এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • [বাংলা] ছবির ব্যবসা

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ৪৯৭ বার পঠিত
  • | | | | | | | |
    এই পর্বে চলুন একটু বাংলা ছবির ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। খুব বেশিদিন আগে নয় , মোটামুটি সত্তর বছর পিছিয়ে গেলেই আপাতত চলবে। সেসময় সারা পৃথিবীতে ছবিতে সত্যিকারের কোনো লোকেশনে শুটিং হত না। সমস্ত শুটিং হত বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি এক একটা স্টুডিওর সেটের ভেতর। কলকাতার টালিগঞ্জের সেরকম স্টুডিওগুলো ছিল ইন্দ্রপুরী , টেকনিশিয়ান্স ষ্টুডিও (সরকারি), এনটি ওয়ান। ক্যামেরা জিনিসটা তখন এত বড় আর ভারী ছিল যে সেটা স্টুডিওর বাইরে বের করার ঝক্কি পোহাতেন না কেউ। ইনডোর সেট ছাড়াও স্টুডিওর ভেতর বহু আউটডোর সেট তৈরি থাকত [ ইতিহাসে আশ্রিত ছবির গল্পের জন্য মন্দির , রাজাদের প্রাসাদ ইত্যাদির তৈরী করা ছাঁচ ] , শুধু সময়মতন স্টুডিও ভাড়া নিয়ে ছবির শুটিং শুরু করে দিতেন এক্সরা। 

    সেই সময় অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে আস্তে আস্তে ম্যাটিনী আইডল হয়ে উঠছেন উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন। এক্স-ওয়াই-জেড দের ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। সেসময় বাংলা ছবির ফাইনান্সার মূলত হতেন কলকাতার অবস্থাপন্ন জমিদার বাড়ির অল্পবয়েসী লায়েক ছেলেরা [যেমন নবারুণ ভট্টাচার্যের 'হার্বার্ট' উপন্যাসে হার্বার্ট সরকারের বাবা ] অথবা যুদ্ধের বাজারে লোহার ব্যবসা বা খাবার , কাপড়ের কালোবাজারি করে হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা ব্যবসায়ীরা। জেডদের বেশিরভাগ ছবিঘর তখন কলকাতা ভিত্তিক , আরো ভালো করে বললে উত্তর কলকাতা ভিত্তিক। কর্পোরেট ওয়াইদের আগমন তখনো বহুদূর , দুতিনটে হলের মালিক বা এক্সরা নিজেরাই তখন ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াই হয়ে যেতেন। এই ষ্টুডিও সিস্টেমে এক্সদের ভরসার পাত্র ছিলেন তপন সিনহা , অজয় কর , অসিত সেন , পীযূষ বসু , তরুণ মজুমদাররা । আর ষ্টুডিও সিস্টেমের বাইরে সমান্তরাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাজ করতেন সত্যজিৎ , মৃণাল , ঋত্বিক , রাজেন তরফদাররা । কয়েকজন দক্ষ ছবি কুশলী[টেকনিশিয়ান] রা একসঙ্গে 'অগ্রদূত' নামে ছবি পরিচালনা করতেন,  যেটা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায়নি। 

    পরের তিরিশ বছর ধরে মোটামুটি এই ব্যবস্থাই চলছিল যার ভিত্তি কেঁপে গেল ১৯৮০ সালে উত্তমকুমারের আচমকা মৃত্যুর পর। একই সঙ্গে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে কিছু অর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আসে , যার মধ্যে প্রথমেই ছিল অপারেশন বর্গা। যার ফলে গ্রামের কৃষকদের হাতে ধীরে ধীরে টাকা জমতে শুরু করে , গ্রামে যাত্রার পাশাপাশি মাঠে পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখানো শুরু হয়। জেডরা শহরতলিতে শ্রমিকদের চটকল এবং অন্যান্য কারখানার বেল্টগুলোতে [চুঁচুড়া থেকে হাওড়া, কল্যাণী থেকে বজবজ] প্রচুর সিনেমাহল খুলতে শুরু করেন। 
     
    অর্থাৎ বাংলা ছবি নামক পণ্যের টার্গেট অডিয়েন্স শহরের দর্শক থেকে মফস্বল এবং গ্রামের অভিমুখে বদলে যাওয়া শুরু হল। বাজার চলে চাহিদা এবং যোগানের নিয়ম অনুযায়ী। চাহিদামত যোগান দিতে গিয়ে বাংলা ছবিতে এক্স আর ফাইনান্সার দের পার্থক্য হঠাৎ মুছে গেল । ভালো এক্স হতে গেলে ছবি কিভাবে বানাতে হয় সে বিষয়ে জানা জরুরি , কিন্তু ফাইনান্সার চালকল মালিকরা সেসব না জেনেবুঝে নিজেরাই রাতারাতি ছবি বানাতে শুরু করলেন। অতঃপর যে সমস্ত 'ছবি' তৈরি হওয়া শুরু হল তাদের টেকনিক্যালি 'ছবি' বলা খুব সমস্যার , একটা ফিল্ম ক্যামেরাতে যাত্রা রেকর্ড করে সেটাকে ছবি বলে চালানো হলে মুশকিল। দুটো মাধ্যম আসলে তো অনেকটাই আলাদা। 
     
    বাংলা ছবির দর্শকদের মধ্যে আড়াআড়ি ফাটল ধরে গেল। ভালো ম্যাটিনি আইডলের অভাবে শহরের মধ্যবিত্ত দর্শকরা পুরোপুরি ঝুঁকে পড়লেন টেলিভিশন আর হিন্দি ছবির দিকে। নব্বইয়ের দশকে গিয়ে এদের পরিবারের ছেলে মেয়েরাই হিন্দি ছবির খান দের পয়লা নম্বর ভক্ত হয়ে উঠবেন। 
     
    এই আশির দশক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সত্যজিৎ এবং মৃণাল তাদের প্রযোজক বদলে ফেলেছেন যা আদৌ কাকতালীয় নয়। তাদের ছবি তখন প্রযোজনা করছেন NFDC , দূরদর্শন , পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই সরকারী ফান্ডেই মূলত ছবি বানাতে শুরু করলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত , গৌতম ঘোষ , অপর্ণা সেন , নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় , উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। নব্বইয়ের দশকে এলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। কিন্তু এদের ছবি বেশিরভাগ কলকাতার দর্শককে হলে আর টেনে আনতে পারেনি। অথচ টিভিতে 'উনিশে এপ্রিল' বা 'পারমিতার একদিন' দিলে বাড়িতে সবাই দেখতে বসে যেত। অনেকটা আজকের 'এই ছবিটা হলে গিয়ে দেখে কাজ নেই, ওটিটিতে দেখে নেবো'র মতোই অবস্থা। 
     
    নব্বইয়ের শেষ থেকে ধীরে ধীরে প্রচলিত ষ্টুডিও ধারার বাংলা ছবিতেও ভাঁটা পড়ছিল কারণ তখন শহর এবং মফস্বল দুজায়গাতেই তাদের টার্গেট অডিয়েন্সরাও ঝুঁকে পড়েছিলেন হিন্দি ছবির দিকে। অতঃপর হাতে রইল পেন্সিল , সেটাকে সামলাতে এল দক্ষিণী ছবির রিমেক এবং অভিনয়ের নতুন মুখেরা। কিন্তু টার্গেট অডিয়েন্স কমতে কমতে তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ছবি প্রায় স্বতঃসিদ্ধর পর্যায়ে চলে গেছে। এখানে জন্মালেই সবাই প্রথম থেকে হিন্দি ছবি দেখতে শুরু করে , বাংলা ছবি দেখার কথা ওঠেই অনেক পরে। সেটা সামলাতে ধীরে ধীরে বাংলা ছবিতে দুটো নতুন জিনিসের হাত ধরে আবার শহুরে দর্শককে হলে টেনে আনা শুরু হয় - টেমপ্লেট বা চালু ছাঁচের নকল এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি। এগুলো নিয়ে পরের পর্বে লিখছি। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন