'আরে দাদা, শুনছেন। আমার শ্রীমান টেট পাস করেছে।'
'বাঃ বেশ ভালো খবর। শুনছি তো পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রেট উঠেছে।'
- 'পাঁচ লাখ। প্রাইমারি টিচারের পোস্টের জন্য!.... অসম্ভব। আমি দিতামও না।'
*************************
বাবার কথাগুলো শুনে তখন হাসি পেলেও বিদ্যাসাগর ভবনের সামনে ভিড় দেখে সত্যিই হাসার মত পরিস্থিতি ছিল না। সেই ভিড়ে হবু শিক্ষকদের থেকে তাদের বাবা মায়ের সংখ্যাই বেশি। ওখানে গিয়ে শুনি টেটের অ্যাডমিট কার্ড লাগবে। এ আবার কি ঝামেলা? অনেকেই বিভ্রান্ত, বিরক্ত। আগে তো এসব বলে নি।
পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলাম -
'দাদা এখানে কাছাকাছি কোথাও সাইবার ক্যাফে আছে...জানেন?'
ভদ্রলোক ততক্ষণে একটা ট্যাক্সি দাড় করিয়ে তাতে উঠে পড়েছেন। ডাইরেক্ট বাড়ি থেকে অ্যাডমিট কার্ড আনতে যাচ্ছেন।
উনি হাত নেড়ে ঝেড়ে দিলেন - 'দাঁড়ান মশাই, আমাকে জ্বালাবেন না।'
যাঃ। আমি কি ওনার কাছে টাকা ধার চেয়েছি না বিয়ের জন্য মেয়ে চেয়েছি!
অথচ একটু আগেই তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে সুন্দর ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যেই একটা খবর জানতে চাইলাম অমনি হাওয়া। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।
চাকরি পেয়েছে ওনার মেয়ে। কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছে উনিই চাকরিটা করবেন। অভিভাবকরা তাদের হীরের টুকরো ছেলে মেয়েদের নিয়ে এমনভাবে বিদ্যাসাগর ভবনের সামনে হাজির হয়েছেন, ঈশপের গল্পে সোনার ডিম পাড়া হাঁস কেও তার মালিক এতটা পুতু পুতু করে আগলে রাখে নি।
হীরের টুকরো! হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে একটা সরকারি চাকরি পাওয়া সত্যিই ভাগের ব্যাপার। তারা আসলে প্রতিভাবান।
শেষে পাশের গলিতে একটা সাইবার ক্যাফের খোঁজ পাওয়া গেল। সমস্যাটা মিটল। চাকরি পাওয়া যতটা সোজা মনে হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ততটাই কঠিন।
বিদ্যাসাগর ভবনের গেট খুলতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। পুরো চত্বরটা মাছের বাজার হয়ে গেছে। যত রাত হোক, আজকের মধ্যেই সবাইকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ধরাতেই হবে। উপর থেকে অর্ডার এসেছে।
চারদিকে ক্যাওম্যাও, ঘন্টার পর ঘন্টা দীর্ঘ অপেক্ষা। মাঝে মাঝে মাইকে একটা করে নাম ডাকছে। অধৈর্য্য হলেও সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো। সাত রাজার ধন এক মাণিক এই প্রাইমারী টিচারের চাকরি। কত কষ্ট করে পাওয়া! সোজা বা বাঁকা, যে ভাবেই হোক, চাকরি তো -
তাই কেউ দুঃছাই করে বিরক্তিও দেখাতে পারছে না।
কাউন্সেলিং এ প্রথমে ট্রেনিং প্রাপ্তদের ডাক পড়ল। এরপর প্রতিবন্ধীদের পালা। চুপচাপ দেখতে থাকি। ভাল স্কুলগুলো তো ওরাই সিলেক্ট করে নেবে। ভাগ্য! এরই মাঝে সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা।
- 'কিরে, কেমন আছিস? বরুনের খবর কি?'
আমি, সঞ্জয় আর বরুন বেহালায় একসঙ্গে কোচিং নিতাম।
- 'ঝক্কাস আছি ভাই। বরুনের সাথেই কালকেই ইকো পার্ক ঘুরে এলাম।'
কথা বলার ফাঁকেই আমি দেখলাম, মঞ্জিরা কাউন্সেলিং হলের দিকে এগোচ্ছে। ওকে আমি চিনি। আমার পাশের গলিতেই থাকে। মানে ওর চাকরি হয়ে গেল।
আস্তে আস্তে বেলা পড়ে এল। এবার সঞ্জয়ের নাম ডাকছে। আধঘন্টা পরে বেরিয়ে আসতেই একটা মেয়ে সঞ্জয়কে জিগ্যেস করল - 'কিরে কোথায় হল?'
- 'বড়িশা', সঞ্জয়ের চটপট উত্তর।
- 'আমিও বেহালায় পেয়ে গেছি।'
আমি সরে এলাম। চারদিকে একবার দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ফেললাম। সন্ধ্যা হয়ে এল। এখনো আমার নাম ডাকে নি।
সারা রাজ্য জুড়ে পয়ত্রিশ লাখ লোক পরীক্ষা দিয়েছিল। পাশ করেছে মাত্র সতের হাজার। হ্যাঁ! মাত্র সতের হাজার। আর এই সংখ্যাটার মধ্যে কতটা ব্যক্তিগত যোগ্যতার অবদান বলা মুশকিল। হতাশ হয়ে পড়লাম। পরিশ্রমের কোন মূল্য নেই। কারণ আমি জানি, এতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নাম ঠেকেছে তাদের অনেকের মিনিমাম নলেজটুকু নেই। সবকিছু ঠিকঠাক হলে আমার নাম অনেক আগেই ডাকত। এক অদ্ভুত রাগে আমার শরীর গরম হয়ে উঠল।
*************************
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।