এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাঙালি ছাত্রের পবিত্র মন

    শেখ রিজন লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ জুলাই ২০২১ | ১২২৭ বার পঠিত
  • ১.

    পুরান ঢাকার বকশীবাজার মোড়ে বুয়েটের একটা আবাসিক হল আছে। নজরুল ইসলাম হল। ২০০+ ছেলে থাকে এখানে। এই নজরুল হলের বাউন্ডারি ঘেষেই আছে ঢাকা মেডিকেলের আরেকটা হল। ফজলে রাব্বি হল। সরু রাস্তা পার হয়ে ওপারে আছে আলিয়া মাদ্রাসার আরেকটা হল। আল্লামা কাশগরি হল। একেবারে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ৩ টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩ টা হলের কয়েকশো শিক্ষার্থী এভাবে পাশাপাশি থাকছে। যখন পোলাপান চিল মুডে থাকে, বিশেষত একটু গভীর রাতে, তখন মাঝে মাঝে আন্তঃহল গালাগালি প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

    ঢাকা মেডিকেলের পোলাপাইনদের উদ্দেশ্যে তখন হয়ত ঢামেক আর আলিয়া মাদ্রাসার পোলাপান মধুর বাণী ডেলিভারি করে -- ওই কসাই এর দল, ওই কবিরাজের দল, ওই হাতুড়ে ডাক্তার, করিস কি? এত মানুষ মারিস ক্যান? ওষুধ কোম্পানির টাকা খেয়ে ভ্যাজাল ওষুধ লিখিস ক্যান? **-&@&৳*#-@-*#৭৭২-#*&# ইত্যাদি ইত্যাদি

    বুয়েটের পোলাপানকে তখন ঢামেক আর আলিয়া মাদ্রাসা বলে, ওই মেকানিক, ওই মিস্ত্রির বাচ্চা, রডের বদলে বাশ দিস ক্যান? বাশ তোর পু** এর মধ্যে ঢুকাইয়া দিমু। তোদের বয়লারে, গাড়িতে, এসিতে আগুন ধরে যায় ক্যান? কাটাকল্লা দিয়া পদ্মাসেতু বানাইছিস ক্যান? %%@&#*৳- ইত্যাদি ইত্যাদি

    আলিয়া মাদ্রাসার পোলাপানকে তখন বুয়েট আর ঢামেক বলে, ওই তালেবান জংগী, ওই রাজাকারের বাচ্চা, ওই রগকাটা শিবির ! হুদাই জাল হাদিস দিয়ে ফতোয়া দিস ক্যান? কোরান-হাদিস নিয়ে ব্যবসা করিস ক্যান? টাকা খাইয়া খারাপ মানুষদের মিলাদে গিয়ে ভাল ভাল দোয়া করে দিস ক্যান? @%৳*২-#*&#%#*৳* ইত্যাদি ইত্যাদি

    ২.

    আন্তঃ ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতা বাদে গালাগালির ডমেস্টিক টুর্নামেন্টও হয় রেগুলার। বুয়েটের হলগুলার মধ্যে রুটিন করে রাত ১২ টায় এই প্রতিযোগিতা হয়।

    ( বুয়েটের নিজেদের পাওয়ার প্লান্ট আছে। ওই কারেন্ট দিয়ে ১৮ ঘন্টা চলে সে। তবে রাত ১২ থেকে সকাল ৬ টা -- এই ৬ ঘন্টার কারেন্ট সে ন্যাশনাল গ্রিড থেকে নেয়। এ কারণে, প্রতিদিন রাত ১২ টায় এবং সকাল ৬ টায় ফেজ চেঞ্জ করার কারনে দুইবার কারেন্ট চলে যায়। কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে আসে )

    এই মিনিট খানেক সময়ের মধ্যেই সবাই তাদের মনের অবদমিত কামনা বাসনা এক্সপ্রেস করে এই সময়। এক হল আরেক হলকে গালাগাল তো করেই, এক রুমের পোলা আরেক রুমের পোলাকেও মনের সাধ মিটিয়ে তার মনের চাপা কথাগুলা এক্সপ্রেস করে। অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না, এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ।

    একবার বুয়েটে কি কারনে যেন পুলিশ এসেছিল। আউলা (আহসানউল্লা) হলের গেটের সামনে একটা বেঞ্চে ৩/৪ জন বসে থাকত সারাদিন। প্রথমদিন রাত ১২ টার সময় তুমুল বেগে পুলিশদের উদ্দেশ্য করে গালি বর্ষণ করা হল। কারেন্ট আসলে দেখা গেল, পুলিশের দল হলের গেট থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বন্দুক হাতে নিয়ে সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কারেন্ট চলে যাওয়ার শানে নুজুল এবং হঠাত গালিগালাজের শানে নুজুল কিছুই তারা জানত না।

    হলের যেসব বফ-গফ রাতে ফিসফিস করে মোবাইলে কথা বলে, তারা রাত ১২ টার সময় হঠাত করে মধুর মধুর রোমান্টিক কথার বদলে গালিগালাজ শোনা শুরু করে। কি একটা অবস্থা! পুরা মুডটাই নষ্ট!! কারেন্ট আসার পরে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয় :(

    বুয়েট কম্পাউন্ডের আবাসিক ৮ টা হলের মধ্যে, শেরে বাংলা হল ছিল একেবারে মধ্যে। এ কারনে অন্য হলগুলার টার্গেট প্রাকটিসের বেস্ট জায়গা ছিল শেরে বাংলা। চা চিনি দুধে / শেরে বাংলায় চু** জাতীয় অনেক মধুর মধুর স্লোগান শেরে বাংলার প্রতি ডেলিভারি দেওয়া হত।

    ইভেন ক্যাম্পাসের বাইরেও, বুয়েটিয়ানদের কোনো গেট টুগেদার এ কারেন্ট চলে গেলে ( কিংবা এমনিতেও) 'ওই শেরেবাংলা' নামে চিৎকার শোনা যায়। নটরডেম এর পোলাপান যেমন নিজেরা একত্রিত হলে কারনে অকারনে 'উয়ি' বলে চিৎকার করে, বুয়েটের ক্ষেত্রেও 'ওই শেরেবাংলা' একটা ট্রেডমার্ক এর মত হয়ে গেছে।

    ৩.

    এই জিনিস যে শুধু আমাদের জেনারেশন এর পোলাপান করতেছে, তাই নয়। আমাদের আগের জেনারেশন, বাপ, দাদা, ঠাকুরদাদারাও এসব করে গেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর 'রঙিন চশমা' বইয়ে এমন একটা বর্নণা পাওয়া যায়।

    ঢাকা ভার্সিটি - ১৯৭৩/৭৪ সালের ঘটনা এটা। জাফর ইকবাল তখন চানখারপুলের ফজলুল হক হলে থাকে। পাশের হলের নাম শহীদুল্লাহ হল। এই দুই হলের পোলাপান মাঝেমাঝেই (বিশেষত রাতে) গালি প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। জাফর ইকবালের কথায়, "কোনো বিরোধ নেই, কোনো রাগ বা বিরক্তি নেই,অপছন্দ নেই, শুধু গালাগাল দেওয়ার জন্যই গালাগাল"।

    যাই হোক, এক বিকেলে, ফজলুল হক হলের এক ছেলে বাইরে যাবে। যাওয়ার আগে কি মনে করে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ঐ ঐ ঐ ঐ ********

    সাথে সাথে শহীদুল্লাহ হল থেকেও আরেকজন চেচিয়ে বলল, ঐ ঐ ঐ ঐ *******

    দুই হলের গালাগালি শুরু হয়ে গেল। গালি শুরু করা ছেলেটা বেরিয়ে গেল তার কাজে।

    গভীর রাতে জাফর ইকবাল হলে ফিরে এসে দেখে, ধুন্দুমার অবস্থা। গালাগাল তখনো চলছে এবং বেড়েছে। মুখের শক্তিতে ভরসা করতে না পেরে, দুই গ্রুপই মাইক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।

    গল্পের শেষ লাইন হচ্ছে, "নিজের হাতে ছোট একটা বীজ বপনের পর সেটা যখন মহীরুহ হয়ে ওঠে তখন কার না ভাল লাগে?"

    কাহিনী বুঝেছেন? বিকেলে জাফর ইকবালই গালাগালি শুরু করেছিল। পরে সে হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন ফিরে এসে দেখে, তার চারাটা মহীরুহ হয়ে গেছে। দুই হল এখন মাইক ভাড়া করে এনে একে অপরের দিকে ফিট করে গালাগালি চালিয়ে যাচ্ছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন