এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের অফিসাররা কেন কথা কন না, মোটামুটি আকারে ইঙ্গিতে কাজ চালান, তা স্পষ্ট হতে হতে যে আজ দুপুর হয়ে যাবে তা জানা ছিল না। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বেশ কিছু জিনিসের "দুধ কা দুধ, পানি কা পানি " অবস্থা হবে। আমরা যে হোটেলে এসে উপস্থিত হলাম, তা নোমাড বিজনেস ব্র্যান্ডের গোটা কতক তারা খচিত হোটেল, এক্কেবারে পার্লামেন্ট হাউসের তিন চারটে বাড়ির পরেই।
আগের হেটেল ছিল সুখবাতার স্ট্রীটে, যেটা বোগি ক্যানসেল করিয়েছে। এখানে নানান নামকরা গানের দল এসেছে, সেসবের ফোটো ঝোলানো আছে রিসেপশনের দেয়ালে, যেমন বনি এম।
এদিকে আমার তুমুল হিসি পেয়েছে। ঘরে তো এত সকাল সকাল ঢুকতে দেবে না, তাই লাগেজপত্র জমা রেখে, রেস্টুরেন্টের টয়লেটের দিকে দৌড় দিলাম।
এখানে টাকা পয়সা ক্রেডিটকার্ডের সীন নেই, যা দেবার বোগিকেই দেব।
ইদ্রের সঙ্গে এরপরে আমরা বোগির অফিসে গিয়ে পৌঁছলাম।
একটু পুরোন গোছের রংচটা বাড়ির একতলার একটা চাকচিক্যহীন অফিসে বোগির অফিস। মানে যা দেখলাম বোগিই মালকিন। তরুণী মহিলা, মেরেকেটে পঁয়ত্রিশ, যেমন সুন্দরী তেমনি স্মার্ট, হাতে লেটেস্ট মডেলের আইফোন। বোগি একটা কাগজে খশখশ করে ক্যালকুলেশন করল, সেটাকে তিনহাজার ছশো দিয়ে ভাগ করে আমার কাছে তেরোশো বিশ ইউরো চাইল। ক্যাশ। দিয়ে দিলাম। বোগি জানালো এক ইউরো হচ্ছে মঙ্গোলিয়ান কারেন্সিতে তিনহাজার ছশো। এবার বলল যে ড্রাইভারের যাবতীয় খাবার দাবারের খরচ পড়বে মীল প্রতি সাত ইউরো। তা আট দিনে ষেলোটা মীল মানে ষোলো ইন্টু সাত, আমি ক্যাশ ইউরো ড্রাইভার্র হাতে দিতে তার কী আনন্দ! ব্রেকফাস্ট তো সব হোটেলেই থাকবে, তাই সেসবের খরচ আলাদা করে কিছু নেই। বোগির জন্য উপহার এনেছিলাম, সেটা দিয়ে, বিদায় নেবার আগে বোগিকে বললাম একটা রসিদ লিখে দিতে। সে তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিল।
এখন আমাদের সামনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের যাত্রা।
ইদ্রেই কে নিয়ে আমরা চললাম শপিং মলে। সেখানে একটা ব্যাংক রয়েছে, অন্ততঃ হাজার খানেক ইউরো লাগবে সামনের দিনগুলোয়, পেট্রলের খরচ, টোল ট্যাক্স, খাবার দাবারের খরচ, কোনও দর্শনীয় জায়গায় ঢুকবার এন্ট্রি ফি। ব্যাংকে গিয়ে দেখি ইউরোর দাম তিনহাজার সাতশো পয়ষট্টি। প্রতি ইউরো বোগি আমাকে একশো পঁয়ষট্টি করে বেশি দাম নিয়েছে।
মনটা একটু তেতো হলেও আমরা দমি নি। লাঞ্চ্র সময় হয়ে গেছে, ইদ্রেই আমাদের নিয়ে চলল একটা রেস্টুরেন্টে। সে খুব কমদামী খাবার খেল, আমরা দামী খাবার খেয়েও দুজনে বারো ইউরোর বেশি খরচ করতে পারলাম না। জিনিসটা বাজে হচ্ছে, লোকটাকে টাকা দিয়েছি ঠিকই, সে খরচ বাঁচাবে এটাও ঠিক, কিন্তু এভাবে তার সামনে বসে আমরা ভাল ভাল খাব দিনের পর দিন, মন মানতে চাচ্ছে না। আমরা মোমো নিয়েছিলাম। সেফ সাইডে থাকার জন্য বাবু নিয়েছিল নুডলস। মঙ্গোলিয়ায় মাংস প্রায় ফ্রি, দাম নেই বললেই চলে। তবে মোমো খাবার শখ যদি কেউ ঘোচাতে চায়, দিন দশেক মঙ্গোলিয়ীয় থাকলেই জন্মের মত সাধ (এবং স্বাদ) মিটে যাবে।
এহে বলতেই ভুলে গেছি, ব্যাংকে যারা কাজ করছিল, তারাও কথা বলে না। ঠিক এয়ারপোর্টের মতো। আমি ইংরিজি বললেও চুপ করে তাকিয়ে থাকে, রাশিয়ান বললেও ঐ, জারমান ফ্রেঞ্চ সবেতেই চুপ, বাংলা বলবার ভাবনাও মাথায় এসেছিল। অনেকগুলো ইউরে ভাঙানো হচ্ছে, কারেন্সীগুলো আগে চেখো দেখি নি, রেট কতো জানতে চাচ্ছি, কিন্তু লোকগুলো সব চুপ করে রয়েছে, বাধ্য হয়ে ইদ্রেইকে কাছে ডেকে কথা বলাতে পারলাম। এরা মঙ্গোলিয়ান ছাড়া আর কোলও ভাষা জানে না। এয়ারপোর্ট রহস্যের সমাধান হলো।
পরবর্তী দিনগুলোর জন্য শুকনো স্ন্যাক্স, বিস্কুট ইত্যাদি, চব্বিশ লিটার পানীয় জল এবং প্রচুর কোকাকোলা মিরিন্ডা গাড়িতে বোঝাই করা হয়েছিল।
রেস্টুরেন্টের সেই বিখ্যাত মোমো খাবার পরেই আমার মেজাজ বিগড়ে গেছল। আর মেজাজ বিগড়োলেই আমি কী করি সবাই জানে, বিশেষ করে কোনও দেশে বেড়াতে গেলে। একটা বিউটি সালোন খুঁজে বের করে চুল কাটাই। ঐ অঞ্চলে অনেক বিউটি সালোন, তিন চারটেয় ট্রাই মেরে শেষে যেটায় ঢুকলাম সেটা প্রায় ফাঁকা, আধঘন্টা ওয়েটিং টাইম। কথা বলার স্কোপ দিল না যে মহিলা চুল কেটে দেবে। মাথা শ্যাম্পু করিয়েই তার ফেন থেকে গোটা দশ পনের স্টাইলের হেয়ারকাটের ফোটো বাবুকে দেখিয়ে তার মধ্যে থেকে একটা পছন্দ করিয়ে স্যাটাস্যাট চুল কেটে দিল।
দাম দেবার সময় ইদ্রেই আমাদের দোভাষী। সেই ইদ্রেই ও মহিলাটির সঙ্গে ভাষায় কব্জা করতে পারছে না।
দাম চুকিয়ে হোটেলে ফেরার পথে ইদ্রেই বলল যে মহিলাটি মঙ্গোল ভাষা জানে না, সে কোরিয়ান।
ইদ্রেই আজ গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যাক, কাল সকাল থেকে আমাদের লম্বা জার্নি।