এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • [বাংলা] ছবির ব্যবসা

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ৪৪৩ বার পঠিত
  • | | | | | | | |
    এই যে এত এক্স ওয়াই এবং জেডদের কথা হল , এদের বাইরেও ছবির ব্যবসার ক্ষেত্রে একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা চালু আছে এবং সেই পরিবেশনা এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে অনুসরণ করা হয়  । 
     
    ধরে নেওয়া যাক আপনার একটা ছবি বানানোর ইচ্ছে কিন্তু কোনো এক্স আপনার ছবিটা করতে রাজি হলেন না। অগত্যা আপনাকে সমবায় পদ্ধতিতে ছবিটা বানাতে হবে। নিজেকেই টাকাপয়সা জোগাড় করতে হবে , যারা অভিনয় করবেন তাদেরকে বলতে হবে অল্প টাকায় কাজ করার জন্য , নিজেকেই পরিচালনার পাশাপাশি ক্যামেরা এডিটিং সব করতে হতে পারে ইত্যাদি। বা এখন মোবাইলেও হয়ত আপনি একটা ছবি তুলে ফেললেন , বানালেন একটা ছোট দৈর্ঘ্যের ছবি। কিন্তু ছবিটা সবাইকে দেখাবেন কি করে ? প্রচলিত উপায়ে ছবিটা বানাননি বলে ওয়াইরা আপনার ছবিটা নেবেন না , ফলে হলে মুক্তি পাবার আশা একরকম বন্ধ। অন্য অনেক রকম রাজনৈতিক বা সেন্সর বিষয়ক কারণও থাকতে পারে যাতে একটা ছবি হলে দেখানো যাবে না। এই ধরনের ছবি মূলত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি হিসেবে পরিচিত।  

    এই রকম সমান্তরাল ছবিদের ক্ষেত্রে একমাত্র আশা নানারকম চলচ্চিত্র উৎসবে তাদের ছবিগুলো পাঠানো যাতে অল্প হলেও কিছুলোক সেগুলো বিশেষ হলে দেখতে পায় এবং সামান্য কেনাবেচার একটা ব্যবস্থা করা যায় । আরেকটা রাস্তা ইন্টারনেটে প্রায় বিনামূল্যে ছবিটা ছেড়ে দেওয়া , ভিউ কমসংখ্যক হয় বলে সেখানে মনিটাইজেশন করা মুশকিল। অনেকে ছবি আপলোড করে দর্শকদের ঐচ্ছিক ডোনেশন বা ক্রাউডফান্ডিং [ছবিটা দেখার লিংক পাঠানোর বদলে এককালীন চাঁদা] করে চালান। 

    একসময় এই সমান্তরাল ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সরকার ইউএসএসআর এবং ভারতের মত দেশে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল । তারাই ছবি তৈরির টাকা দিত এবং ওয়াইয়ের ভূমিকাও পালন করত। পথের পাঁচালী ইন্ডিপেন্ডেন্টলি দু তিন বছর শুটিং করার পরে বাকি টাকা পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিয়েছিল বলে শুটিং শেষ হয়েছিল এবং ছবি হলে মুক্তি পেয়েছিল । পরবর্তীকালে 'হীরক রাজার দেশে' তৈরিতেও টাকা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাংলা ছাড়াও ভারতে অন্যত্র নানাবিধ ভাষার ক্ষেত্রে বহু ছবির তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NFDC) র সদর্থক ভূমিকা ছিল। 'মসফিল্ম' না থাকলে যেমন একইভাবে ইউএসএসআরে আন্দ্রেই তারকোভস্কি তার ছবিগুলো বানাতে পারতেন না। উল্টোদিকে ইউএসএ তেও আছে সানড্যান্স ইনস্টিটিউট যারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি বানাতে সবরকম সাহায্য করে এবং উৎসাহ দেয়। 

    বাংলা ছবিতে ব্যবসার ক্ষতির মূল সূত্রপাত হয়েছিল যখন এক্সরা একসময় 'ফেস্টিভ্যাল ছবি' বানাতে বেশি উৎসাহিত হয়েছিলেন যাতে আখেরে ক্ষতি হয়েছিল ফাইনান্সার এবং জেডদের। এই অভিঘাত সামলাতে না পেরে গত কুড়ি বছরে বাংলা ছবি মূলত শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে এবং বহু হল বন্ধ হয়ে গেছে। এক্স ওয়াই জেডদের বেঁচে থাকার জন্য দক্ষিণী ছবির রিমেক করতে হয়েছে। বাংলা ছবির বাজেট গত দশবছরে কিছুই বাড়েনি। আক্ষরিক অর্থেই এমন টানাটানির সংসার যে পনেরোদিনের মধ্যে তাদের ছবির যাবতীয় শুটিং শেষ করতে হয়।  বাংলা ছবির গড় বাজেট এক কোটি হলে বছরে হাতে গুনে চার পাঁচটা ছবি হয়ত পাঁচ কোটির বক্স অফিস অতিক্রম করতে পারে ।  

    দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম তিনটে উপায়ে ছবি মুক্তির আগেই এক্সরা টাকা তুলে নিতে পারেন। সেগুলো ছাড়াও আরো উপায় হল ছবির ভেতরেই বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং নানারকম 'পার্টনার' জোগাড় করা। যেমন ধরা যাক একটা ছবিতে দেখলেন সবাই ম্যাক ব্যবহার করছে এবং অ্যাপলের লোগোটার ওপরে মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত ফোকাস করা হচ্ছে। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না , অ্যাপল তাদের সংস্থার বিজ্ঞাপন হিসেবে এক্সকে কিছু টাকা দিয়েছে। অথবা ছবিতে দেখানো হল নায়ক নায়িকা কোনো রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন , হঠাৎ রেস্তোরাঁর নামের ক্লোজ আপ দেখানো হল। এটাও বিজ্ঞাপন। এছাড়া ধরা যাক যেসব দোকান ছবিতে কস্টিউম ডিজাইনের গয়না বা পোশাক বিনামূল্যে ভাড়া দিলেন তারা হয়ে গেলেন ছবিটার জুয়েলারি পার্টনার বা কস্টিউম পার্টনার। ছবির শুরুতে এদের নাম দেখানো হয়।

    ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি বানানো হলেও তা যে শুধু উৎসবের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকবে তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিককালে দুটো এরকম ছবি হলে মুক্তি পেয়েছে - 'দোস্তজি' এবং 'ঝিল্লি'। এই ছবিদুটো বানানোর খরচ হয়ত ছবির নির্মাতাদেরই এদিক ওদিক থেকে জোগাড় করতে হয়েছে কিন্তু পরে ওয়াইরা ছবি দুটো পরিবেশনার জন্য সেই দাম দিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে একটা সমবায় পদ্ধতিতে বানানো ওয়েব সিরিজ হচ্ছে 'শাটিকাপ'। এটাও বানানোর সময় বাজেটের টাকা এদিক ওদিক থেকে পরিচালক বা কলাকুশলীরা নিজেরা জোগাড় করলেও বানানোর পর দেখানোর জন্য দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে বাংলাদেশের একটি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম।    

    ছবির সম্পর্কে প্রায়ই বাণিজ্যিক ছবি এবং শৈল্পিক ছবি ধরনের একটা বিভেদ দেখা যায় যা আসলে পুরোটাই কাল্পনিক। যতক্ষণ ছবিরা ছবি নামক মাধ্যমের ব্যাকরণ মেনে নির্মিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত ছবি একই সঙ্গে বাণিজ্য এবং শিল্প। যেকোনো ছবির নির্মাণই হয় দর্শকের দেখার জন্য ,  শুধু  তাদের টার্গেট অডিয়েন্স আলাদা আলাদা।  অনেকের কাছে ছবি মানে দুঘন্টা একটা ঠান্ডা ঘরে হালকা ভাবে সময় কাটানো আবার অনেকের কাছে ছবি মানে ভাবনাচিন্তা করার একটা জায়গা। যেমন ফ্যাশন ট্রেন্ড অনুযায়ী ছেঁড়া ফাটা জিনস এখন বেশি বিক্রি হয় অল্প বয়সীদের মধ্যে কিন্তু মাঝবয়সীদের জন্য অন্য পোশাকেরও বিক্রী ভাল। সেরকমই এমন কোনো ছবি বানানো আপাত অসম্ভব যা সমাজের সমস্ত শ্রেণীর মানুষের ভালো লাগবে। 
     
    যেহেতু আপনি ছটা পর্বে ছবির ব্যবসা সম্পর্কে বিশদে জানতে পারলেন তাই এবার থেকে কেন আপনার চোখে একটা আপাত বাজে ছবি বক্স অফিসে সুপারহিট হল বা হইচই তে কেন বছরে মাত্র দু তিনটে ভালো সিরিজ আসে সেই বিষয়ে আর অভিযোগ করার দরকার নেই , ছবিকে একটা দু ঘন্টার ভোগ্যপণ্য হিসেবে ভেবে নিলেই উত্তরগুলো পেয়ে যাবেন। 
     
    [সংযোজন]
    চলচ্চিত্র উৎসবের টই -
    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=26345
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন