কবি বলেছেন বটে, "যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ। এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।" তবু , শতকের পর শতক, নারী তার সৌন্দর্যকে স্বাধীনতার সম্মান দিতে চেয়েছে । সেই সত্ত্বার সাহসী প্রকাশ ঘটেছে তার দেহরঞ্জনের মাধ্যমে ; কখনো চুল, কখনো ওষ্ঠ আবার কখনওবা নখ । বিশ্বের সর্বপ্রান্তে রঞ্জিত নখরের জয়জয়কার । ফ্যাশন স্টেটমেন্টের ক্ষেত্রে নেইল পলিশের আধিপত্য প্রশ্নাতীত । ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় , নেইল পলিশের উৎপত্তি চীনে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে মোম, ডিমের সাদা অংশ, জিলেটিন এবং উদ্ভিজ্জ রঙ। প্রাচীন মিশরে, নেইলপলিশ এমনকি অর্থনৈতিক সূচক হিসেবেও পরিগণিত হতো , নিম্ন শ্রেণীর জন্য হালকা রঙ আর উচ্চ সমাজের জন্য গাঢ় আইকনিক লাল রঙ। নেইল পলিশের জনপ্রিয়তার ইতিহাস শুরু হয়েছিল সপ্তদশ শতকে যখন চকচকে নখের কদর বাড়তে শুরু করে । আদিতে, গাড়ির ঝলমলে রঙ বা পেইন্টকেই একটু নিরাপদ আর ব্যবহারযোগ্য করে নেইল পলিশ হিসেবে প্রয়োগ করা হতো । ১৯২০ সালে চার্লস রেভসন কোম্পানি প্রথম আধুনিক দিনের নেইল বার্নিশ প্রচলন করেছিল। রেভলন ১৯৩২ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত নেইল পলিশ ব্র্যান্ড হিসেবে একটি ক্রিম রঙা নখর রঞ্জক তৈরী করে। ইতিপূর্বে , ১৯১৬ সালে একটি সম্পূর্ণ বর্ণহীন নেইলপলিশের ব্যবহার হতো । এই চমকপ্রদ উদ্ভাবনটি মহিলাদের প্রসাধনী বাজারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯৮১ সালে, এসি উইঙ্গারটেন মাত্র বারোখানি রঙের নেইলপলিশ নিয়ে "এসি কসমেটিকস " প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তী সময়ে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরো বেশ কয়েকটি রঙের প্রবর্তন হয়। ধীরে ধীরে নেলপলিশের প্রায় হাজার খানেক শেড নিয়ে এসি একটি প্রখ্যাত নেইলপলিশ ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে; ২০১০ সালে, লরিয়াল , একটি সুপরিচিত কোম্পানি এসি কসমেটিকস অধিগ্রহণ করে নেয় । অধুনা , নেইল পলিশের অন্যতম প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলি হলো, ফিল্ম গঠনকারী এজেন্ট যেমন নাইট্রোসেলুলোজ, রজন , টসিলামাইড এবং ফরমালডিহাইড। নাইট্রোসেলুলোজ একটি দীর্ঘস্থায়ী ফিল্ম গঠনকারী এজেন্ট। এটি উদ্ভিদ কোষ থেকে প্রাপ্ত নাইট্রেটেড সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। সেলুলোজ হল তুলো জাতীয় উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের একটি প্রাকৃতিক উপাদান। এটি স্থায়িত্ব, দৃঢ়তা এবং দ্রবণীয়তা আনবার জন্য নেইলপলিশে ব্যবহৃত হয়।এছাড়াও, রঙ এবং চকচকে বিভিন্ন রঙ্গক সহ বস্তুটিকে তরল আকারে নমনীয় রাখতে প্লাস্টিকাইজার ব্যবহার করা হয়। মানুষের নখ প্রধানত: কেরাটিন নামক শক্ত প্রোটিন দিয়ে তৈরি । নেইল পলিশের কোনো উপাদান যাতে এই কেরাটিনের ক্ষতিসাধন না করে প্রস্তুতকালে সেদিকে নজর রাখা বাঞ্ছনীয় । সম্প্রতি কেল সহ কয়েকটি ব্র্যান্ডের নেইলপলিশ নখকে মসৃণ ও উজ্জ্বল করবে বলে দাবি। লন্ডনটাউন লাকুরের প্রস্তাবিত সূত্র অনুযায়ী এগুলিতে রয়েছে নখ মজবুত এবং শক্ত করার জন্য রসুন এবং শসা রয়েছে যা নখের ভেঙে যাওয়া প্রতিরোধ করে ।অবশ্য নেইলপলিশ একটি দাহ্য রাসায়নিক এবং সেই কারনে এর ব্যবহারে কিছু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ রয়েছে।
এতক্ষন তো গেলো নেইলপলিশ নিয়ে প্রারম্ভিক কচকচি । দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা একটা আস্ত দিন বরাদ্দ করেছে নেইলপলিশের দিন হিসেবে ; প্রতিবছর জুন মাসের পয়লা ।
এবার একটু আলোচনা করা যাক যে নেইলপলিশ কেন নারীকে সুন্দর হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই সৌন্দৰ্য্য' আসলে কী ? মানব মস্তিষ্ক বাহ্যিক সৌন্দৰ্য্য বিচার করে একেবারে নিজস্ব মাপকাঠিতে জেক যৌক্তিকতার আতস কাঁচে বিচার করা যায়না । মস্তিষ্কের যে অঞ্চলটি মানুষের বাহ্যিক সৌন্দৰ্য্য পরিমাপ করে থাকে, সেই অঞ্চলটি যুক্তি নয়, কল্পনাশক্তি ও স্বজ্ঞার দাস । মনুষ্য মস্তিষ্কের সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস', 'ভিসুয়াল কর্টেক্স' এবং অবচেতন স্মৃতি সঞ্চয়কারী অংশগুলি অর্থাৎ টেম্পোরাল লোবের অংশ বিশেষ , 'পুটামেন','কডেট নিউক্লিয়াস' ও ' মোটর কর্টেক্স' পরিচিত স্বজ্ঞাত অঞ্চল নামে । আদিম পূর্বপুরুষদের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের পদ্ধতি ও নারীর রূপ পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁদের জিনগত তথ্যে প্রভাব ফেলেছিল। বংশপরম্পরায় সেই সকল পরিবর্তিত জিনগত তথ্যের অনেকগুলি মস্তিষ্কের 'সিম্যান্টিক স্মৃতি ' বহনকারী স্নায়ুকোষগুলোর গঠন ও কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। এছাড়াও বর্তমান জীবনযাপন এবং মানুষের বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের 'সিম্যান্টিক স্মৃতির ' সংক্রান্ত বেশ কিছু স্নায়ুকোষের জিনে (নিউরাল জিন) পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। এসবের ভিত্তিতে বেশীরভাগ মানুষের মস্তিস্ক নির্ধারণ করে যে গাঢ় উজ্জ্বল, মসৃন নখর নারীর সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে ।
সে যাইহোক, স্বাভাবিক বনাম রঞ্জিত সৌন্দর্যের গ্রহণযোগ্যতার প্রতিযোগিতায় জয়লাভ যে পক্ষেরই হোক না কেন , এইসব রঞ্জক সামগ্রী চিরকাল ছাপ রেখে এসেছে প্রসাধনের ইতিহাসে ।