ছে, আর-এক নল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও খালি হচ্ছে না। এক দিকে সুখ, এক দিকে দুঃখ।... এই বয়সে জীবন খেলা ছাড়া আর কী!”

           কিশোরের দেখার চোখ কেমন হওয়া উচিৎ? বিশেষত যে কিশোর পরিবেশের অত্যন্ত কাছে থেকে বড়ো হচ্ছে, কলকারখানার নিরেট কঙ্কাল থেকে অনেক অনেক দূরে। সে উৎসাহী চোখ মেলে দেখতে চাইছে দুনিয়াটাকে, যে দুনিয়া পৃথিবী বিচ্ছিন্ন নয়, পৃথিবীর সাথে মিশে আছে। যার মধ্যে কোন মন্দ নেই, অসচ্ছতা নেই, দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ --- “... দেখতে ভালোবাসে রুকু। গ্রীষ্মের দুপুরে একটা পিচফল হাতে নিয়ে সেগুনের ছায়ায় চুপ করে বসে থাকো। চারদিকে লু ছুটছে। আকাশের গায়ে তামাটে পাহাড়। একটা ভোমরা এলিয়ে পড়া ফুলের ইঞ্চিখানেক দূরে ভোঁ ভোঁ করছে। মাঝে মাঝে ছোঁ মেরে গর্ভকেশর থেকে পরাগ আর মধু তুলে আনছে। সেগুনের তলার ঝোপে এক ডাল থেকে আর-এক ডালে মাকড়শা ঝুলে ঝুলে জাল বুনে চলেছে। পিঁপড়ের সারি চলেছে পিঠে ডিমের বোঝা নিয়ে। এই টুকটুকে সোনালী মাছি মায়ের নাকের নাকছাবির মতো ফিনফিন করে উড়ছে।” সে জানে --- “জীবন পুষে রাখার জিনিস নয়, জীবনকে উড়িয়ে দিতে হয় পাখীর মতো।” 

           আমি হারিয়ে যাই আমার নিজের কিশোরী বেলায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে যে বেসামাল ঢেউ বয়ে যায় আমি সেই ঢেউয়ে নিজেকে এলিয়ে দিতে চাই। একদা আমার বুকের ওড়না দিয়ে যে গাছের ডালে দোলনা বানিয়ে চড়েছিলাম, ছিঁড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে কোমরে চোট পেয়েছিলাম, এমনকি ধুলোমাখা মুখ নিয়ে বাড়ীতে গিয়ে পিটানি খেয়েছিলাম, সেই দু-টুকরো ওড়নাটাকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। সুপুরী গাছের খোলায় চড়ে গাড়ী গাড়ী খেলতাম। ভাই টানত, দাদা টানত, দিদি টানতো, পাড়ার বন্ধুরা টানতো, রেস হতো। মাটির রাস্তা দিয়ে উড়ে যেত আমাদের পঙ্ক্ষীরাজ, ধুলো উড়ত, পাথরের টুকরো ছিটকে যেত। তারা আজ কই? তাদের কিশোরবেলার সাথে সাথে আমার কিশোরীবেলাও কোন আমগাছের কোটরে রাখা আছে কাঁচা আম ছেলার বড়ো বড়ো দুটো ঝিনুকের সাথে। কাসুন্দি আর কাঁচা লংকার সেই ঝাঁঝ আর ঝাল বুনো ঝোপের আড়ালে ফুলের বনে মিশে গেছে, আর সে ফিরে আসে না। স্মৃতি থাকে।

           দুঃখ আছে। মৃত্যু আছে। দাদু মারা যান এক রাত্রে। দাদুর বন্ধু মেজর মুখার্জি নিখোঁজ হন আরেক দিন। বন্ধুর শোকে তিনি কি আত্মহত্যা করেন? “ডক্টর মুখার্জি পায়ে পায়ে খাদটার ধারে এলেন। ধাপে ধাপে নেমে গেছে বড় গাছ ছোট গাছ। ডালে ডালে শকুন বসে আছে। ... কিছু উড়ছে, কিছু উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসছে। নির্জন পাহাড় আর বনানীতে যেন তাণ্ডব চলছে। মৃতদেহ-লোভী কিংবা মানুষ! ডক্টর মুখার্জি স্তব্ধ হয়ে খাদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক নীচে প্রবহমান পাহাড়ি নদীর জল রোদে চিকমিক করছে। জোরে হাওয়া বইলে নাকে একটা গন্ধ এসে লাগছে। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে মাঝে মধ্যে একটা-দুতো আলগা পাথর গরিয়ে পড়ছে। সেই অসীম নির্জনতা, উদ্ধত পাহাড়, শকুনের পাক খাওয়া, লাট খাওয়া খ্যা খ্যা, সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে ডক্টর মুখার্জির মনে হল, জীবন বড় ভীষণ।”

           এই ভীষণে-সুন্দরে উপন্যাস রচনা করেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সেখানে যেমন একটি বাচ্চা মেয়ে জ্বরের ঘোরে আতঙ্কে বলে ওঠে, “আর মেরো না বাবা, ভীষণ লাগছে।” তেমনি একটি বাচ্চা ছেলে বলতে পারে, “জানো মা, ভগবান আছেন, আমি প্রমাণ পেয়েছি।”

    ==========================

    রুকু সুকু
    সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
    আনন্দ পাবলিকেশান
    মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন