এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • কে সি পালের ভায়রাভাই (ছোটগল্প)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ০৫ মার্চ ২০২২ | ১১৮০ বার পঠিত
  • কে সি পালের ভায়রাভাই

    দিনটা ছিল শনিবারের বারবেলা।

    রাসবেহারি মেট্রো স্টপেজে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আপনার চোখ গেল উলটো দিকের ফুটপাথে। ওখানে হেব্বি গ্যাঞ্জাম! আমোদ গেঁড়ে লোকজনের ভিড়। আপনার কৌতুহলী চোখ সব ব্যাপারেই উৎস খোঁজে, কারণ খোঁজে। দেখতে পেয়েছেন একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে,  তার ছাদে একটা তারের জালের ছাতামত। আপনি যুক্তিবাদী, ব্যাপারটা ঠিক ধরে ফেলেছেন।

    ও হরি! নিশ্চয়ই কোন নিউজ চ্যানেল। আর পাবলিক চাইছে ক্যামেরার সামনে নিজেদের চেহারা দেখাতে। এই ফাঁকে যদি প্রাইম টাইমে এক ঝলক নিজেকে টিভির পর্দায় দেখা যায়। যদি  বৌ-বাচ্চার কাছে বেশ ঘ্যাম নেওয়া যায়! কিন্তু ম্যাঙ্গো পাবলিকের হাভাতেপনা নিয়ে যতই নাক সিঁটকান না কেন, আপনিই বা কম কিসে? কৌতূহল চাপতে না পেরে আপনিও ভিড়ের মাঝখানে কারোর কনুইয়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ঠেলে ঠুলে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

    ফুটপাথের উপর চেয়ারে বসা একটা লোক, মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফের চোটে তাকে মহেশ যোগীর ভাই বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। অমনই স্মিত হাসিমুখ। ওর চোখ  দেখছে একবার হাতে মাইক ধরা মেয়েটিকে আর একবার আলতো ভাবে ঘুরে যাচ্ছে চারপাশের ভীড়ের অস্পষ্ট চেহারার ওপর।

    আপনি এবার মন দিয়ে লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। যখন এত লোক জমেছে, নিউজ চ্যানেলের ভ্যান এসেছে, ক্যামেরা হাতে একজন ফোকাস করছে ওই লোকটিকে এবং অল্পবয়সী সুশ্রী অ্যাংকর ভদ্রলোকটির কানের কাছে ফিসফিস করছে তখন কিছু একটা নিঘঘাৎ হয়েছে। অ্যাই দেখুন, আপনি লোকটিকে ইতিমধ্যে ভদ্রলোক ভাবতে শুরু করেছেন। উনি বসে আছেন একটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে, হয়ত মেয়েটির কথায় পাশের চায়ের দোকান ধার দিয়েছে। ওঁর পেছনে একটা তেরপলের তাঁবু, যেমন তেমন করে তিন খুঁটিতে দাঁড় করানো। এর মধ্যে মাথা নীচু করে ঢুকে পড়া যায়, দাঁড়ানো যায় না।

    এবার আপনি অ্যাংকর মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। জীন্স ও সাদা টপ, ছোট করে ছাঁটা চুল। চৈত্রমাসের বিকেলের রোদ্দূরে ঘেমে গিয়েছে। এবার ও এগিয়ে এসে ভীড়কে অনুরোধ করে চুপ করতে, নইলে কাজ করা সম্ভব নয়। তারপর ও ক্যামেরাম্যানকে চেঁচিয়ে কিছু বলে। ভীড় শান্ত হয়, ওরা অধীর অপেক্ষায় রয়েছে কিছু একটা ম্যাজিক দেখবার আশায়।

    একটু কেশে নিয়ে মেয়েটি শুরু করেঃ

    নমস্কার! ‘সংবাদের নেশা’ নিউজ চ্যানেলের তরফ থেকে আমি সুকান্তি দত্ত বলছি। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি রাসবেহারি মেট্রোর মোড়ে। হ্যাঁ, এটাই  সেই ফুটপাথ যেখানে একবছর আগেও একইভাবে তাঁবু গেড়ে বসে  থাকতেন শ্রীযুক্ত কার্তিক চন্দ্র পাল। গোটা কোলকাতা তাঁকে চিনত কে সি পাল নামে। উনি ছিলেন অ্যাস্ট্রোনমির রিসার্চ স্কলার।  সৌরজগতের প্রকৃতি নিয়ে গ্যালিলিওকে ভুল প্রমাণিত করে টলেমির আদি মডেলকেই উনি আবার শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়েছিলেন।  অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না, বরং সূর্য  বছরে একবার করে আমাদের পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এইভাবেই উনি সৌরজগত নিয়ে আমাদের ঋষি মুনির যে প্রাচীন বিশ্বাস , অর্থাৎ সূর্য পূবদিকে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায় , তার পক্ষে রায় দিলেন। লোকে তাঁকে দু’পেয়ে গরু বলেছে, পাগল বলেছে, কিন্তু উনি ছিলেন নিজের বিশ্বাসে  অটল অবিচল।

    অবশেষে আশি বছর বয়সে উনি ফুটপাথের আশ্রয় ছেড়ে হাওড়ায় নিজের পারিবারিক ভবনে ফিরে গেছেন। কিন্তু প্রকৃতির কোলে কোন জায়গাই খালি থাকে না। একবছরও হয়নি, ঠিক সেই জায়গায়  ঘাঁটি গেড়েছেন আর একজন মানুষ, ইনিও পাল-সত্যব্রত পাল। লোকে এঁকেও পাগল বলছে এবং নতুন নাম দিয়েছে ‘ কে সি পালের ভায়রাভাই’।  ইনি কিন্তু কে সি পালের মত বিদ্যুৎ বিভাগের সাধারণ কর্মী ছিলেন না, দস্তুরমত ব্যাংক অফিসার। এবং বেশ মজার মানুষ। উনি শুধু আমাদের চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন এবং আর দশটা বাঙালির মত উনিও রবি ঠাকুরের ভক্ত।  ওঁকে কেউ পাগল বললে উনি বলেন

    (এবার মেয়েটি মাইক ধরে ভদ্রলোকের সামনে)

    --যে তোরে পাগল বলে তুই তারে বলিসনে কিছু।
      আজ যে তোরে কেমন  ভেবে অঙ্গেতে তোর ধূলো দেবে
    কাল প্রাতে সে মালা নিয়ে আসবে রে তোর পিছুপিছু।

    আপনি খেয়াল করেছেন যে ভদ্রলোকের গলার মড্যুলেশন ভাল, ভয়েস থ্রো ভাল। ইন্টারভিউ লেনেওলা মেয়েটির উচিত জিজ্ঞেস করা – আগে উনি কোন শৌখিন নাটকের দলে অভিনয় করেছেন কিনা? অন্ততঃ ব্যাংকের রিক্রিয়েশন ক্লাবে? দু’একবার আবৃত্তি-টাবৃত্তি?

    মেয়েটি এবার ভদ্রলোকটিকে ছেড়ে তাঁর পেছনের দেয়াল ও তাঁবুর দিকে এগিয়ে যায়।

    -- আপনারা আগে কে সি পালের কোলকাতা জুড়ে হাতে লেখা বিজ্ঞাপন দেখেছেন। হ্যান্ডবিল পড়েছেন। এইখানে তাঁবুর গায়ে পিন আঁটা কাগজ, রেখাচিত্র দেখেছেন। এখনও দেয়ালের গায়ে কিছু লেখা রয়েছে। জলে রোদে বিবর্ণ হলেও একেবারে মুছে যায়নি। সত্য কখনও কখনও হারে কিন্তু পরাজিত হয় না।

    এইসময় কিছু পুরনো ফাইল চিত্র দর্শকদের দেখানো হবে। তাতে লেখা ফুটে উঠবেঃ

    পৃথিবী নয়, সূর্য বছরে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। সত্যকে জানুন।
    গ্যালিলিও ভুল, টলেমি ঠিক।
     পৃথিবী ঘোরে না, সূর্য ঘোরে।
    গবেষণালব্ধ পরীক্ষিত সত্যকে জানুন।
    --কে সি পাল।

    --এবার দেখুন, পুরনোর জায়গায় নতুন পোস্টার, নতুন বিজ্ঞাপন।  এভাবেই পুরাতন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দেয়, দিতে হয়।

    (অ্যাই সুনু, এদিকটায় ফোকাস মার। )

    মেয়েটি এবার ক্যামেরাম্যানের দিকে ইশারা করে। ক্যামেরা প্যান করে তাঁবু এবং তার গায়ে পিন দিয়ে আঁটা  কিছু কম্পিউটারে টাইপ করা পোস্টারকে ফোকাসে আনে । ক্লোজ আপে বড় করে ফুটে ওঠে কিছু অক্ষর।

    ‘ রূপল হারাইয়া যায় নাই।
    রূপল এখানেই রহিয়াছে।
    পুলিশ ভুল, আমি ঠিক।
    আমি  প্রজ্ঞার তৃতীয় নয়ন দিয়া সত্যকে জানিয়াছি।'
              --সত্যব্রত পাল।

    -- আপনারা দেখলেন, উনিও এক সত্যের খোঁজ পেয়েছেন।  জোরগলায় ঘোষণা করছেন –রূপল হারিয়ে যায়নি, এখানেই রয়েছে। পুলিশের রিপোর্ট ভুল, তদন্ত ভুল।
    এবার আমরা ওনাকে প্রশ্ন করে ওনার সত্যকে বুঝতে চাইব।

    আপনারা কথা বলা বন্ধ করুন। প্লীজ একটু সহযোগিতা করুন।  মনে রাখবেন, উনি আজ পর্য্যন্ত কোন চ্যানেলকেই ইন্টারভিউ দেননি। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি।

    (অ্যাই এই লাইনগুলো ডিলিট করে দিস।)

     আমার প্রথম প্রশ্নঃ  মিঃ সত্যব্রত পাল, এই রূপল কে?
    --সে কী, আপনি রূপলকে চেনেন না? গোটা কোলকাতা ওকে চেনে। ছত্তিশগড় ওকে চেনে। সমস্ত পুলিশ ওকে চেনে।
    --হ্যাঁ, হ্যাঁ; আমরা সবাই চিনি। তবু ইন্টারভিউ আর দর্শকদের জন্যে যদি একবার বলে দেন। মানে, রূপলের পুরো নাম, তাঁর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

    ক্যামেরার ফোকাস এবার সোজা সত্যব্রত পাল নামক আধপাগলা লোকটির মুখে। এবার ওঁকে একটু কনফিউজড দেখাচ্ছে। আগের হাসি হাসি বালকদাসি ভাবটা আর নেই। ভ্রূ কুঁচকে অসীম মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছেন। তারপর মাথা তুলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
    রূপল পাল আমার স্ত্রী। ও ভবানীপুরের নন্দন রোডের পাঞ্জাবী মেয়ে। আগে নাম ছিল রূপল কৌর।
    --একটু থামতে বলছি মিঃ পাল। আপনি তো ছত্তিশগড়ে চাকরি করতেন। কোন ব্যাংকে?
    -- ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার  কোরবা শহরের শাখায় ক্লার্ক কাম ক্যাশিয়ার হিসেবে জয়েন করেছিলাম। দশ বছর পরে প্রমোশন পেয়ে অফিসার হই।  তারপর আমার ট্রান্সফার হয়ে যায়।
    --তখন কোথায় গেলেন?
    --বিলাসপুরে; ওখানকার সরকন্ডা শাখায়  ফিল্ড অফিসার হয়ে।
    --বেশ; কিন্তু আপনার সঙ্গে রূপলের পরিচয় কোথায় হয়েছিল?
    --বুঝতে পারছেন না? ছত্তিশগড়ের কোরবা শহরে।
    --কিন্তু ভবানীপুরের রূপল কৌর ছত্তিশগড়ে গেলেন কী করে?
    --দাঁড়ান, একটু মনে করি। ও হ্যাঁ, ওর বাবা ট্রান্সপোর্টের বিজনেস করত। তখন কোরবা উঠতি শিল্পনগরী। ওখানে ট্রান্সপোর্ট নগরের শস্তায় জমি পেয়ে উনি গোটা বিজনেসটাই কোরবায় নিয়ে গেলেন। রূপল তখন অনেক ছোট। ওকে ওখানকার বীকন্স ক্রীশ্চান স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। আমিও ওই পাড়ায় থাকতাম। ওই স্কুলে পড়তাম।
    -- তারপর ব্যাংকের চাকরি পেয়ে ওকে বিয়ে করে ফেললেন? আপনাদের কি আজকাল যাকে বলে টুরু লাভ?

    পাবলিক হেসে ওঠে। কেউ কেউ সিটি বাজায়, হাততালি দেয়।

    সত্যব্রত পাল হাত তোলেন।
    --সরি, কথা হচ্ছে আমার স্ত্রীকে নিয়ে। এইভাবে তামাশা করলে আমি আর ইন্টারভিউ দেব না।
    --প্লীজ সত্যব্রতবাবু! আমি ওই জায়গাটা ডিলিট করে দিচ্ছি। আপনি এখানে কথাবার্তা থামিয়ে দিলে আমার চাকরি চলে যাবে। একটু কনসিডার করুন।
    --নো মীন্স নো!
    --আচ্ছা, আমি ওই প্রসঙ্গ বাদ দিচ্ছি। আসল কথায় আসছি। আপনার সমস্যাটা কী ? কেন পুলিশকে ভুল বলছেন?
    --ভাল করে  সাঁটা কাগজগুলো দেখুন। আর আমার এই হ্যান্ডবিলটা নিন। চাইলে এই বান্ডিলটা পাবলিকের মধ্যে বিলিয়ে দিন।
    ক্যামেরা হ্যান্ডবিল বিলির দৃশ্যগুলোকে প্যান করে। লোকজন হুড়োহুড়ি করে চোথা কাগজ নিচ্ছে।  মেয়েটির মুখে পাতলা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আপনি এবার মন দিয়ে মেয়েটিকে দেখছেন—সপ্রতিভ, বেশ স্মার্ট। কিন্তু ঠোঁটের উপরে কি পাতলা গোঁফের ভাব? ওর বোধহয় থাইরয়েড বেড়ে গেছে। এবার আপনি লজ্জা পেলেন। মেয়েটি আপনার ভাইঝির চেয়েও কমবয়েসি।
    আমরা এখন অপেক্ষায় আছি। সত্যব্রত, ইন ফ্যাক্ট, গোটা কোলকাতার দর্শকেরা, গোটা বাংলাদেশ যাঁরা আমাদের চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখেন—সবাই অপেক্ষায় অধীর। কী সেই রহস্য? কী সেই সত্য যার খাতিরে একজন ব্যাংক অফিসার ফুটপাথে বাসা বেঁধেছেন।
    -সেবার আমরা ঠিক করলাম বৈশাখী পরবের একদিন আগে কোরবায় যাব, মানে আমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর নেই, শাশুড়ি আছেন। মানে তখন ছিলেন আর রূপলের ভাই ছিল। সন্ধ্যে হব হব। আমরা কিছু কেনাকাটা করে বাসে চড়ব বলে বিলাসপুরের প্রাইভেট বাস ডিপোতে গেছি। অশোক বাস সার্ভিসের বাসগুলো বেশ ভাল একটু পা মেলে বসা  যায়। সাড়ে তিন ঘন্টার জার্নি।
    এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ধূলোর সঙ্গে মেশে বাসের গ্রীজ আর পোড়া ডিজেল। তাতে বৃষ্টির জল পড়ে প্যাচপেচে কাদা, সাবধানে পা ফেলছি।  মেঘলা আকাশ। কিছু কিছু দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। আমি মন দিয়ে দেখছি কোন বাসটা কোরবা যাবে।  একটা বাসের দিকে রূপল আঙুল তুলল। কিন্তু আমি মানা করলাম, এরমধ্যেই সব সীট ভরে গেছে, লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরের বাস? কিন্তু তাতেও স্যুটকেস রাখার জায়গা পোষাচ্ছে না। রূপল বলল তুমি ওদিকে গিয়ে আলি আহমেদ সার্ভিসের বাসগুলো দেখ। ঠিকমত পেলে টিকিট কেটে সীট নাম্বার নিয়ে আমাকে এসে ডেকে নিও। আমি স্যুটকেসগুলো নিয়ে এখানেই ওয়েটিং রুমের বেঞ্চে বসে থাকছি।
    ঠিক কথা। আমি খুঁজে পেতে আদর্শ বাস সার্ভিসের টিকিট কাটলাম। আধঘন্টা পরে ছাড়বে। আর লিমিটেড স্টপ। তিনঘন্টায় পোঁছে দেবে। সামনের দিকেই একটা টু সিটার জায়গা বুক করলাম। এবার জিনিসপত্র বাসের খালাসীর সাহায্যে ছাতে তুলে দড়ি বেঁধে তেরপল দিয়ে ঢেকে নিশ্চিন্ত হওয়ার পালা। তারপর একরাউণ্ড আদা তেজপাতা দিয়ে ফোটানো পাঞ্জাবি চা। রূপল খুব খুশি হবে। ওকে অনেকক্ষণ কিছু খাওয়াই নি। কেনাকাটায় এমন ব্যস্ত ছিল—
    খুশি খুশি মনে বাসের লাইনগুলো পেরিয়ে ওয়েটিং রুমে ফিরে গেলাম।
    কিন্তু হলে পৌঁছে একটু অবাক হলাম,-- রূপল কোথায়?
     ও তো সেকন্ড রো’তে বেঞ্চিতে বসে ছিল, সঙ্গে দুটো ঠাসা স্যুটকেস আর একটা বড় শপিং ব্যাগ। জায়গাটা খালি, পাশে একজন চোখে সুর্মাটানা বয়স্ক সিন্ধি ভদ্রলোক বসে সান্ধ্য পত্রিকা পড়ছেন। এদিক ওদিক তাকালাম, রূপল নেই। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম—এখানে একজন মহিলা বসেছিলেন স্যুটকেস নিয়ে, কোথায় গেলেন?
    ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন, সোনা বাঁধানো দাঁতে হেসে বললেন যে উনি পাঁচ মিনিট আগে এসেছেন, এখানটা খালিই ছিল।
    কোথায় যেতে পারে? বোধহয় ওয়াশরুমে। কিন্তু ও তো জানে যে আমি এখানেই আসব। তাই আমি বসে পড়লাম।  একঘন্টা, দেড় ঘন্টা। এবার আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। কী হতে পারে? মাথা কাজ করছিল না।
    --এক মিনিট, আবার আপনাকে একটু থামতে বলছি। আপনি রূপল ম্যামকে ফোন করলেন না? বা টেক্সট ? হয়ত উনি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছলেন। বা ব্যালান্স ফুরিয়ে গেছল।
    -- তখন আমাদের কারও কাছে মোবাইল ছিল না। আমি বলছি তিরিশ বছর আগের কথা।

    এবার দর্শকদের মধ্য থেকে সমবেত কন্ঠে একটা হুঃ হুঃ আওয়াজ উঠল।

    --না, আমার আর কিছু বলার নেই। আপনারা এবার যান, আমি বিশ্রাম করব।
    মেয়েটি বিপন্ন মুখে কিছু একটা বলার আগেই হুড়মুড় করে একপশলা বৃষ্টি নামল। ব্যস্‌ ,  ক্যামেরাম্যান তার যন্ত্রপাতি নিয়ে সোজা ভ্যানের ভিতরে ঢুকে গেল, তার পেছন পেছন অ্যাংকর মেয়েটি।    সত্যব্রত পালও সেঁদিয়ে গেছেন তাঁর তেরপলের গুহায়। সেটাকে দাদুর দস্তানাও বলা যায়।
    বৃষ্টি থামার নাম নেই।
    মেয়েটি উঁকি মেরে দেখে রাস্তা খালি। সবাই আশেপাশের দোকানের শেডের নীচে বা মেট্রোর ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে।
    ও কিছু একটা ভাবতে থাকে। তারপর ক্যামেরাম্যানকে বলে-তুই এখানেই থাক সুনু , আমি ডাকলে আসবি।
    --তুইও খেপে গেলি পিউ? একটা পাগল ছাগল লোক, তার জন্য এখন ওই অন্ধকার তাঁবুতে ঢুকবি?
    --উঁহু, ভেতরে বোধহয় এক বাতি কনেকশন আছে। বা কাছের দোকান থেকে তার টেনে নিয়েছে।
    -সেয়ানা পাগল বলতে হবে।
    --শোন, আমি একাই যাচ্ছি। মোবাইলে ভিডিও করে আনব। ওর গল্পটা পুরো করতে হবে তো!

     না, তাঁবুর ভেতরে মাঝের খুঁটির গায়ে কোন বালব নেই, তার টানা হয়নি। কিন্তু কোণের দিকে একটা চারসেলের এমার্জেন্সি ল্যাম্প জ্বলছে। তাতে যথেষ্ট আলো। একটা দড়ির খাটিয়ার উপর কম্বল আর কাঁথার উপরে বসে আছেন সত্যব্রত, পরনে একটা লুঙ্গি আর গায়ে একটা শস্তা হাফহাতা পাঞ্জাবি। তাঁবুর দরজাটার কাছে ওই চেয়ারটা নিয়ে বসেছে প্রিয়াংকা গুপ্ত, আমাদের চেনা অ্যাংকর মেয়েটি। জমিয়ে নিয়েছে সত্যব্রত পালের সঙ্গে।

    এবার উনি ওর ইন্টারভিউ নিয়েছেন। শুধরে দিয়ে বলেছেন –ওর নামটা হিন্দিতে প্রিয়ংকা হবে, বাঙালিরা হিন্দি নাম ভুল বানানে লেখে।  যেমন হিন্দি নাম তব্বু থেকে টাব্বু হয়ে যায়। বিনোদ হয়ে যায় ভিনোদ। আর প্রিয়ংকা হয় প্রিয়াংকা।
    আমাদের প্রিয়ংকা ছাড়বে কেন? বলে ওরকম হয়। রবীন্দ্রনাথ কাবুলি অথবা কাবুল ওয়ালা না লিখে লিখেছেন কাবুলীওয়ালা—ডাবল অ্যাডজেক্টিভ। আপনারাও তো হিন্দিতে মুখার্জিকে লেখেন মুকর্জি, চ্যাটার্জি হয়ে যায় চটর্জি! সআদত মন্টো বোম্বের অশোক কুমার গাঙ্গুলিকে বলেন ‘গংগোলি’!
    হেসে ওঠেন সত্যব্রত। কোথায় দেখেছ?
    --কেন, টিভি সিরিয়ালে। অত ভাববেন না। ওসব নিপাতনে সিদ্ধ। কিন্তু আপনি তো বললেন যে এই এমার্জেন্সি লাইটের চার্জ আর আধঘন্টায় ফুরিয়ে যাবে। তাহলে এখন কাজের কথায় আসি?
    -উফ্‌ তুমি তো আচ্ছা নাছোড়বান্দা!  ইন্টারভিউ না নিয়েই ছাড়বে না দেখছি!
    --পাপী পেট কা সওয়াল হ্যায় কাকু! আপনার মত ব্যাংকের চাকরি তো জোটেনি।
    --চেষ্টা করেছিলে?
    --করি নি আবার! কতবার পরীক্ষায় বসেছি। কিন্তু কপালে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কি! সে যাক গে, ওই ব্যাংকের চাকরি থেকে শুরু করি। চাকরি পেলেন আর বিয়ে হল?  তাও পাঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে, কী করে? প্রোপোজ করেছিলেন?
    --না না। যা ভাবছ সে রকম কিছু না। আসলে রূপলের কপাল খারাপ, আর আমার কপাল ভাল।
    --এমন চাপ নিচ্ছেন কেন? খুলে বলুন।
    সত্যব্রত জোরে শ্বাস টানলেন। প্রিয়ংকার থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাঁবুর মাঝখানের খুঁটিটার দিকে তাকালেন। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে একটানা বলে চললেন। প্রিয়ংকার মোবাইল ভিডিও মোডে অন করা রয়েছে।
    ‘ আমার সঙ্গে রূপলের বিয়ে হওয়া অসম্ভব ছিল। আমাদের সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবার। রূপলের বাবার ট্রান্সপোর্টের পয়সা। ও স্কুটি চালিয়ে স্কুলে আসত। এছাড়া ও ছিল আমাদের এলাকার সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। ওর সৌন্দর্য্যের মধ্যে কিছু একটা ছিল যার জন্যে সব ছেলেই মনে মনে বন্ধুত্ব করতে চাইত, কিন্তু এগোতে সাহস করত না। আমার সাদামাটা চেহারা, অল্প বয়সেই একটা বুড়োটে ভাব।  ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। বাড়িটা নিজেদের, বাবা করে গেছলেন। মা’র ফ্যামিলি পেনশনের টাকায় আমাদের সংসার চলত।
    তবে একটা কারণে অন্য ছেলেরা আমাকে হিংসে করত। কারণ, রূপলের মা আর আমার মা অভিন্ন সখী। ফলে ওদের বাড়িতে আমার সহজ আসাযাওয়া। আমার মা খুব ভাল মোরব্বা বানাতেন। শীতের মরসুমে আমলকি, আর গরমের সময় আমের মোরব্বা। আমার ডিউটি ওদের বাড়ি থেকে চিনেমাটির খালি বয়াম নিয়ে আসা, আবার ভরা বয়াম দিয়ে আসা। ওর মা সতবিন্দর কৌর খুব ভাল উল বুনতেন। প্রত্যেক শীতে সোয়েটার নয় শাল বুনে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসতেন, সঙ্গে রূপল।
    আমরা তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমি বিলাসপুরের নামকরা সরকারি কলেজে। রূপল ঘরের কাছে সাধারণ কলেজে। আমি বিলাসপুরের হোস্টেলে চলে গেলাম। ছুটিছাটায় বাড়ি আসলে দেখা হয় । কিন্তু ওকে এড়িয়ে চলি। বুঝে গেছি আমি ওর জন্য আউট অফ সিলেবাস।
    কিন্তু একদিন মায়ের ফোন এল হোস্টেলে—শীগগির বাড়ি ফিরে আয়। তোর আংকলের শরীর খারাপ।
    গিয়ে জানলাম রূপলের বাবা চলে গেছেন, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ধীরে ধীরে সবকিছু টের পেতে মাসখানেক কেটে গেল। রণধাওয়া আংকল নাকি সাট্টায় টাকা ঢালছিলেন। সেদিন একটা বড় লসের খবর এল। সামলাতে পারেননি। জানা গেল বাজারে ওনার অনেক ধার। বৌ বা মেয়েকে কিছুই জানান নি।
    জীবন বীমা পলিসি একটা ছিল রূপলের মায়ের নামে। সেটাই রক্ষা। ওরা আগের বাড়ি বেচে দিয়ে উঠে এল আমাদের পাড়ায়। রূপলের ভাই তখনও ক্লাস নাইনে। তারপর আমি গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরি পেলাম।  প্রোবেশন পেরিয়ে কনফার্মড হলাম, কোরবায় পোস্টিং। তার পরের মাসেই জানলাম মা নাকি রূপলকে আমাদের বাড়িতে ছেলেবৌ করে নিয়ে আসতে রাজি! সতবিন্দর আন্টি প্রস্তাব এনেছিলেন।
    আমি হতভম্ব, এ কী করে হতে পারে! রূপল, যে কোরবার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চারপাশের ছেলেবুড়ো সবাই না তাকিয়ে পারে না, যার জন্য কোরবা কলেজে মাঝে মধ্যেই দু’দল ছাত্রের মধ্যে মারপিট লেগে যায় –সে হবে আমার বৌ? না, এ হয় না।
    মা অনেক বোঝাল যে তুই বিয়ে তো করবি, আজ নয় কাল। তাহলে ওকে বিয়ে করতে আপত্তি কিসের। আমি মাথা নাড়ি। বলি, ও ঠিক আমাদের বাড়ির মত নয়।
    -সে বাড়ির মত করে নেওয়া যাবে। কিন্তু কথাটা শোন। আমি তোর আন্টিকে কথা দিয়েছি। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে তো।
    -মানে?
    --তোর আন্টি অনেক কান্নাকাটি করছেন। আগের ধার সব শোধ দেয়া হয় নি। এখন পাওনাদারেরা লোভের হাত বাড়াচ্ছে। তুই বড় হয়েছিস। আরও খুলে বলতে হবে?
    আমি বললাম, একবার রূপলের সঙ্গে কথা বলে দেখতে চাই।
    ওদের বাড়ির ছাদে রূপল শ্যাম্পূ করা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সে কী হাসি! থামে আর না।
    --এই যে! তাহলে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল?
    ওই হাসিতে কিছু একটা ছিল যেটা আমাকে ঘা দিল। শুনলাম আমি বলছি—তুমি না চাইলে এ বিয়ে হবে না। আমার মা বললেও না। আন্টি বললেও না। তুমি কী চাও?
     -দূর! আমি কোন বাঙালী ছেলেকে কিস্‌ করতে পারব না। ওরা দুবেলা দাঁত মাজে না। আর জিভ ছোলে না।
    হাড়পিত্তি চলে গেল। ক’টা বাঙালী ছেলেকে চুমু খেয়েছ?
     আবার সেই হাসি। শরীরে ঢেউ তুলে হাসি।
    --শোন টিউবলাইট, আমি চুমু খাই না। কিস্‌ করি। দুটোর তফাৎ জান? বুঝিয়ে দিচ্ছি।
    কিছু বোঝার আগেই ওর দু’হাতের ফাঁসে আটকা পড়ে যাই। ওর জিভ আমার মুখের ভেতর যেন সাপের ছোবল মারে।
     যেমন একঝটকায় চুমো খেল, তেমনই করে ছেড়ে দিল।  কিন্তু বিষটুকু ঢেলে দিল।
    --যা ভেবেছিলাম, দাঁত মাজে কিন্তু জিভ ছোলে না।
    ভেবেছিলাম ল্যাটা চুকল।
    কী আশ্চর্য! পরের সপ্তাহে মা জানাল যে আগামী মাসের অমুক তারিখে বিয়ে, তমুক তারিখে বৌভাত আর তারপর দ্বিরাগমন।
    আমি হাবার মত তাকিয়ে আছি দেখে মা বলল— অমন ভ্যাবাগঙ্গারামের মত তাকিয়ে আছিস কেন? রূপল তো ওর মাকে বলে দিয়েছে যে তুইও রাজি হয়েছিস।
    সুহাগরাতে রূপল জানিয়ে দিল যে আমার কাজ ঘরের বাইরে, কিন্তু ঘরের সাম্রাজ্যে ওর একছত্র অধিকার। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিলাসপুরে ট্রান্সফারের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের মায়েরা কোরবাতেই থাকবেন।
    আমি সেই রাতে মারা গেলাম, আমার শরীরে বেতাল ভর করল।
    প্রমোশনের আগেই ধরাকরা করে বিলাসপুরে ট্রান্সফার করালাম, রূপল ওখানে একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিল। এভাবেই দশটি বছর কেটে গেল। আমি একদিনের জন্যেও রূপলের অবাধ্য হই নি।
    রূপল সন্তান চায় নি, আমি বললাম ঠিক আছে। আমার প্রমোশনের পর রূপল স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিল। আমার মনে হল এটাই তো স্বাভাবিক। রূপল বাড়িতে কিটি পার্টি শুরু করল। ঠিক কথা, ও কেন খালি বাড়িতে একলা একলা সময় কাটাবে? ও রোটারি ক্লাবের মেম্বার হল। আমি গর্বে পেখম মেললাম।
    আমি রোজ দু’বেলা দাঁত মাজার সময় জিভি করি।
    আমি রূপলকে কোন কষ্ট দিতে চাইনা।
    কিন্তু একটা ব্যাপার। আমাদের মিলিত হবার পর রূপল বিছানা থেকে ঝটপট উঠে বাথরুমে গিয়ে স্নান করে নিত, শীত গ্রীষ্ম  বারোমাস। আমি চাইতাম ও আরও খানিকক্ষণ আমার পাশে শুয়ে থাকুক। আমি ওর গায়ের গন্ধ শুষে নিতে চাইতাম। হ্যাঁ, ওর গায়ের থেকে একটা অদ্ভুত মাদক গন্ধ বেরোত। উগ্র নয়, কিন্তু মৃদু গন্ধ। সেই গন্ধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত।
    একেই কি কস্তুরী গন্ধ বলে? ও কি হরিণী? গায়ে সাদা ছিট ছিট দাগ? ওকে ওইভাবে ভাবতে আমার ভাল লাগত।
    আমি বুঁদ হয়ে ওর শরীরের ধ্যান করতাম। সঙ্গমের পর ওর নাভিমূলে মুখ দিয়ে পড়ে থাকতে চাইতাম।
    কিন্তু ও হেসে উঠে ধ্যাৎ আমার সুড়সুড়ি লাগছে বলে উঠে বাথরুমে চলে যেত।
    তারপর ও একদিন বাসস্ট্যান্ড থেকে হারিয়ে গেল। সেই রাত্তিরে আমি দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে একাই কোরবা গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। ওর মা, ছোট ভাই কেউ জানে না ও কোথায়। তখন আমরা থানায় গেলাম। ওরা বলল জুরিসডিকশন বিলাসপুরের। তাই আমার কমপ্লেইন বিলাসপুরে গেল। ততদিনে আমি ব্যাংক অফিসার। কাজেই পুলিশ জানতে চাইল কারও সঙ্গে লোন ইত্যাদি নিয়ে কোন শত্রুতা আছে কিনা। ব্যাংক থেকে চাপ দেওয়ায় এসপি অফিস কেস নিল। একবছর ধরে নানা তদন্ত হল। রূপলের কোন হদিস পাওয়া গেল না।
    এইভাবে কেটে গেল কয়েকটা বছর।
    কিন্তু একদিন আমি সেই গন্ধটা পেলাম। আমার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের পাশে যেখানে রূপল বসে চুল আঁচড়াত। তারপর একদিন বাথরুমে, একদিন রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডারের গায়ে। তারপর এক জ্যোৎস্নাভেজা রাতে রূপল জানলা গলে আমার বিছানায় এল। কস্তূরী গন্ধে ভরে গেল আমার শোবার ঘর।   আমি ওর নাভিমূলে আবার মুখ রাখলাম।
    ধীরে ধীরে টের পেলাম। রূপল হারিয়ে যায় নি, কোথাও যায় নি। ও আছে, আমার ভেতরে বাসা বেঁধেছে।
    আমি জানি, আমাকে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। একমাস ধরে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে আমাকে একটা মন্ত্র আওড়াতে হবে—‘নাভিমূলে ফিরে যাব’। ব্যস্‌ ওইটুকুই। তারপর যেই আকাশে পূর্ণিমার রূপোর জামবাটি চাঁদ উঠবে, অমনি রূপল এসে হাজির হবে।
    আমি শান্ত হলাম। আমার সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে গেল।
    একদিন আমি এস পি অফিসে গিয়ে বললাম ‘ডিস্‌অ্যাপিয়ারেন্স অফ রূপল পাল’  ফাইলটা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, আমি রূপলকে পেয়ে গেছি। ওরা বলল, কোথায়? এর জন্যে ওঁর স্টেটমেন্ট চাই। তা নইলে ফাইল বন্ধ করা যাবে না।
    কী মুশকিল! ও তো যখন তখন আসে না। ওর আগমন তিথি পূর্ণিমার রাত। বাকি দিন ও থাকে আমার ভেতরে।
    --কাকু, আপনি বোধহয় ওঁর খুব খেয়াল রাখতেন, ওঁকে কোন কষ্ট পেতে দেননি?
    --ঠিক ধরেছ, শুধু এটা জানতে পারি নি যে তাহলে ও মাঝখানে হারিয়ে গেছল কেন? জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু জবাব না দিয়ে মুচকি মুচকি হাসে।
    --আমার কি মনে হয় কাকু, উনি বোধহয় এত আদর এত ভালবাসা পেতে পেতে একটু হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। তাই-
    --সে আবার হয় নাকি? কেউ আরাম ছেড়ে সুখের জীবন ছেড়ে দুঃখ খোঁজে?
    --ধরুন কাকু এই যে লোকে কোলকাতা ছেড়ে  পাহাড়ে পর্বতে বনে নদীর ধারে বেড়াতে যায়, ট্রেকিং করে—কেন যায়? আবার ক’দিন পরে কোলকাতার বাড়িতেই ফিরে আসে। বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারলাম না।
    সত্যব্রত চুপ করে বসে নিজের হাতের চেটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এমার্জেন্সি লাইটের তেজ ফিকে হচ্ছে।
    --আচ্ছা, আমার শেষ প্রশ্নঃ ছত্তিশগড় ছেড়ে কোলকাতার ফুটপাথে কেন? আর পুলিশের উপর এত রাগ কেন?
    --  রাগ হবে না? ওরা আমার কথা বিশ্বাস করল না। ভাবল, আমি কিছু লুকোচ্ছি, ধামাচাপা দিচ্ছি। একদিন আমার বাড়ি সার্চ করে ফটোর অ্যালবাম, রূপলের আলমারি  স্যুটকেস সব তছনছ করল। ওদের চোখে পড়ল দেয়ালের গায়ে কিছু রিপেয়ারিং-- মানে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়েছিল , বিড়লা হোয়াইট দিয়ে লেপে দিয়েছিলাম। ওরা সেই দেওয়ালটা খুঁড়ল, বাগানের উইয়ে খাওয়া বেদানার গাছের চারপাশ খুঁড়ল, শেষে বারান্দার ভিত খুঁড়ে ফেলল।
    আমি কি রূপলকে ওখানে পুঁতে রেখেছি? ওরা পারেও।
    এরপর আর ওখানে মন লাগল না। চাকরি থেকে অবসর নিলাম, বাড়িটা বেচে দিলাম। তারপর এখানে চলে এলাম।
    --বুঝলাম; কিন্তু এত শহর থাকতে কোলকাতায় কেন?
    --কোলকাতা ভালাবাসতে জানে, ভালাবাসার মর্য্যাদা দেয়। ওরা কে সি পালকে অপমান করেনি। ওনার সিনেমা বানিয়েছে। খবরের কাগজে সম্মান দিয়ে লিখেছে। আর আর এই শহর রূপলের ছোটবেলার। যদি এখানে ও আমার কাছে মাসে আরও একবার আসে? পূর্ণিমা ছাড়া অন্য কোন তিথিতেও ?
     এবার তুমি যাও, বাইরে আলো আছে। এখন চিঁড়ে ভিজিয়ে খাব, খিদে পেয়েছে।

                    ************

    প্রিয়ংকা বেরিয়ে এসে দেখে বৃষ্টি ধরে গেছে। রাস্তায় লাইট জ্বলে উঠেছে। ও মোবাইল বন্ধ করে অন্যমনস্ক ভাবে মাথার চুল ঠিক করে তাকাতেই দেখে সুনীল ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে।
    --কী রে ! এতক্ষণ লাগল? পাগলাটার বকবকানি শুনে তুইও পাগল  হোস নি তো?
    প্রিয়ংকা হেসে মাথা নাড়ে, ওকে থাম্বস্‌ আপ দেখায়।  তারপর বলে – চল সুনু, ভ্যানে বসে ভিডিওটা আপলোড করি।
    ভ্যানে বসে ও শার্টের একটা বোতাম খুলে ফেলে। উফ্‌ এক্কেবারে ঘেমে নেয়ে একশা’।
    --এত চাপ নিয়ে তোর কী লাভ হল বলত? মাইনে বাড়বে?
    --না, মাইনেটা বহাল থাকবে। আজ আমাদের টপ বস মিঃ পুরন সিং গিল বলে দিয়েছিলেন যে ওই পাগলাটার ইন্টারভিউ না নিয়ে যেন অফিসে মুখ না দেখাই।  
    --কেন বল দিকি? ওই পাগলাটা কোন শালা চোটের হাবিলদার?
    --তা জানিনা। বসের বৌয়ের হুকুম। আর আমাদের বস কিন্তু এক্কেবারে—। আসলে এই চ্যানেলের আসল  ইনভেস্টমেন্ট তো ওনার গিন্নির, বুঝলি না?
    -- তাই নাকি? কী নাম আমাদের মালকিনের?
    -- মনে পড়ছে না। ইন্দিরা সিনেমার কাছেই কোথাও থাকেন। দাঁড়া, ব্যাগে একটা কার্ড রয়েছে। কারণ ইন্টারভিউ হয়ে গেলে সোজা ম্যাডামকে টেক্সট করে রিপোর্ট করতে হবে।
    হাতড়ে হাতড়ে কার্ডটা বের করে প্রিয়ংকা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কোন কথা না বলে সুনীলের দিকে এগিয়ে দেয়।

                                 Mrs. Rupal Gil,
                           17/2, Indra Roy Road,
                             Near Indira Talkies
                               Bhowanipore
                              Kolkata 700025

    (শেষ)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন